জাতীয়তাবাদী জিয়া

এমাজউদ্দীন আহমদ

বাংলাদেশের রাজনীতির ক্ষেত্রে জিয়াউর রহমানের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ অবদান হলো বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের প্রতিষ্ঠা। আমাদের জাতিগত পরিচয় কী বাঙালি, না বাংলাদেশি? এই প্রশ্ন অন্যদের মতো তাকেও গভীরভাবে আন্দোলিত করেছিল। যেমন শেখ মুজিব বাঙালি, তেমনি বাঙালি জিয়াউর রহমানও। নিজেও আমি বাঙালি। কিন্তু মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা কী বাঙালি? নীরু চাকমা? অথবা মহিন্দর গারো? মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন ১৯৭০ সালের নির্বাচনে। বাংলাদেশের গণপরিষদে যখন বাংলাদেশের সংবিধান রচিত হচ্ছিল তখন জাতিগত পরিচয় বাঙালিত্ব গ্রহণের সময় তিনি বিতর্কে অংশগ্রহণ করে যা বলেছিলেন তা উল্লেখযোগ্য। ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর গণপরিষদে বলেছিলেন, ‘আমি একজন চাকমা। একজন মারমা কখনো চাকমা হতে পারে না। একজন চাকমাও বাঙালি হতে পারে না। আমি একজন চাকমা। আমি বাঙালি নই। আমি বাংলাদেশের নাগরিক। একজন বাংলাদেশি। আপনিও একজন বাংলাদেশি, কিন্তু জাতিগত পরিচয়ে একজন বাঙালি। তারা উপজাতীয়রা কখনো বাঙালি হতে পারে না।[I am a Chakma, A Marma can never be a Chakma, a Chakma can never be a Bengali… I am a Chakma. I am not a Bengali. I am a citizen of Bangladesh-Bangladeshi. You are also Bangladeshi but your national identity is Bengali… They (tribals) can never be Bengali.]

মানবেন্দ্র লারমার যুক্তি সঠিক হলেও তার যুক্তি শোনার ধৈর্য কারো ছিল না। শেখ মুজিবুর রহমান উপজাতীয়দের বাঙালি হয়ে যাবার নির্দেশ দিয়েই খালাস। ফলে সমগ্র জনসমষ্টি বাঙালি হয়ে গেল সংবিধান অনুযায়ী। বাংলাদেশে বসবাসকারী অন্তত ৫৭টি উপজাতীয় জনগণ সন্ত্রস্ত হয়ে উঠল। জাতীয় এবং আঞ্চলিক পর্যায়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হলো। সৃষ্টি হলো সংশয়। বাংলাদেশে বসবাসকারী সকলেই যদি বাঙালি হয়, তাহলে মারমা, চাকমা, টিপরা, সাঁওতাল, মনিপুরীরা কী? ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বাংলাভাষীরাই বা কী? মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা যা বলেছিলেন তা কী ফেলে দেবার মতো? তিনি বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে নিজেদের বাংলাদেশি বলেই চিহ্নিত করেছিলেন, যেমন বাঙালি, বিহারি, গুজরাটি, আসামি সবাই মিলে ভারতীয়, অথবা পাঞ্জাবি, সিন্ধি, বেলুচি, পাঠান মিলে সবাই পাকিস্তানি। এক্ষেত্রেও জিয়াউর রহমানের সৃজনশীল মেধার সুস্পষ্ট প্রকাশ ঘটেছে। শুধু বাংলা ভাষা এবং সংস্কৃতির ঐক্যের ভিত্তিতে যে জাতীয়তা গড়ে ওঠে না, এ জন্য প্রয়োজন হয় জনসমষ্টির ঐতিহাসিক অর্জনের উজ্জ্বল স্মৃতি, ভৌগোলিক ঐক্যসূত্র, ধর্মীয় চেতনার সুষ্ঠু বন্ধন এবং অর্থনৈতিক কর্মককা-ের সততা যা প্রকাশ পায় জিয়াউর রহমানের উদ্যোগে। ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’ শীর্ষক নিবন্ধে জিয়াউর রহমান লিখেছেন, ‘এই পর্যায়ে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের মূল বিষয়গুলো ব্যাখ্যার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে, যা ছাড়া জাতীয়তাবাদী দর্শনের আন্দোলন এবং তার মূল লক্ষ্য অর্থাৎ শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার কাজ হয়ে পড়েছে অসম্পূর্ণ, ত্রুটিপূর্ণ ও বিভ্রান্তিকর। আমরা বলতে পারি বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের মোটামুটি সাতটি মৌলিক বিবেচ্য বিষয় রয়েছে। তা হচ্ছে, (১) বাংলাদেশের ভূমি অর্থাৎ আন্তর্জাতিক সীমারেখার মধ্যবর্তী আমাদের ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক এলাকা; (২) ধর্ম ও গোত্র নির্বিশেষে দেশের জনগণ; (৩) আমাদের ভাষা বাংলা ভাষা; (৪) আমাদের সংস্কৃতি-জনগণের আশা আকাক্সক্ষা, উদ্দীপনা ও আন্তরিকতার ধারক ও বাহক আমাদের নিজস্ব কৃষ্টি ও সংস্কৃতি; (৫) দুশো বছর উপনিবেশ থাকার প্রেক্ষাপটে বিশেষ অর্থনৈতিক বিবেচনার বৈপ্লবিক দিক; (৬) আমাদের ধর্ম- প্রতিটি নারী ও পুরুষের অবাধে তাদের নিজ নিজ ধর্মীয় অনুশাসন ও রীতি-নীতি পালনের পূর্ণ স্বাধীনতা; (৭) সর্বোপরি আমাদের ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ যার মধ্য দিয়ে আমাদের বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের দর্শন বাস্তব ও চূড়ান্ত রূপ লাভ করেছে’।

সত্যিই জিয়াউর রহমান আমৃত্যু একজন সৈনিক। তিনি দেশকে ভালোবেসে, দেশের জন্য অর্থপূর্ণ কিছু করতে উদগ্র আকাক্সক্ষার জন্য আমৃত্যু কাজ করে গেছেন। তিনি একজন সাচ্চা জাতীয়তাবাদী হিসেবে জাতির আশা-আকাক্সক্ষাকে ধারণ করে, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎকে নিশ্চিত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠা করেছেন। এদিক থেকে বিচার করলে বলা যায়, উন্নয়নশীল বিশ্বে দেশপ্রেমিক সব রাষ্ট্রনায়কই সৈনিক। জাতীয় অগ্রগতি অর্জনের জন্য প্রতি পদে পদে তাঁকে লড়তে হয়। সব প্রতিবন্ধকতাকে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে শত্রু ওপর বিজয় অর্জনের কৌশল সদা তৈরি রাখতে হয়। লক্ষ্য অর্জনে সর্বাধিক স্বল্প ব্যয়ে যেন তা সম্ভব হয় সে সম্পর্কেও তিনি সদাজাগ্রত। বলতে কোনো দ্বিধা নেই, তিনি ছিলেন এক সফল সৈনিক। শ্রেষ্ঠতম মুক্তিযোদ্ধাদের একজন তিনি। জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণের প্রধান সেনাপতি। জনস্বার্থের অতন্দ্র প্রহরী। তাঁর যুদ্ধক্ষেত্র শুধু মুক্তিযুদ্ধের মহান ক্ষেত্রেই সীমিত নয়, তা সম্প্রসারিত ছিল মাঠে-ঘাটে, কৃষকদের দোরগোড়ায়, শ্রমিকের কারখানার প্রান্তে, দেশের তরুণদের আত্মবিশ্বাস জাগ্রত করার লক্ষ্যে, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, জাতীয় সংসদ থেকে শুরু করে পল্লী উন্নয়ন ও জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের বিভিন্ন চত্বরে।

সত্যিই জিয়াউর রহমান আমৃত্যু একজন সৈনিক। তিনি দেশকে ভালোবেসে, দেশের জন্য অর্থপূর্ণ কিছু করতে উদগ্র আকাক্সক্ষার জন্য আমৃত্যু কাজ করে গেছেন। তিনি একজন সাচ্চা জাতীয়তাবাদী হিসেবে জাতির আশা-আকাক্সক্ষাকে ধারণ করে, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎকে নিশ্চিত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠা করেছেন। এদিক থেকে বিচার করলে বলা যায়, উন্নয়নশীল বিশ্বে দেশপ্রেমিক সব রাষ্ট্রনায়কই সৈনিক। জাতীয় অগ্রগতি অর্জনের জন্য প্রতি পদে পদে তাঁকে লড়তে হয়। সব প্রতিবন্ধকতাকে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে শত্রুর ওপর বিজয় অর্জনের কৌশল সদা তৈরি রাখতে হয়। লক্ষ্য অর্জনে সর্বাধিক স্বল্প ব্যয়ে যেন তা সম্ভব হয় সে সম্পর্কেও তিনি সদাজাগ্রত। বলতে কোনো দ্বিধা নেই, তিনি ছিলেন এক সফল সৈনিক। শ্রেষ্ঠতম মুক্তিযোদ্ধাদের একজন তিনি। জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণের প্রধান সেনাপতি। জনস্বার্থের অতন্দ্র প্রহরী। তাঁর যুদ্ধক্ষেত্র শুধু মুক্তিযুদ্ধের মহান ক্ষেত্রেই সীমিত নয়, তা সম্প্রসারিত ছিল মাঠে-ঘাটে, কৃষকদের দোরগোড়ায়, শ্রমিকের কারখানার প্রান্তে, দেশের তরুণদের আত্মবিশ্বাস জাগ্রত করার লক্ষ্যে, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, জাতীয় সংসদ থেকে শুরু করে পল্লী উন্নয়ন ও জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের বিভিন্ন চত্বরে।
খ্যাতনামা নাট্যকার হেনরিক ইবসেন (Henrik Ibsen) তার অত্যন্ত জনপ্রিয় নাটকে (An Enemy of the people) লিখেছেন, ‘একটি রাজনৈতিক সম্প্রদায় একটি জাহাজের মতো। এই জাহাজ পরিচালনার দায়িত্ব নেওয়ার জন্য প্রত্যেককে তৈরি হওয়া উচিত’ (অ পড়সসঁহরঃু রং ষরশব ধ ংযরঢ়; বাবৎুড়হব ড়ঁমযঃ ঃড় নব ঢ়ৎবঢ়ধৎবফ ঃড় ঃধশব ঃযব যবষস.)। সত্যিই তো, পরিচালনার দায়িত্ব নিতে রাষ্ট্রীয় জাহাজের প্রত্যেক যাত্রীকেই প্রস্তুত থাকতে হয়। প্রত্যেককেই নাবিকের ভূমিকা পালনের জন্য তৈরি হতে হয়। এই তো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মহান শিক্ষা। অংশগ্রহণকারী নাগরিক (চধৎঃরপরঢ়ধহঃ ঈরঃরুবহ) হিসেবে প্রত্যেককে গড়ে উঠতে হবে। তা না হলে, এ ব্যবস্থা সার্থক হবে না। স্বাধীনতা, স্বাতন্ত্র্য অর্থপূর্ণ হবে না। মুক্তিযুদ্ধের অনলকু- থেকে প্রাণ পাওয়া বাংলাদেশের জনগণের জীবনে আসবে না পরিবর্তনের কোনো ছাপ। লাগবে না অগ্রগতির বিন্দুমাত্র ছোপ। কিন্তু এই পরিবর্তন তো আপনা-আপনি আসবে না। অনগ্রসর তৃতীয় বিশ্বে গণ-অধিকারের প্রত্যয় তো এমনিতেই আসেনি। সব ক্ষেত্রে প্রয়োজন হয়েছে একজন যুগদর্শীর। একজন জননেতার। বাংলাদেশে এই যুগদর্শী হলেন জাতীয়তাবাদী দর্শনের প্রধান সেনাপতি জিয়াউর রহমান। তারই সার্থক নেতৃত্বের পরশমণির স্পর্শ গ্রাম-বাংলার কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ে সৃষ্টি করে এই পরিবর্তনের মৃদু তরঙ্গ। নতুনভাবে জনগণকে ভাবিয়ে তোলে রাজনৈতিক ব্যবস্থায় তাদের ভূমিকা সম্পর্কে। তাদের অধিকার এবং দায়িত্ব সম্পর্কে।
এর মূল নিহিত জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক দর্শন ও অর্থনৈতিক কর্মসূচির অভ্যন্তরে। গ্রাম-বাংলাকেই তিনি চিহ্নিত করেছিলেন তাঁর মূল কর্মক্ষেত্ররূপে। সূচনা করেছিলেন শেকড়স্পর্শী উন্নয়ন কর্মকা-ের। তিনি সঠিকভাবে অনুধাবন করেন, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সনাতন জীবনব্যবস্থায় অভ্যস্ত মানুষকে নতুন পৃথিবীতে টেনে আনতে হলে শাসনব্যবস্থায় তাদের সক্রিয় অংশ নেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এ দেশের ইতিহাসে তিনিই সর্বপ্রথম গ্রামবাসীর নিজস্ব সরকার- গ্রামসরকার সৃষ্টি করেন যেখানে নিজেদের মতো করে গ্রামপর্যায়ে বিদ্যমান সমস্যা সমাধানের চেষ্টা তারা করতে পারেন। গ্রামপর্যায়ে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সর্বপ্রথম এ দেশের গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী বা ভিডিপি গড়ে তোলার ব্যবস্থা করেন। গ্রামাঞ্চলে যুবশক্তিকে বিভিন্ন অর্থপূর্ণ কাজে লাগানোর জন্য যুব-কো-অপারেটিভ কমপ্লেক্সের ব্যবস্থা করেন।
এভাবেই বাংলাদেশে সর্বপ্রথম গ্রামীণ সেচব্যবস্থা, মৎস্যসম্পদের উন্নয়ন, স্বাস্থ্য এবং বয়স্ক শিক্ষাব্যবস্থার প্রচলন ঘটে। ১৯৭৬-৭৭ সালে গৃহীত পল্লী উন্নয়ন প্রকল্প-১-এর মাধ্যমে বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলায় ৩৭ কোটি টাকা ব্যয়ের উন্নয়ন কর্মসূচি, ১৯৭৭-৭৯ সালে গৃহীত উন্নয়ন প্রকল্প-২-এর মাধ্যমে বৃহত্তর পাবনার ৭২ কোটি টাকা কর্মসূচি এবং ১৯৭৮-৭৯ সালে নোয়াখালী সমন্বিত পল্লী উন্নয়ন কর্মসূচির সাফল্য এ দেশকে স্বনির্ভর ও খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার লক্ষ্যে এবং গ্রামীণ অর্থনৈতিক অবকাঠামোর উন্নয়নে কৃষকদের মধ্যে সর্বপ্রথম তিনিই স্বল্পমেয়াদি ঋণদানের ব্যবস্থা চালু করেন। এক্ষেত্রে ১৯৭৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কৃষকদের মধ্যে স্বল্পমেয়াদি ১০০ কোটি টাকার বিশেষ ঋণ বিতরণ প্রকল্প উল্লেখযোগ্য।
শুধু প্রকল্প প্রণয়ন এবং আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থায় তার উদ্যোগকে সীমিত না রেখে পল্লী অঞ্চলের মানুষের অবস্থা সরাসরি দেখার জন্য তিনি গ্রাম থেকে গ্রামাঞ্চলে ছুটে গেছেন। কথা বলেছেন কৃষকদের সাথে, জেলে-মুটে মজুরদের সাথে। প্রত্যেকের মনে জাগ্রত করেছেন একধরনের অদম্য স্পৃহা। নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য নতুন উন্মাদনা। এমনি এক ঘটনার বিবরণ দিয়ে এ কে এম শামসুল বারী মিয়া মোহন লিখেছেন, প্রেসিডেন্ট জিয়া এক সভাশেষে ফেরার সময় হঠাৎ এক কৃষকের বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়েন। বাড়ির মহিলাকে বলেন, ‘আমাকে বসতে দিন’। মোড়ায় বসে তিনি বলেন, ‘মা আমাকে কি খেতে দেবেন?’ মহিলা তো আর তাকে চেনে না। তাই বলল, ‘কী খাবেন আপনি?’ তিনি বললেন, ‘পেঁপে খাবো।’ মহিলা বলল, ‘পেঁপে তো নেই আমাদের।’ তিনি বললেন, ‘তবে কী আছে? কলা, লেবু, ডাব?’ মহিলাটি বলল, ‘তা-ও নেই।’ ‘তবে দুধ আছে তো? তাই দিন’। জিয়া বলেন, ‘একটা ছাগল তো পালতে পারেন। আর লেবুগাছ, কলাগাছ, পেঁপেগাছ লাগানো তো সহজ। এ জন্য বেশি জায়গাও লাগে না। এসব লাগাবেন, আমি আবার আসব মেহমান হয়ে, কেমন?’ এরই মধ্যে বাড়ির মালিক এবং অন্য সব লোক এসে হাজির হলো। লোকটি বলেছিল, ‘বাবা আমি লেবুগাছ, পেঁপেগাছ, কলাগাছ লাগিয়ে, ছাগল কিনে আপনার জন্য অপেক্ষা করব।’ এভাবে জিয়াউর রহমান গ্রাম-বাংলায় সৃষ্টি করেছিলেন জাগরণের নতুন স্পন্দন। নিরক্ষরতা দূরীকরণ প্রকল্পের মাধ্যমে তিনি গ্রামীণ জনসাধারণের মধ্যে জাগিয়েছিলেন নতুনভাবে ভাগ্য গড়ার প্রত্যাশা। তিনি পরিকল্পিত পরিবার ব্যবস্থার শুভ সূচনা করে বলিষ্ঠ জীবনবোধে সংযোজন করেন নতুন অধ্যায়। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অপচয়প্রবণ এবং দুর্নীতিগ্রস্ত সমাজতন্ত্রকে পাল্টে, বেসরকারি উদ্যোগকে প্রাণবন্ত করে, বিশেষ করে শিল্পক্ষেত্রে উৎপাদন বাড়িয়ে এবং রফতানি বাড়ানোর মাধ্যমে অর্থনীতিকে নতুনভাবে ঢেলে সাজিয়ে যে দিকনির্দেশনা দান করেন আজ তা বিকশিত হয়েছে ফুলে-ফলে। কিন্তু কিভাবে তা সম্ভব হলো? কিভাবে একজন পেশাদার সৈনিক জাতি গঠনের সৈনিকে রূপান্তরিত হলেন?


এমন রূপান্তরের কারণের দিকে না তাকিয়ে শুধু ইতিহাসের পাতায় দৃষ্টি দিলেও এমন দৃষ্টান্ত মেলে অনেক। ‘ইউরোপের অসুস্থ মানুষ।’ (Sick-man of Europe) রূপে নিন্দিত, নিগৃহীত এবং পদদলিত তুরস্কের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজন হয়েছিল কামাল আতাতুর্কের; ভগ্নস্তূপ থেকে মিসরের উত্থানের জন্য প্রয়োজন হয়েছিল জামাল নাসেরের। চতুর্থ রিপাবলিকের জন্য প্রয়োজন হয়েছিল ফ্রান্সকে আলোয় টেনে আনার জন্য জেনারেল দ্য গলের। তার প্রয়োজনীয়তার কথা ফরাসি জাতি মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করে। ঘানা যে আজ বিশ্বরাজনীতির ক্ষেত্রে পরিচিত হয়েছে তার মূলে রয়েছে এন ক্রুমার অবদান। জিয়ার সাথে এসব নেতার আত্মিক সম্পর্ক। সবাই ছিলেন প্রথম শ্রেণীর দেশপ্রেমিক। সবাই ছিলেন এক নম্বরের জাতীয়তাবাদী। সবারই চিন্তাভাবনায় প্রতিফলিত হয়েছে জাতীয় সংস্কৃতির অনস্বীকার্য স্বাতন্ত্র্য, জাতীয় রাজনীতির স্বাধীনচেতা বৈশিষ্ট্য। সবারই চোখে একই আলো- ‘আমার দেশ, আমার জাতি কোনো দিন কারো কাছে মাথা নত করবে না। ভিক্ষার হাত কারো কাছে প্রসারিত করবে না।’ প্রত্যেকেই চেয়েছেন, রাজনীতি ক্ষমতার দ্বন্দ্ব অথবা সংগ্রামে পরিণত না হয়ে হোক জনকল্যাণ অর্জনের সুষ্ঠু মাধ্যম। প্রত্যেকে তাই এখনো বেঁচে রয়েছে জাতীয় চেতনায়, জাতির শ্রেষ্ঠতম সন্তানদের অন্যতম হয়ে।
কে তাদের ভুলতে পারে? কার সাধ্য ভোলে জিয়াকে? তিনি চেয়েছেন জাতিকে স্বয়ম্ভর করে গড়ে তুলতে যেন নিজেদের স্বাধীনতা ও স্বাতন্ত্র্যের মর্যাদা ভুলে গিয়ে অন্যের ওপর নির্ভর করতে না হয়। হেনরিক ইবসেনের কথা, এসব জাতীয় সৈনিক বিশ্বাস করতেন, ‘যে সংসার ঋণের ওপর নির্ভরশীল সেখানে থাকতে পারে না কোনো স্বাধীনতা, থাকে না কোনো সৌন্দর্য “There can be no freedom or beauty about a home life that depends on borrowing or debt!- A Doll’s House, Act-I’

লেখক : রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও সাবেক ভিসি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Recent Posts