আমার সৈনিক জীবনের স্মৃতি ও জিয়াউর রহমান

মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ, বীর বিক্রম

জিয়াউর রহমানের সঙ্গে আমার প্রথম কথোপকথন হয় পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে ১ম পাক ও ২য় পাক ব্যাটালিয়ন ক্যাডেটদের মধ্যে প্রীতি ফুটবল ম্যাচে। আমি ছিলাম ২য় পাকের অধিনায়ক। সাদা হাফপ্যান্ট, স্পোর্টস শার্ট, পাওয়ার সানগ্লাস পরা রেফারি টস করার জন্য হুইসেল বাজিয়ে আমাকে মধ্যমাঠে ডাকলেন। হ্যান্ডশেক করে বললেন- “আই এম মেজর জিয়া”।
এর কয়েক মাস পর ৩৯তম লং কোর্সের পাসিং আউট দেখার জন্য একাডেমির প্যারেড গ্রাউন্ডে গেলাম। প্যারেড শেষে গাড়িতে উঠব, এ সময় আমাকে ডাকলেন মেজর জিয়াউর রহমান, “বিএসইউও, কাম হিয়ার” ।
আমি সামনে গিয়ে স্যালুট করলাম। এবার পরিষ্কার বাংলায় বললেন, “শোনো, শিগগিরই তোমাদের চয়েস (পছন্দ) চাওয়া হবে আর্ম ও ইউনিট সম্পর্কে। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট বাঙালিদের ভবিষ্যৎ। তুমি ইস্ট বেঙ্গল ও ফার্স্ট ব্যাটালিয়ন তোমার চয়েস হিসেবে জানিয়ে দেবে। ওকে”? ‘রাইট স্যার।‘ দৃঢ়ভাবে জানালাম। জিয়ার বক্তব্যে অনুপ্রাণিত হলাম। প্রশিক্ষকেরা ক্যাডেটদের কাছে মূর্তিমান আতঙ্কস্বরূপ। সেখানে তিনি কাছে ডেকে বাংলায় উপদেশ দিচ্ছেন আন্তরিকভাবে, মুগ্ধ হয়ে গেলাম। স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হলাম, পাসিং আউটের পর বাঙালি সৈনিকদের নিয়ে গড়া ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টেই যোগ দেব।

  • আমাদের কোর্সে দুই শতাধিক ক্যাডেট কমিশন পেল। সম্মিলিত মেধা তালিকায় আমি দ্বিতীয় স্থান পেলাম। পাসিং আউট ক্যাডেটদের তালিকায় প্রথম তিনটি স্থান অধিকারীদের চয়েস সেনা কর্তৃপক্ষ গ্রহণ করে থাকে এ কারণেই আমি আমার পছন্দের রেজিমেন্ট ইস্টবেঙ্গলে পোস্টিং পেলাম। কমিশন প্রাপ্ত বাঙালিরা সবাই প্রথম পছন্দ হিসেবে ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট দিয়ে থাকেন কিন্তু আমাদের কোর্সে মাত্র একজন আমি এ রেজিমেন্টে যোগ দেওয়ার সুযোগ পেলাম। ট্র্যাডিশন অনুযায়ী একাডেমির প্রশিক্ষকরা নিজের রেজিমেন্টে বা কোরে পোস্টিংপ্রাপ্ত ক্যাডেটদের এবোটাবাদের রেস্টুরেন্টে নিয়ে ওয়েলকাম ডিনারে আপ্যায়ন করেন। পাসিং আউটের চার দিন আগে ক্যাপ্টেন জিয়াউদ্দিন আমাকে ডেকে বললেন “ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের তুমি একমাত্র যোগদানকারী। তোমাকে কোনো রেস্টুরেন্টে নেব না। তোমাকে অন্য জায়গায় আপ্যায়ন করা হবে। কাল বিকেলে তৈরি হয়ে থাকবে। আমি এসে তোমাকে নিয়ে যাব”। “রাইট স্যার”। জানিয়ে দিলাম। পরদিন কাকুলের এক টিলার উপর অবস্থিত বাংলো টাইপ বাড়িতে পৌঁছালাম। বেল টিপতেই দরজা খুলে দিলেন মেজর জিয়াউর রহমান, বললেন “ওয়েলকাম টু ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট, কাম ইন” । নাস্তার ট্রে নিয়ে এসে আমাদের আপ্যায়ন করলেন বেগম জিয়াউর রহমান। জিয়া আমাকে ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট সম্পর্কে ধারণা দিলেন। ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে তিনি প্রথম ইস্টবেঙ্গলে আলফা কোম্পানির কমান্ডার ছিলেন। যুদ্ধে এই ব্যাটেলিয়ন বেদিয়ান সেক্টরে শৌর্যবীর্য প্রদর্শন করে বাঙালিদের মুখ উজ্জ্বল করেছে । পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে বাঙ্গালীদের পরম আরাধ্য ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট এ কমিশন পেয়ে ১১ ডিসেম্বর ১৯৬৮ সালে যশোর সেনানিবাসে প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগদান করি। ইতিমধ্যে পাকিস্তান জাতীয় দলের ফুটবলার হিসেবে আমার পরিচয় চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। আর্মিতে আবার খেলোয়দের কদর বেশি। প্রথম ইস্ট বেঙ্গলে যোগদান করে পাকিস্তান জাতীয় দলের হয়ে ইরান, তুরস্ক, বার্মা প্রভৃতি দেশে ফুটবল খেলেছি। এরই মধ্যে চলে এলো মার্চ ১৯৭১ । ২৯ শে মার্চ বেতার মারফত নির্দেশ পেলাম (১৮ মার্চ থেকে মহেশপুরে ট্রেনিং এ ছিলাম) যশোর সেনানিবাসে ফিরে আসার জন্য। ৩০ শে মার্চ ১৯৭১ যশোর ক্যান্টনমেন্টে প্রথম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টকে নিরস্ত্র করা হলে সৈনিকরা তাৎক্ষণিক বিদ্রোহ করে। পরে আমি তাদের নেতৃত্ব গ্রহণ করি। ২০০ সৈনিক এবং ৯ জন জেসিও মাতৃভূমি স্বাধীনতার জন্য জীবন উৎসর্গ করার শপথ নেন । তাদেরকে নিয়ে ক্যান্টনমেন্টের বাইরে এসে স্থানীয় এক সাংবাদিকের কাছে শুনলাম ঢাকায় গণহত্যা চালিয়ে বহু নিরীহ মানুষকে হত্যা করেছে পাকিস্তান সেনারা। চট্টগ্রামে মেজর জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন। সারা দেশে ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং ইপিআর সৈনিকেরা বিদ্রোহ করেছে। অনির্বাচনীয় আনন্দে ভরে ওঠে মন। এতক্ষণ ধারণা ছিল দেশে একমাত্র আমরাই বিদ্রোহ করেছি। সারাদেশে বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়েছে জেনে স্বস্তিবোধ করি।

পুরো এপ্রিল মাস আমার ব্যাটেলিয়ান কৃতিত্বের সঙ্গে বেনাপোল স্থলবন্দরকে পাকিস্তানি প্রভাব মুক্ত রাখতে সক্ষম হয়। এরপর কৌশলগত কারণে আমরা পিছু হটি। জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে আমরা প্রথম ইস্ট বেঙ্গল এবং নতুন ৬০০ রিক্রুটসহ মেঘালয়ের তেলঢালাতে যাই। মেঘালয়ের তেলঢালাতে একত্রিত করা হয়েছে ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রথম, তৃতীয় ও অষ্টম ব্যাটেলিয়াদের নিয়ে গঠিত হয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম পদাতিক ব্রিগড জেড ফোর্স। কমান্ডার মেজর জিয়াউর রহমানের নামের আদ্যক্ষর দিয়েই নামকরণ করা হয়েছে এই ব্রিগেডের। জুন মাসের তৃতীয় সপ্তাহে তেলঢালায় এলেন কমান্ডার মেজার জিয়াউর রহমান। একটি ছোট টিলার উপর ব্রিগেড হেডকোয়ার্টার্স স্থাপন করা হলো। জুলাইয়ের মাঝামাঝি নবীন সৈনিকদের ট্রেনিং শেষ হলে জেড ফোর্স একটি দক্ষ সেনা দলে পরিণত হয়। কমান্ডার মেজর জিয়া প্রথম ইস্টবেঙ্গলকে কামালপুর বর্ডার আউটপোস্ট আক্রমণের নির্দেশ দেন। শেরপুর জেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম কামালপুর । এখানে বিওপিতে ঘাঁটি গেড়েছে ৩১ বালুচের একটি কোম্পানি। তাদের ডিফেন্সে রয়েছে কমক্রিটের বাঙ্কার, বিছানো হয়েছে মাইন ফিল্ড। এটি ছিল একটি শক্ত শত্রুঘাঁটি। কামানের সাহায্য ছাড়াই আক্রমণের দায়িত্ব দেওয়া হল আমার অধীনে ব্রাভো কোম্পানি এবং সালাউদ্দিনের নেতৃত্বে ডেল্টা কোম্পানিকে। ৩১ শে জুলাই এফইউপিতে অবস্থান নিয়ে আল্লাহু আকবর, জয় বাংলা ধ্বনি দিয়ে আক্রমণ চালাই। সামান্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গ্রামীণ যুবকেরা কামানের সাহায্য ছাড়াই মাইন ফিল্ড পেরিয়ে কামানের গোলাগুলির মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়ে শত্রুঘাটির কিছু অংশ দখল করেছিল। গোলন্দাজ বাহিনীর সাহায্য ছাড়া দক্ষ পেশাদার সৈনিকের পক্ষে এ ধরনের স্ট্রং পয়েন্ট দখল করা সম্ভব নয়। এই কামালপুর যুদ্ধে ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিনসহ ৩০ জন শহীদ হন এবং ৬৬ জন আহত হন। আমি নিজেও কয়েকটি স্প্রিন্টারের আঘাতে আহত হই। এক পর্যায়ে আমরা পিছিয়ে আসতে বাধ্য হই। এরপর জিয়াউর রহমানের নির্দেশে ২২শে নভেম্বর প্রথম ইস্টবেঙ্গল বৃহত্তর সিলেটের চারগ্রাম বাংলো এলাকায় আক্রমণ চালিয়ে সেটি দখল করে নেয়। শত্রু বাঙ্কারে বিপুল পরিমাণ গোলাবারুদ আমাদের দখলে আসে। চারগ্রাম দখলের পর থেকে জিয়াউর রহমান সম্মুখ যুদ্ধে আমাদের সঙ্গে থাকার সিদ্ধান্ত নিলেন। জিয়াউর রহমানই একমাত্র সেক্টর কমান্ডার যিনি সশরীরে বাংলাদেশের অভ্যন্তরের সৈন্যদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছেন। অন্য সেক্টর কমান্ডাররা ভারতে থেকে যুদ্ধ পরিচালনা করেছেন। ২৮শে নভেম্বর জকিগঞ্জের গৌরীপুরে পাক বাহিনীর ৩১পাঞ্জাব রেজিমেন্ট প্রথম ইস্টবেঙ্গল এর উপরে আক্রমণ চালায়। আমরা দৃঢ়ভাবে আক্রমণ প্রতিহত করি পাকিস্তানি সেনাদের কমান্ডার মেজর সারোয়ারসহ ৫০ জন নিহত হয় এবং ২৫ জন জীবিত অবস্থায় আমাদের হাতে বন্দি হয়। এই যুদ্ধে মেজর জিয়া এবং আমি একই ট্রেঞ্জে তিন চার ঘন্টা অবস্থান করি। এই যুদ্ধে আলফা কমান্ডার ক্যাপ্টেন মাহবুব ১০০গজ পূর্বে ট্রেন্জে কামানের গোলায় শহীদ হন। অথচ ওই কামানের গোলাটি ১০০ পশ্চিমে আমাদের ট্রেন্জে পড়লে মেজর জিয়া ও আমার জীবন বিপন্ন হতো। বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে বিভিন্ন রণাঙ্গনে পর্যদস্তু হয়ে পাকিস্তানী বাহিনী পিছিয়ে আসে। সিলেট শহর দখলের পরিকল্পনা করা হলো। এজন্য কমান্ডার জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে ১১০০ সৈনিকের বিশাল বাহিনী নিয়ে সিলেট দখলের উদ্দেশ্যে বের হই। জিয়াউর রহমানের কাছে বিশাল ম্যাপ কেস ছিল ৮ ফুট বাই ৮ ফুট। সিলেট যাত্রা পথে সেটি বিছিয়ে রাতে আমি, জিয়া ও ক্যাপ্টেন অলি শুয়ে থাকতাম। জিয়াউর রহমান, আমি ও জিয়াউদ্দিন ম্যাপে সিলেট পৌঁছানোর একটি রুট চিহ্নিত করলাম। ১৪ই ডিসেম্বর মেজর জিয়ার নেতৃত্বে সিলেট দখল করি। এই যুদ্ধে শত্রুপক্ষের ৭০ জন্ নিহত হন, আমাদের পক্ষে ২০জন সৈনিক শহীদ হন। যুদ্ধে বীরত্বের স্বাক্ষর রেখে সুবেদার ফয়েজ শহীদ হন। পরে তিনি বীর উত্তম উপাধি প্রাপ্ত হন। মাত্র ১০০০গজ পিছনে থেকে বেতার যন্ত্রের মাধ্যমে সিলেট জয়ের নেতৃত্ব দেন কমান্ডার জিয়াউর রহমান। ১৭ ডিসেম্বর সিলেট থেকে শায়েস্তাগঞ্জ পৌছাই, সেখান থেকে জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ঢাকায় ফিরি। এভাবেই আমার সৈনিক জীবনের গর্বিত শ্রেষ্ঠ সময়ের সমাপ্তি হয়।

লেখক: খ্যাতনামা ফুটবলার, সাবেক সংসদ সদস্য, সাবেক মন্ত্রী এবং ভাইস চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল

Recent Posts