দেশনায়কের কারামুক্তির দিনে গণতন্ত্রমুক্তির প্রত্যাশা

অধ্যাপক ড. আবুল হাসনতা মোহাঃ শামীম

বাংলাদেশের বোধশক্তিসম্পন্ন মানুষমাত্রই স্বীকার করবেন ইতিহাসের অন্যতম এক কালো অধ্যায়ের নাম এক এগারো। দেশী বিদেশী ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিকাশের অগ্রদূত আপোসহীন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া সহ দেশনায়ক তারেক রহমানকে তখন কারাগারে যেতে হয়েছিল। বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির পরিচালনার দায়িত্ব এই মহান নেত্রীর কাছ থেকে হাত বদলের পর পুরো বদলে যায় পরিস্থিতি। গত কয়েক  বছরে সমৃদ্ধ একটি দেশের সব সেক্টরে ব্যর্থ হওয়ার যে নষ্ট নজির প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তার মূলেও এই এক এগারো।

বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ জানেন বর্তমান যতো রাজনৈতিক সমস্যা, যত মানুষ  এখন অবধি গুম-খুন ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়েছেন তার মূলে রয়েছে এই অভিশপ্ত এক এগারো। আপোসহীন দেশনেত্রী আমাদের গণতন্ত্রের মা বেগম খালেদা জিয়া পুরো ৯০ দশক ধরে সীমাহীন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছিলেন এক অর্থে তার কবর খোঁড়া হয়েছিল ২০০৭ সালের সামরিক পৃষ্ঠপোষকতায় দাঁড়ানো সরকারের মাধ্যমে। এরপর ২০১৪ সালে করা হয় গণতন্ত্রের জানাজা। এরপর  ২০১৮ সালের ভোটার ও প্রার্থীবিহীন  মধ্যরাতের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সরাসরি দাফন করে দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে।

ইতিহাসের দীর্ঘদিনের অর্জনকে হুট করে কয়েকশত বছর পেছনে ফিরিয়ে দেওয়া এই গণতন্ত্রহীন এবং মানবাধিকারবিহীন বাংলাদেশের অসহনীয় পরিণতির শেকড়টা অনেকাংশে গ্রোথিত ঘৃণ্য এক এগারোতে। তখনকার দেশী বিদেশী ষড়যন্ত্রকারীরা জানতো বাংলাদেশের মানুষের অধিকার হরণ করতে গেলে, তাদের স্বপ্নের গণতন্ত্রকে ধ্বংস করতে গেলে সবার আগে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের অতন্দ্র প্রহরী শহীদ জিয়ার আদর্শে এবং আপোসহীন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বলিষ্ট নেতৃত্বে বলীয়ান গণতান্ত্রিক শক্তিকে আটকাতে হবে। তারা শুরু থেকেই সেই অপচেষ্টা করেছে।

এক এগারোর অপশক্তি বাংলাদেশের যে কয়েক রাজনৈতিক অবকাঠামো ধ্বংসের মধ্য দিয়ে দেশটির গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রাকে প্রতিহত করেছিল তার প্রাথমিক ধাপ ছিল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এর উপর মরণকামড় বসানো। তারা শুরুতেই আপোসহীন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ও তাঁর বিশ্বস্ত অনুসারীদের টার্গেট করে। তারা বিএনপির ত্যাগী  নেতৃত্বের উপরেও চরম আঘাত হেনেছিল।  কিন্ত এই অপশক্তি জানতো শহীদ জিয়ার রক্ত কখনও বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে বেইমানি করলে তাদের ছেড়ে কথা বলবে না। এজন্য তারা সবথেকে বড় টার্গেট মনে করেছিল বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের ভবিষ্যৎ কাণ্ডারি জনাব তারেক রহমানকে। তারা বুঝতে পেরেছিল টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, রূপসা থেকে পাথুরিয়া কিংবা বেনাপোল থেকে তামাবিল বিস্তৃত ছোট্ট এই দেশটার প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে বাস করেন শহীদ জিয়া। তাঁর যোগ্য উত্তরসূরী তারেক রহমান ধীরে ধীরে ঠিক সেই জায়গাটাই নিতে যাচ্ছেন। বিশেষ করে অপশক্তির মনে কাঁপন ধরেছিল তারেক রহমানের তৃণমূল পর্যায়ের জনপ্রিয়তা এবং কর্মসূচির ধারাবাহিক সাফল্য দেখার পর।

শহীদ জিয়ার সন্তান হিসেবে সততা ও নৈতিকতার প্রশ্নে তারেক রহমানকে ঘায়েল করা অপশক্তি জন্য অতটা সহজ ছিলনা। তারপরেও তারা চূড়ান্ত নিশানা ঠিক করে ফাঁদ পাতে নানা  মিথ্যা ও কাল্পনিক অভিযোগ সামনে রাখে। তারপর নজিরবিহীন ধৃষ্টতা দেখিয়ে আটক করা হয় তাঁকে। পাকিস্তানি হানাদার কিংবা জার্মান গেস্টাপো বাহিনীর মতো বর্বরতা নিয়ে কারাবন্দি  অবস্থায় জনগণের প্রিয় এই নেতার উপর করা হয় অবর্ণনীয় নির্যাতন। ভয়াবহ নির্যাতনের ফলে শারীরিকভাবে প্রায় পঙ্গু করে দেওয়া হয়েছিল তাঁকে।

বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ খুব ভাল করেই জানেন কারাগারের নির্মম সেই  নির্যাতন আর অত্যাচারের জঘন্য ঘটনার ঘনঘটা। তিনি তখনও রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠেননি। সরাসরি রাষ্ট্রীয় কোনো দায়িত্বও পালন করতেন না। তার সবথেকে বড় অপরাধ ছিল তিনি শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এবং আপোসহীন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সন্তান। তাঁর আরও বড় অপরাধ ছিল বাংলাদেশের জনগণ তাঁকে, তার বাবা ও মাকে অনেক ভালোবাসে; দেশের জনগণ সব ধরণের রাষ্ট্রীয় সংকট থেকে উত্তরণে তাঁদের পরিবারের উপরেই আস্থা রাখতে চায়।

জনগণের ভালবাসার বিপরীতে অজনপ্রিয় ষড়যন্ত্রীদের বীভৎস জিঘাংসা ছিল চরমে। তারা অনুমান করে নিয়েছিলো যোগ্যতা, দক্ষতা ও সক্ষমতায় সবার থেকে এগিয়ে থাকা তারেক রহমানই হতে যাচ্ছেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের  আগামী দিনের কাণ্ডারি। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদে আস্থা রাখা প্রতিটি দেশপ্রেমিক বাংলাদেশীর হৃদয়ে কাঁপন ধরাতে তারা তাই  তাঁর উপর ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম নির্যাতন করেছিল। তারা চেয়েছিল যেভাবেই হোক থামিয়ে দিতে হবে তারেক রহমানকে। তাহলে তারা বাংলাদেশের মানুষের মুখ বন্ধ রাখতে পারবে। 

পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অপারেশন সার্চলাইটের মতো কায়দায় ভোরের আলো ফুটে ওঠার আগেই ২০০৭ সালের ৭ মার্চ  সে সময়কার অবৈধ সরকার বাসা থেকে তারেক রহমানকে গ্রেফতার করে। তাঁকে আটক করে নিয়ে যাওয়ার পর রিমান্ডের নামে ধারাবাহিক  নির্যাতন চলতে থাকে তাঁর উপর।  ধারাবাহিক ৫৫৪ দিন কারাবাসে থাকতে হয় তাঁকে। তৎকালীন অবৈধ সরকারের সাজানো নানা মামলা থেকে আজ্ঞাবহ আদালত তাঁকে সহজে মুক্তি দেয়নি। অবশেষে আজকের দিনে চরম অসুস্থ অবস্থায় জামিন পেয়েছিলেন তিনি।

 ২০০৮ সালের এইদিনে পিজি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মুক্তি পান বাংলাদেশের সমৃদ্ধ আগামীর স্বপ্নদ্রষ্টা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। ষড়যন্ত্রকারীদের জিঘাংসা ছিল চরমে। তারা  ২০০৭ সালের ৭ মার্চ ভোর রাতে কোনো ওয়ারেন্ট, মামলা, জিডি এমনকি সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ বাদেই গ্রেফতারের পর যে নারকীয় নির্যাতন চালিয়েছিল তারেক রহমানের উপর তার দৃষ্টান্ত বর্তমান বিশ্বে বিরল। ওদিকে তাঁকে অন্যায়ভাবে গ্রেফতারের পাশাপাশি সক্রিয় হয়েছিল প্রোপাগান্ডা মেশিন। তারা চারদিকে ছড়িয়েছে মিথ্যার ফুলঝুরি। তারপরেও তারা তারেক রহমানের জনপ্রিয়তাকে বিন্দুমাত্র কমাতে পারেনি, বিপরীতে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে তাঁর জনপ্রিয়তা।

ষড়যন্ত্রকারীদের সাফল্য একটাই তারা হত্যার ষড়যন্ত্র করে, দিনের পর দিন নির্যাতন করে যা পারেনি পরে চিকিৎসার প্রয়োজনে সেটাই করতে হয়েছে। জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন জনগণের প্রিয় নেতা তারেক রহমান। সীমাহীন শারিরীক নির্যাতনের চিহ্ন হিসেবে পুরো শরীরে তিনি বয়ে বেড়াচ্ছেন অনেকগুলো ভয়াবহ ক্ষত। তাঁকে  অনেক উপর থেকে মেঝেতে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। এমনকি আঘাতের পর আঘাত করে ভেঙে দেওয়া হয়েছিল মেরুদণ্ড।

সাজানো মামলা এক থেকে একশত কিংবা এক লক্ষাধিক হতে পারে। কিন্ত তাতে মিথ্যা মিথ্যাই থেকে যায়, কখনও সত্য হয় না। এজন্য দেশনায়ক তারেক রহমানের বিরুদ্ধে দায়ের করা সাজানো মিথ্যা মামলার বিষয়টি উল্লেখেরই প্রয়োজন বোধ করছি না। তবে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন করে যারা তারেক রহমানকে থামাতে চেয়েছিল তারা বার্তা পেয়ে গেছে দিনবদলের। সম্প্রতি বিএনপির মহাসম্মেলনে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যখন ঘোষণা দিলেন দেশনায়কের বক্তব্য রাখার ব্যাপারে তখন স্বৈরতান্ত্রিক অপশক্তি জনতার উচ্ছাস দেখে বিস্ময়ের প্রথম ধাক্কাটা খায়।

তারপর প্রিয় নেতা জনগণের উদ্দেশ্যে বলতে শুরু করলেন ‘প্রিয় বাংলাদেশ, প্রিয় বাংলাদেশের মুক্তিকামী জনতা। আসসালামু আলাইকুম…. সমগ্র বাংলাদেশ আবার জেগে উঠেছে‘। উল্লসিত জনতার উচ্ছাসে তখনই ভেসে গেছে স্বৈরতান্ত্রিক অপশক্তির ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার দিবাস্বপ্ন। তারা বুঝতে পেরেছে ‘দখলদারির দিন শেষ, তারেক রহমানের বাংলাদেশ’। তারা জানে রিমান্ডের সেই বর্বরোচিত নির্যাতন, হাসপাতালে ভর্তি থাকা সময়ের যন্ত্রণা, প্রিয় ছোট ভাই ও নানীকে হারানো, মিথ্যা মামলায় অন্যায়ভাবে মাকে কারাগারে আটকে রাখার ফলেও যাঁকে দমানো যায়নি। কারাগার ও হাসপাতালের প্রিজন সেলে এক বছর ৫ মাস ২৯ দিন কাটিয়েও যিনি তাঁর মাথা নিচু করেননি। তিনি আজ অনেক পরিণত এক জনগণের নেতায় পরিণত হয়েছেন। নিঃসন্দেহে তিনিই আগামীর রাষ্ট্রনায়ক।

বিনা কারণে গ্রেফতারের পর থেকে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত নানা মিথ্যা মামলা নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নাই। কারণ মিথ্যা মামলা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে তাঁকে হেয় করার জন্যই হয়েছিল। এখানে নতুন করে আলোচনা কিংবা তুলনামূলক বর্ণনার কিছু নাই। সংখ্যার দিক থেকে যাই হোক মিথ্যা মিথ্যাই থাকে, সত্য হয়ে যায় না। একদিকে ক্ষমতাসীন অপশক্তি মামলা মোকদ্দমায় ভর করে দমন করতে চেয়েছিল তারেক রহমানকে। বিপরীতে এখন লাখ লাখ মানুষ অপেক্ষা করে তাঁর শুধু একটি আহ্বানের।

দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থেকেও আজ বিএনপি সমাবেশ ডাকলে হয়ে যায় মহাসমাবেশ, তারা মহাসমাবেশ ডাকলে সব প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করে তা রূপ নেয় জনসমুদ্রে। দেশনায়ক তারেক রহমানের আহ্বানে বিএনপি নেতাকর্মীদের সরব উপস্থিতি যেভাবে সভা-সমাবেশগুলোতে মুক্তিকামী জনতার ঢেউ দেখেছে বাংলাদেশ, তা দেশটির ইতিহাসে বিরল। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষকে একাধারে মুক্তি এবং সমৃদ্ধির পথ দেখিয়েছিলেন শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। তাঁরই দেখানো পথে  মানুষের কল্যাণ ও উন্নয়নের স্বপ্নে গণতন্ত্রের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিয়েছেন আপোসহীন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। তাই দেশের জনগণ এখন বিশ্বাস করে তারেক রহমান যে ‘টেইক ব্যাক বাংলাদেশ’ এর আহ্বান জানিয়েছেন তা সফল হবেই ইনশাআল্লাহ এবং এর মধ্য দিয়েই পুনরুদ্ধার করা যাবে বাংলাদেশের মানুষের হারিয়ে ফেলা গণতন্ত্র ও মানবাধিকার। দেশনায়কের কারামুক্তির দিনে বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ মনে করে তাদের গণতন্ত্রমুক্তির প্রত্যাশা পূরণ হবে এই নেতার হাত ধরেই।

লেখকঃ অধ্যাপক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়।

Recent Posts