মুক্তিযুদ্ধের সূচনা: প্রথম প্রতিরোধ

লে. জে. মরহুম মীর শওকত আলী (অব.), বীর উত্তম

অষ্টম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যরা অনেকটা দিশেহারা অবস্থায় চট্টগ্রামের ষোলশহরে জমায়েত হয়েছে। সেনা দলের উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখতে এসেছেন মেজর জিয়া, কিন্তু ধারের কাছে উঁচু কোন জায়গা নেই, যেখানে দাঁড়ালে সৈন্যরা তাকে দেখতে পাবে। কিছুক্ষণের মধ্যে কয়েকজন ধরাধরি করে পাশের ভেহিকেল শেড থেকে একটি খালি ৪৫ গ্যালন ড্রাম নিয়ে এল, অস্থায়ী মঞ্চ হিসেবে কাজে লাগানোর জন্য। ড্রামের উপর দাঁড়িয়ে সৈন্যদের কাছে পরিস্থিতি সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখলেন মেজর জিয়া, বাংলাদেশকে স্বাধীন ঘোষণা করে শেষ পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাওয়ার শপথ নিলেন। চত্বরের সমবেত অন্যান্য অফিসার ও সৈন্যরাও তাকে অনুসরণ করলেন। এ পর্যায়ে জিয়ার নেতৃত্বে সৈন্যরা কালুরঘাটের দিকে যাত্রা শুরু করে। কালুরঘাট ব্রিজের কাছাকাছি আসার পর ইস্টপাকিস্তান রাইফেলস এর আরেকটি গ্রুপ আমাদের সঙ্গে যোগ দেয়। ২৬ শে মার্চ ১৯৭১ এ সকাল আটটার খানিক পরে কালুরঘাট ব্রিজে পৌঁছাই আমরা। এখানে ফুলতলী নামের এক গ্রামে হেডকোয়ার্টার স্থাপন করে সৈন্যদের বিশ্রামের সুযোগ দিলাম। কিছুক্ষণ পর সব সেনাদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিলেন জিয়া। স্বাধীনতা অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাবার শপথ নিল সবাই। পাকিস্তানের ক্ষেত্রে পাকিস্তানি আর্মিতে যেমন হয়ে থাকে তেমনি পবিত্র কোরআন ছুঁয়ে শপথ নেওয়া হয়েছিল।
২৬শে মার্চেই অপারেশন প্লান প্রণয়ন করে কালুরঘাটের ঘাটি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার ব্যবস্থা করা হলো। ক্যাপ্টেন অলিকে দেয়া হয়েছিল সমন্বয়কারীর দায়িত্ব। দুপুরের দিকে জিয়া আমাকে চট্টগ্রামের অবস্থা জানতে শহরে পাঠালেন। শহর পরিদর্শন শেষে মেজর জিয়াকে জানালাম পাকিস্তানিরা নতুনপাড়া আর বন্দর এলাকায় ঘাঁটি গেড়েছে, শহরে তাদের কেউ নেই। ২৭ শে মার্চ সকালে জিয়া মৃদুস্বরে বললেন “মীর, আমরা তো বিদ্রোহ করে টিকে গেছি কিন্তু অন্যান্য এলাকার কি অবস্থা”? “নিশ্চয়ই আমাদের মত হবে” জবাব দিলাম । খানিকক্ষণ চুপ থেকে জিয়াউর রহমান আবার বললেন, “রেডিওতে কারো কিছু বলা দরকার” । “কাছে একটা ট্রান্সমিটার আছে, ওখানে আপনি যেহেতু সিনিয়র একটা কিছু তো বলতে পারেন” বললাম আমি। তারপর কথা বলতে বলতে আমরা এগোলাম পেট্রোল পাম্প এর দিকে। এগুনোর ফাঁকে জিয়া বললেন “আমি চট্টগ্রামে গিয়ে আওয়ামী লীগ নেতাদের খোঁজ নিলে ভালো হয়”। আমি ছদ্মবেশে আরো দুজন ছাত্র সহ চট্টগ্রামে গিয়ে আওয়ামী লীগ নেতা এমআর সিদ্দিকীকে খুঁজে বের করি। আমি তাদের আমাদের কালুরঘাটে অবস্থানের কথা জানালাম এবং এও বললাম মেজর জিয়া পাঠিয়েছে আমাকে, আমরা রাজনৈতিক নেতাদের খোঁজ করছি। জনাব সিদ্দিকী আমাকে জানালেন যত তাড়াতাড়ি পারা যায় কালুরঘাট যাবেন তারা। মাঝ দুপুরে কালুরঘাটে ফেরার পর জিয়াউর রহমান জানালেন কালুরঘাট রেডিও স্টেশন থেকে আমাদের বিদ্রোহ আর বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন তিনি।

বিকেল তিনটার দিকে চট্টগ্রাম শহর থেকে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ এসে যোগ দিলেন আমাদের সঙ্গে। জিয়ার ঘোষণা তারা শুনেছিলেন; প্রথমেই যে কাজটি তারা করলেন তা হল, জিয়াকে ধমক দিয়ে একজন জানতে চাইলেন বঙ্গবন্ধু জীবিত থাকতে কেন একজন মেজর হিসেবে তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করে নিজেকে প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করলেন? গম্ভীর চেহারায় আমার দিকে তাকালেন জিয়া । পরিস্থিতি শান্ত করতে অলি সবাইকে করনীয় স্থির করতে আলোচনার আহ্বান জানালেন।

শান্ত কন্ঠে জিয়া বললেন “আপনাদের কাউকে পাওয়া যাচ্ছিল না। কারো একটা কিছু বলার প্রয়োজন ছিল, আমি বলেছি এতে কারো কোন ক্ষতি হয়নি, কোন সমস্যাও নেই”। জিয়া শান্ত কন্ঠে আরো বলেন, “রেডিও স্টেশন এখানেই, আপনারাও এখনো উপস্থিত আছেন, দয়া করে যা আপনারা ঠিক মনে করেন, বলুন” ।
অচিরেই সবাই মিলে আলোচনা শুরু করলেন । আলোচনা চলছে, হৈচৈ, চেঁচামেচি, নীরবতা। সমস্যা সবাই ঘোষক হতে ইচ্ছুক, কিন্তু নিজেকে প্রকাশ করার ঝুঁকি নিতে রাজি নন কেউ। অল্প দূর থেকে সবই শুনছিলাম আমরা, বলছিলাম না কিছুই।

আনুমানিক দু’ঘণ্টা পর আমাদের কাছে এলেন ওরা। জিয়াকে জানানো হলো, তাদের পরিবার চট্টগ্রামে আছে বিধায় এখন কিছু বলা ঠিক হবে না যাতে তারা বিপদে পড়তে পারে। তাছাড়া যেহেতু যুদ্ধ চলছে, সেহেতু সেনাবাহিনীর সদস্য হিসেবে মেজর জিয়ার স্বাধীনতা ঘোষণা করাটাই মানানসই হবে। শর্ত একটাই ঘোষণাটা শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষ থেকে হতে হবে। হাসিমুখে অলি আর আমার দিকে তাকিয়ে জিয়া বললেন, “বেশ, আপনারা যা ভাল মনে করেন”।
শেষ বিকেলে বলতে গেলে তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে ১৯৭১ এর ২৭শে মার্চ মেজর জিয়া আবার কালুরঘাট রেডিও স্টেশন থেকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা করলেন।

এই ঘোষণাটিই ৩০ শে মার্চ পর্যন্ত রেডিও স্টেশন এর দায়িত্বে নিয়োজিত লেফটেন্যান্ট শমসের মবিন বেশ কয়েকবার পাঠ করেছিলেন। ২৮ শে মার্চ সকালে আমি আর মেজর জিয়াউর রহমান অল্প সংখ্যক সৈন্যসহ কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে রওনা দেই। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল স্থানীয় জনগণকে যথাসম্ভব সংঘটিত করে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে পাকিস্তানী সৈন্যদের যে কোনরকম অবতরণ প্রতিহত করা। যদিও একটা আধুনিক সেনাবাহিনীর উচ্চাভিলাসী অবতরণ নিরস্ত্র জনগণ দিয়ে ঠেকানোর খুব একটা আশা আমাদের ছিল না, তবুও চেষ্টা চালানোর প্রয়োজন ছিল।

এতে করে এই নিশ্চয় এতোটুকু পাওয়া গিয়েছিল যে কোন অবতরণের ঘটনা ঘটলে কালুরঘাটে তার সংবাদ পৌঁছাবে। আমাদেরকে পেয়ে আনন্দিত হয়ে উঠেছিলেন কক্সবাজারের জনগণ। তারা লড়াইয়ের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে ওঠেন। যুদ্ধে যথাসাধ্য সাহায্য করতে আগ্রহী হলেও আধুনিক সেনাদলের যুদ্ধের কলাকৌশল সম্পর্কে কোন ধারণা তাদের ছিল না। আমি আর জিয়াউর রহমান ৩০ শে মার্চ পর্যন্ত কক্সবাজারে ছিলাম।

লেখক: মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার, সাবেক মন্ত্রী ও ভাইস চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল।

Recent Posts