৭ নভেম্বর: আধিপত্যবাদবিরোধী জাতীয়তাবাদী রাজনীতির অভ্যুদয়

তালুকদার মনিরুজ্জামান

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে আধিপত্যবাদবিরোধী জাতীয়তাবাদী রাজনীতির অভ্যুদয়ের সূচনা হয় ৭ নভেম্বর। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ একটি অভ্যুত্থান ঘটান। এই অভ্যুত্থানের নেতারা তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাকের সাথে আলোচনা করে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের সাথে জড়িত ১৫ জন সেনাকর্মকর্তাকে নিরাপদে ব্যাংককে পৌঁছে দেন। এ সময় ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ মেজর জেনারেল হিসেবে পদোন্নতি নিয়ে নিজেকে সেনাপ্রধান হিসেবে ঘোষণা করেন। তিনি সাবেক সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দী করেন। খন্দকার মোশতাককে প্রেসিডেন্টের পদ থেকে সরিয়ে প্রধান বিচারপতি সায়েমকে প্রেসিডেন্ট পদে বসান। খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থানের পর অল ইন্ডিয়া রেডিও এবং ভারতের সংবাদমাধ্যম এই অভ্যুত্থানের সমর্থনে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে এবং আনন্দের সাথে সমর্থন প্রকাশ করে।

৪ নভেম্বর খালেদ মোশাররফের মা এবং তার ভাই অল্প কিছুসংখ্যক মস্কোপন্থী নেতাকে সাথে নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে শেখ মুজিবের ধানমন্ডি বাসভবন পর্যন্ত মিছিল নিয়ে যায়। শিগগিরই গুজব ছড়িয়ে পড়ে খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থানের পেছনে ভারত-রাশিয়ার সমর্থন আছে। সাধারণ মানুষের মনে শঙ্কা সৃষ্টি হয়, বাংলাদেশ আবারো দিল্লি-মস্কো অক্ষে চলে যাচ্ছে। এর ফলে ঢাকায় বিস্ফোরণোন্মুখ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। ইতোমধ্যে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল বা জাসদ ও সাম্যবাদী দল ক্যান্টনমেন্টে সৈনিকদের মধ্যে ব্যাপক লিফলেট বিলি করে। এসব লিফলেটে খালেদ মোশাররফকে ভারত সরকারের বেতনভূক্ত অ্যাজেন্ট হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়। এসব লিফলেট খালেদ মোশাররফের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে সৈনিকদের উত্তেজিত করে তোলে। জাসদ ইতঃপূর্বে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার নামে সেনাবাহিনীর মধ্যে সেল গঠন করে। নভেম্বরের ৬ তারিখ রাতে এই বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্যরা খালেদ মোশাররফ ও তার সহকর্মীদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। এই বিদ্রোহের মাঝে খালেদ মোশাররফ যখন ক্যান্টনমেন্ট থেকে পলায়নের চেষ্টা করেন তখন তাকে হত্যা করা হয়। খালেদ মোশাররফের এই হত্যাকান্ডের সাথে জিয়াউর রহমানের কোনো সংশ্লিষ্টতা ছিল না, যেমন ছিল না ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের সাথে।

খালেদ মোশাররফকে হত্যা করেছে জাসদ সমর্থিত বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সৈনিকেরা, আর ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের সাথে জড়িত সেনাকর্মকর্তাদের দেশত্যাগের বন্দোবস্ত করে দিয়েছিলেন খালেদ মোশাররফ। বিদ্রোহী সৈনিকেরা এরপর জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দী অবস্থা থেকে মুক্ত করে। তারা ট্যাংক, ট্রাক, জিপে করে ক্যান্টনমেন্টের বাইওে বেরিয়ে এসে উৎসবমুখর পরিবেশের সৃষ্টি করে। তাদের সাথে সাধারণ মানুষও যোগ দেয়। শ্লোগান দেয় বাংলাদেশ জিন্দাবাদ, জেনারেল জিয়া জিন্দাবাদ, সিপাহি-জনতার বিপ্লব জিন্দাবাদ।ঢাকার রাজপথে সৈনিকদের সাথে একাকার হয়ে সাধারণ মানুষের এই উৎসবকে দেখা হয় ভারতীয় আধিপত্যবাদের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে বিজয় হিসেবে। নভেম্বরের ৭ তারিখ এই বিপ্লব সাংগঠনিক রূপ পরিগ্রহ করে। মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। সাবেক প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাক এক বেতার বক্তৃতায় এই অভূতপূর্ব সিপাহি-জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে সার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রশংসা করেন। তিনি বিচারপতি সায়েমকে অরাজনৈতিক ও নির্দলীয় প্রেসিডেন্ট হিসেবে থেকে যাওয়ার কথা বলেন।


প্রেসিডেন্ট সায়েম প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও তিন বাহিনী প্রধানকে উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেন। এভাবে সাধারণ সৈনিক এবং দেশের সাধারণ মানুষের সমর্থন নিয়ে জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আবির্ভূত হন। নেতৃত্বের গুণাবলির কারণে তিনি ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হন। যেহেতু সিপাহি-জনতার বিপ্লবে জাসদ বড় ধরনের ভূমিকা পালন করে তাই তিনি মেজর জলিল, আ স ম আবদুর রবসহ কারাবন্দী জাসদ নেতাদের মুক্তি দেন। জাসদ নেতারা তখন তাদের তথাকথিত বিপ্লবের দ্বিতীয় পর্যায়ের কথা বলতে শুরু করেন। তাদের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা জিয়ার কাছে ১২ দফা দাবি পেশ করেন। এই দাবিগুলোর মধ্যে ছিল সেনাবাহিনীর বিদ্যমান কাঠামো বদলে ফেলে শ্রেণিবিহীন সেনাবাহিনী গড়ে তোলা।

তারা সেনাকমকর্তা নিয়োগপ্রক্রিয়া বাতিল এবং ক্যাডেট কলেজ থেকে সেনাকর্মকর্তা নিয়োগ বন্ধের দাবি জানান। এসব দাবির সমর্থনে সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে জাসদের তৎপরতা ও লিফলেট বিতরণ উত্তেজনার সৃষ্টি করে। এর প্রতিক্রিয়ায় ঢাকা ও রংপুরে ৪০ জন সেনাকর্মকর্তা নিহত হন। জাসদের এ ধরনের অপতৎপরতার ফলে সেনাবাহিনী ধ্বংসের মুখে পড়ে। সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে জিয়াউর রহমান তখন বেশ কিছু কঠোর পদক্ষেপ নেন।
সিপাহি-জনতার অভ্যুত্থানের পর সেনাবাহিনীর ক্ষমতা অর্জন করা ছিল একটি অনন্য ধরনের বিপ্লব। জেনারেল জিয়াউর রহমান বন্দুকের নল ধরে ক্ষমতায় এসেছেন একথা মোটেও সত্য নয়। সেনাবাহিনী ও সর্বস্তরের জনগণের সার্বিক সমর্থনের মধ্য দিয়ে জিয়াউর রহমান ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন। এই বিপ্লবের রূপ ছিল তৃতীয় বিশ্বের অন্যান্য দেশে সেনাবাহিনীর অভ্যুত্থানের সম্পূর্ণ বিপরীত। ষড়যন্ত্র এই বিপ্লবের মূল উপাদান ছিল না। এই বিপ্লবের মূল চরিত্র ছিল জিয়াউর রহমানের প্রতি সেনাবাহিনী এবং জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন। জাসদ দাবি করে জিয়াউর রহমানকে তারাই ক্ষমতায় বসায় এবং জিয়াউর রহমান তাদের সাথে শর্ত ভঙ্গ করে। তাদের এই দাবি তাদের তথাকথিত সশস্ত্র বিপ্লবের তত্ত্বের অসারতা প্রমাণ করে। কারণ কোনো সশস্ত্র বিপ্লবী গ্রুপ ক্ষমতা গ্রহণ করে অন্য কাউকে ক্ষমতা দিয়ে দেয় এমন ঘটনা ইতিহাসে বিরল।

বিপ্লব করতে হলে জনগণের বিপুল সমর্থন দরকার। স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে এবং একজন নিষ্কলুষ সাহসী সৈনিক হিসেবে জিয়াউর রহমানের প্রতি জনগণের ও সামরিক বাহিনীর ব্যাপক সমর্থন ছিল। এই সমর্থনের কারণে জিয়াউর রহমান ৭ নভেম্বর বিপ্লবের মহানায়কে পরিণত হন, জাসদের অনুকম্পায় নয়। এই বিপ্লবের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের জনগণের আধিপত্যবিরোধী মনোভাবই শুধু প্রকাশ হয়নি, এই বিপ্লব-পরবর্তী জিয়াউর রহমানের নানা পদক্ষেপের ফলে সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলা ফিরে আসে। সেনাবাহিনী একটি পেশাদার সশস্ত্র বাহিনী হিসেবে গড়ে ওঠে। ৭ নভেম্বরের বিপ্লব শুধু দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করেনি সেনাবাহিনীর প্রাতিষ্ঠানিকতা এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে আধিপত্যবাদবিরোধী চেতনার জন্ম দেয়।

Recent Posts