শহীদ জিয়ার সাথে কিছু স্মৃতি

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আ.স.ম. হান্নান শাহ

পাকিস্তান শাসনামলে খুব অল্পসংখ্যক বাঙ্গালিই সেনাবাহিনী বা সশস্ত্র বাহিনীতে অফিসার হিসেবে যোগদানের সুযোগ পেত। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় পশ্চিম পাকিস্তানের লাহোর সীমান্তে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ভারতের আক্রমণ চূড়ান্তভাবে প্রতিহত করে। ওই যুদ্ধে ভারতীয় বাহিনীর বিপুল সংখ্যক লোক এবং সরঞ্জামাদির ক্ষয়ক্ষতি হয়। আর লাহোর সীমান্তে ভারতীয় আগ্রাসনকে দাঁত ভাঙ্গা জবাব দেয় ফার্স্ট ইষ্ট বেঙ্গল, অর্থাৎ বাঙালি সৈনিকেরা। এই ফার্স্ট ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একজন কোম্পানি কমান্ডার ছিলেন তদানীন্তন ক্যাপ্টেন জিয়াউর রহমান। তার নেতৃত্বে ওই যুদ্ধে ভারতের বহু ট্যাংক বিধ্বস্ত হয় এবং অনেক ভারতীয় সৈন্য মারা যায়। ওই যুদ্ধের সময় তদানীন্তন ক্যাপ্টেন জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে বাঙালি সৈনিকেরা একটি ভারতীয় পিটি-৭৬ ট্যাংক দখল করে নেয়। ওই ট্যাংকটি যুদ্ধের ট্রফি হিসেবে এখনো চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে রাখা আছে। এরপর ১৯৬৬ সালে মেজর জিয়াউর রহমান সস্ত্রীক পাকিস্তানের কোয়েটাতে ষ্টাফ কলেজে ট্রেনিংয়ের জন্য গেলে সেখানে তার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ঘটে।

পরবর্তীতে নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে আমরা পাকিস্তানের সেনাবাহিনীতে বিভিন্ন পদে চাকরিরত ছিলাম। ঘটনাবহুল ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ আমি পশ্চিম পাকিস্তানের শিয়ালকোট ক্যান্টনমেন্টে ৩৭ বেলুচ রেজিমেন্টে টুআইসি হিসেবে কর্মরত ছিলাম। স্বাধীন বাংলাদেশ বেতারকেন্দ্র নাম দিয়ে চট্টগ্রামের কালুরঘাট থেকে তদানীন্তন মেজর জিয়াউর রহমানের মুক্তিযুদ্ধের আহ্বানটি আমি নিজ কানে শুনেছি। জীবনের মায়া ত্যাগ করে নিশ্চিত মৃত্যুদ- জেনেও একজন বাঙালি সেনা কর্মকর্তার এ অনন্য আহ্বান শুনে আন্দোলিত হয়েছি। তার ঘোষণাটি আবার ২৭ মার্চ পুনঃপ্রচার করা হয় এবং ভারতীয় রেডিও স্টেশন আকাশবাণী আর লন্ডন থেকে বিবিসির খবরের মাধ্যমেও আমরা প্রবাসী সব বাঙালি তা শুনতে পাই। সঙ্গত কারণেই ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তান রণাঙ্গনের বিভিন্ন জায়গায় মেজর জিয়াউর রহমানের ‘জেড ফোর্স’-এর যুদ্ধের বিভিন্ন অপারেশন প্রচার মাধ্যম মারফত জানতে পারি।

যেহেতু জেনারেল জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনীতে খুবই জনপ্রিয় ছিলেন এবং সর্বস্তরের অফিসার ও সৈনিকেরা তাকে ভালোবাসতেন, তাই তারা খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে সংঘটিত সামরিক অভ্যুত্থান মেনে নেননি। ঢাকা সেনানিবাসের সৈনিকেরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে এক বিপ্লব সংঘটিত করে ফেলে ৭ নভেম্বর রাতে। তারা গৃহবন্দী জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করে এনে তাকে আবার সেনাপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার জন্য অনুরোধ জানায়। ইতিহাসের পাতায় এই স্বতঃস্ফূর্ত বিপ্লব সিপাহী জনতার বিপ্লব হিসেবে পরিচিত। দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সিপাহীদের বিপ্লবে জনগণও স্বতঃস্ফূর্তভাবে শামিল হয়েছিল। রাজপথে ট্যাঙ্ক চালনায় রত সিপাহীদের ফুল দিয়ে বরণ করে নিয়েছিল জনগণ। সিপাহী জনতার বিপ্লবের পর ঢাকাসহ বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্টে অবস্থানরত অফিসার ও সৈনিকেরাও জিয়াউর রহমানের প্রতি সমর্থন জানান। দ্রুততার সঙ্গে জেনারেল জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন এবং সফল বিপ্লবের জন্য দেশবাসী ও সশস্ত্র বাহিনীকে অভিনন্দন জানান। এরপর শুরু হয় স্বাধীনতার ঘোষক জিয়াউর রহমানের দেশ গড়ার অভিযান।

স্বাধীনতা পরবর্তীকালে তদানীন্তন আওয়ামী লীগ কুশাসন, গণহত্যা, বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের নির্যাতন, হত্যা-গুমসহ নানাভাবে সাধারণ নাগরিকদের জীবন দুর্বিষহ করে তোলে। ১৯৭৫ সালের ২৫ মার্চ দেশে একদলীয় বাকশাল শাসনব্যবস্থা কায়েম করে জনগণের সব মৌলিক অধিকার হরণ করা হয়। আওয়ামী লীগের নেতা, মন্ত্রী ও এমপিদের ক্ষমতার দাপটে বাংলাদেশের নিরুপায় মানুষ সরকারের বিরুদ্ধে কিছু একটা ব্যবস্থা নেয়ার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করছিল। ওই সময়ে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কিছু অবসরপ্রাপ্ত সামরিক এবং বেসামরিক ব্যক্তি যারা আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক বিভিন্ন সময়ে লাঞ্ছিত ও অপমানিত হয়েছিলেন, তারা মধ্যমসারির কিছু সমমনা সামরিক কর্মকর্তাকে নিয়ে একটি সফল সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে নেয়। ওই ঘনটায় তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবর রহমান ও তার পরিবারের অধিকাংশ সদস্য নিহত হন। অভ্যুত্থানে পর আওয়ামী লীগেরই অন্যতম শীর্ষ নেতা খন্দকার মোশতাক আহমদের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের এমপি সাহেবরা সরকার গঠন করেন।

খন্দকার মোশতাকের সরকার ১৯৭৫ সালের সেপ্টেম্বরে সেনাবাহিনীর জ্যেষ্ঠতার তালিকায় থাকা জিয়াউর রহমানকে সেনাপ্রধান পদে নিয়োগ দেন। জেনারেল শফিউল্লাহর চাকরি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করেন। তখন সেনাবাহিনীর ভেতরে এবং প্রশাসনে উৎকণ্ঠা ও গুজবের রাজত্ব কায়েম ছিল। মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান সেনাপ্রধান হয়েই বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্টে অফিসার ও সৈনিকদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সেনাবাহিনীতে চেইন অব কমান্ড পুনঃস্থাপনের জন্য সচেষ্ট হন। আমরা অনেকেই তখন সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে তার বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীতে ঘাপটি মেরে থাকা একটি মহলের সামরিক অভ্যুত্থান করার সম্ভাবনার কথা তাকে অবহিত করি। কিন্তু সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান তাতে মোটেও কর্ণপাত করেননি।

১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর ভোর রাতে ঢাকা সেনানিবাসে ৬ নম্বর শহীদ মইনুল হোসেন রোডের বাসায় তাকে পরিবারসহ গৃহবন্দি করা হয় এবং ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ তার কিছু অনুগত অফিসারকে নিয়ে একটি সামরিক অভ্যুত্থান করেন। এই অভ্যুত্থান করে খালেদ মোশাররফ প্রথমে খন্দকার মোশতাকসহ বেশ ক’জন মন্ত্রীকে গৃহবন্দি করে ফেলেন। কিন্তু যেসব সামরিক কর্মকর্তা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট অভ্যুত্থানে অংশ নিয়েছিল, তাদের নিরাপদে সপরিবারে দেশ ত্যাগের ব্যবস্থা করে দেন।

কিন্তু যেহেতু জেনারেল জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনীতে খুবই জনপ্রিয় ছিলেন এবং সর্বস্তরের অফিসার ও সৈনিকেরা তাকে ভালোবাসতেন, তাই তারা খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে সংঘটিত সামরিক অভ্যুত্থান মেনে নেননি। ঢাকা সেনানিবাসের সৈনিকেরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে এক বিপ্লব সংঘটিত করে ফেলে ৭ নভেম্বর রাতে। তারা গৃহবন্দী জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করে এনে তাকে আবার সেনাপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার জন্য অনুরোধ জানায়। ইতিহাসের পাতায় এই স্বতঃস্ফূর্ত বিপ্লব সিপাহী জনতার বিপ্লব হিসেবে পরিচিত। দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সিপাহীদের বিপ্লবে জনগণও স্বতঃস্ফূর্তভাবে শামিল হয়েছিল। রাজপথে ট্যাঙ্ক চালনায় রত সিপাহীদের ফুল দিয়ে বরণ করে নিয়েছিল জনগণ। সিপাহী জনতার বিপ্লবের পর ঢাকাসহ বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্টে অবস্থানরত অফিসার ও সৈনিকেরাও জিয়াউর রহমানের প্রতি সমর্থন জানান। দ্রুততার সঙ্গে জেনারেল জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন এবং সফল বিপ্লবের জন্য দেশবাসী ও সশস্ত্র বাহিনীকে অভিনন্দন জানান। এরপর শুরু হয় স্বাধীনতার ঘোষক জিয়াউর রহমানের দেশ গড়ার অভিযান।

১৯৭৬ সালে গণভোটের মাধ্যমে জেনারেল জিয়াউর রহমান দেশ শাসনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল ১৯৭৫ সালের নভেম্বর মাস থেকে জিয়াউর রহমানের অধীনে একজন বিশ্বস্ত অফিসার হিসেবে কাজ করার। তার নির্দেশনা অনুযায়ী বগুড়া ক্যান্টনমেন্টে ট্যাংক রেজিমেন্ট বিদ্রোহ দমন করা, ভারতে অবস্থানরত কাদের সিদ্দিকীর সশস্ত্র অনুপ্রবেশকারীদের ঠেকানো, জাসদের গণবাহিনীকে মোকাবিলা করার মূল দায়িত্ব পালন করতে সক্ষম হয়েছিলাম আমি। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের নিজস্ব সিলেকশনে আমি প্রথম বাংলাদেশী অফিসার হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফোর্ট ইলেভেন ওয়ার্থে কমান্ড অ্যান্ড জেনারেল ষ্টাফ কলেজে উচ্চতর সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য যাই এবং সেখানে সফলতার সঙ্গে প্রশিক্ষণ শেষ করে ডিষ্টিংগুইশড অফিসার হিসেবে সনদপ্রাপ্ত (প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার কর্তৃক প্রদত্ত) হই।

১৯৭৮ সালের অক্টোবর মাসে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান আমাকে বিশেষ পরিস্থিতির কারণে চট্টগ্রামের ২০৩ বিগ্রেডের ব্রিগেড কমান্ডার হিসেবে নিয়োগ দেন। সেখানে পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি এলাকার দায়িত্ব দেয়া হয় আমাকে। তারই দূরদর্শিতার কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে ছিন্নমূল মানুষদের জন্য আবাসন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়, যেটির মূল দায়িত্ব পালন করেছিল আমার নেতৃত্বাধীন ২০৩ বিগ্রেড। শান্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে অপারেশন চালানো সময় শান্তিবাহিনী প্রধান সন্তু লারমা আমার সৈনিকদের হাতে বন্দি হন। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের নির্দেশে পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তখন প্রাথমিক আলোচনা শুরু করা হয়। পরে খাগড়াছড়ি রেস্ট হাউসে সন্তু লারমাসহ কয়েকজন শান্তিবাহিনী নেতার সঙ্গে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মুখোমুখি আলোচনার আয়োজন করি আমি। পার্বত্য নেতারা ওই আলোচনায় আশ্বস্ত হয়ে ওই এলাকায় শান্তি প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন। জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে পার্বত্য এলাকায় যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়। বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে পার্বত্য এলাকার জনগণকে জাতীয় জীবনে সম্পৃক্ত হবার গুরুত্ব অনুধাবনের সুযোগ করে দেয়া হয়। শিক্ষার সুযোগের মাধ্যমে অপরাপর জাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে সামঞ্জস্য গড়ে তুলে তাদের দেশ গড়ার কাজে অঙ্গীভূত করা হয়।

কিন্তু অদৃষ্টের নির্মম পরিহাস, ১৯৮১ সালের ৩০ মে কিছু উচ্চাভিলাষী সেনা কর্মকর্তা চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে মহান স্বাধীনতার ঘোষক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে গুলি করে হত্যা করে। ওই সময় আমি চট্টগ্রামের ভাটিয়ারিতে বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমীর কমান্ড্যান্ট হিসেবে কর্মরত ছিলাম। হত্যার পর বিদ্রোহীরা আমাকে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে বিদ্রোহী জেনারেল আবুল মঞ্জুরের সামনে উপস্থিত করেন। সেখানে আমাকে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মৃত্যু সম্পর্কে নিশ্চিত করে বলা হয় এবং ঢাকা ও চট্টগ্রামের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করে ওই বিদ্রোহ নিরসনের একটি শান্তিপূর্ণ পন্থা বের করার জন্য চাপ দেয়া হয়। বিদ্রোহীদের অস্ত্রের মুখে আমি ঢাকায় যোগাযোগ করতে বাধ্য হই এবং তদানীন্তন সিজিএস জেনারেল নুরুদ্দিন খানের সঙ্গে যোগাযোগ করি। আমরা লক্ষ্য করছিলাম, রাষ্ট্রপতি জিয়া হত্যার সংবাদে সাধারণ সৈনিক ও অফিসারদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হচ্ছিল এবং তারা বিদ্রোহীদের কাছ থেকে নিজেদের সরিয়ে নেয়ার চিন্তা করছিল। তাই বাংলাদেশ সরকারের দেয়া প্রথম আহ্বানেই সৈনিকরা দলে দলে ফেনীর কাছে শোভাপুর ব্রিজ পার হয়ে বিদ্রোহীদের পক্ষ ত্যাগ করতে থাকে। অবস্থা বেগতিক দেখে জেনারেল মঞ্জুর তার পরিবারসহ কিছু বিদ্রোহী অফিসারকে নিয়ে মোটরগাড়িতে চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট থেকে নাজিরহাট-ফটিকছড়ি হয়ে ভারতে পালানোর চেষ্টা করে। পথিমধ্যে রাষ্ট্রপতি জিয়ার প্রতি অনুগত সৈনিকদের একটি দলের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে বিদ্রোহী লে. কর্নেল মাহবুব ও মতি নিহত হন। পরে জেনারেল মঞ্জুর এবং অন্যরা রাস্তা পরিবর্তন করে ভারতে পালানো চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। এদিকে ওই এলাকায় আমি সবচেয়ে সিনিয়র অফিসার হওয়ার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করি এবং প্রথমেই জিয়াউর রহমান ও অন্য নিহতদের কোথায় দাফন করা হয়েছে, সেটা জানার চেষ্টা করি। একজন সৈনিকের কাছ থেকে তথ্য পেয়ে আমি জিয়াউর রহমানের এডিসি ক্যাপ্টেন মাজহার এবং আরও কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে রাঙ্গুনিয়ার একটি মাজারের পাশে ছোট পাহাড়ের টিলার কাছে বহু খোঁজাখুঁজির পর কবরের সন্ধান পাই। স্থানীয় ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছাত্র এবং সেনাবাহিনীর সহযোগীতায় সেখান থেকে খুড়ে জিয়াউর রহমান, লে. কর্নেল আহসান ও ক্যাপ্টেন হাফিজের মৃতদেহ একটি গর্ত থেকে উদ্ধার করি। জিয়াউর রহমানের লাশ পরিস্কার করে একটি ষ্ট্রেচারে রেখে চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টের উদ্দেশ্যে রওনা হই। আমাকে পূর্ণাঙ্গ সহযোগীতা করেন লে. কর্নেল আব্দুল খালেক (সিইও ২৮ ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট)। আর বেসামরিক ব্যক্তিদের মধ্যে আব্দুল্লাহ আল নোমানও (বিএনপির বর্তমান ভাইস চেয়ারম্যান) সবিশেষ সহযোগীতা করেন। আমি জিয়াউর রহমানের এ লাশ প্রাপ্তির খবর সেনা হেডকোয়াটার্স, কমিশনার, ডিসি এবং ডিআইজি চট্টগ্রামকে অবহিত করি। আমি জিয়াউর রহমানের লাশ নিয়ে সোজা ক্যান্টনমেন্টে যাই। সেখানে তার দেহ থেকে সব গুলি বের করা হয়। পোষ্টমর্টেম করা হয় এবং একজন মুসলমান হিসেবে গোসল করিয়ে বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টারে করে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হই। আবহাওয়া খারাপ হওয়ায় ফের চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে ফিরে যাই। সেখানে বিএনপি’র তৎকালীন মহাসচিব অধ্যাপক ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীসহ অন্য নেতাদের দেখতে পাই, যারা রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সঙ্গে চট্টগ্রাম সফরে গিয়েছিলেন। তাদের অনুরোধে একটি বিমানে জিয়াউর রহমানের লাশসহ অন্য নেতাদের নিয়ে বিমানবাহিনীর পাহারায় ঢাকায় পৌঁছি। ঢাকা বিমানবন্দরে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি আবদুস সাত্তারের কাছে শহীদ জিয়ার লাশ বুঝিয়ে দিই।

রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের লাশ উদ্ধার এবং জাতির কাছে তা যথাযথভাবে ফেরত দিতে পারাকে আমি আমার সামরিক চাকরিজীবনের একটি বড় সফলতা বলে মনে করি। এই স্মৃতি যেমন আমাকে দুঃখ ভারাক্রান্ত করে, তেমনি ত্রান্তিকালে যথাযথ ভূমিকা পালনের সুযোগ পেয়েছিলাম বলে গর্ববোধও করি।

Recent Posts