মুক্তিযুদ্ধ ও একজন জিয়া

ড. এম মুজিবুর রহমান

এক.
বিজয় দিবসের তাৎপর্য ও নৃতাত্তি¡ক বিশ্লেষণের পূর্বে ১৯৭১ সালে ১৬ ডিসেম্বরের বিজয় দিবসের প্রাক্কালে ঘটে যাওয়া ঘটনাবলির ঘটনা প্রবাহ আলোচনা না করার বিকল্প কোথায়? ৭১ সালের ২৫ মার্চ দিবাগত রাত থেকে দীর্ঘ ৯ মাস পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ চলে তুমুল। এ যুদ্ধে এদেশের লক্ষ লক্ষ লোক প্রাণ হারায়। লক্ষ লক্ষ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে আসে বিজয়। ডিসেম্বরে পাকিস্তানিরা ঢাকায় অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে।বাংলাদেশের জনগণের প্রতিটি ক্রান্তিলগ্নে অসীম সাহসিকতার সঙ্গে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন, ৬৪ হাজার বর্গমাইলের সীমানার ভেতর থেকেই জনগণকে সঙ্গে নিয়ে লড়াই করেছেন। ছিনিয়ে এনেছেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা।
জিয়াউর রহমানই ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম প্রেসিডেন্ট ও স্বাধীনতার ঘোষক। কিন্তু এই সত্য মানতে নারাজ আওয়ামী লীগ ও তার দলদাস বুদ্ধিজীবী। এদের ইতিহাস রচনাকারীদের কেউ কেউ আবার করাচি কিংবা কলকাতা ফেরত বুদ্ধিজীবী অথবা হানাদারদের মুরগি সাপ্লাইকারী মুক্তিযোদ্ধাদের গোত্রভুক্ত যারা নিজেদের পাপ ঢাকতে পোপের চেয়েও বড় ক্যাথলিক। মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে হাফেজ হাকিম আজিজুল হকের পয়গাম পত্রিকার হকার কিংবা মুক্তিযুদ্ধের সময় টাঙ্গাইলে পাকিস্তান সরকারের কর্মচারীদের ভাই-ভাতিজাদের পাপ মোচনের উদ্দেশ্যমূলক ইতিহাস রচনার প্রভাব বলয়ের বাইরে এসে ও কিছু মানুষের কলমে কিছু ইতিহাস উঠে এসেছে।
ইতিহাস নিয়ে নানা সময়ে নানা আলোচনা ও বিতর্কও সৃষ্টি করেছেন অনেক রাজনৈতিক নেতা। তবে এসব আলোচনা বা বিতর্ক থেকে অনেক অজানা তথ্যও বেরিয়ে আসে যা নতুন করে ইতিহাস রচনায় সহায়ক হয়।
বিশিষ্ট সাংবাদিক, কলামিস্ট, মাহফুজ উল্লাহ-এর ভাষায়, ইতিহাস স্থবির কোনো বিষয় নয় এবং এ কারণেই নতুন নতুন তথ্যের ফলে ইতিহাস সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে যায়। যেমন, ১৯০০ সালের আগ পর্যন্ত ট্রয়ের যুদ্ধ ছিল কল্পকাহিনী। চীনের পোড়ামাটির তৈরি সেনাবাহিনী অথবা মাচুপিচুর ব্যাপারগুলোই ছিল অজানা। ঐতিহাসিক ঘটনাবলী সম্পর্কে নতুন নতুন ব্যাখ্যা ইতিহাসের পুরনো দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রতিনিয়ত চ্যালেঞ্জ করে। ঐতিহাসিক পদ্ধতি অনুসরণ করে ইতিহাসবিদ জানার চেষ্টা করেন কোন প্রমাণ বাস্তব ও সঠিক, না একপেশে। এই মূল্যায়নের পর ইতিহাসবিদ তার বর্ণনার জন্য কিছু প্রমাণ ব্যবহার করেন, অন্যগুলো বাদ দেন। এ থেকে যা বেরিয়ে আসে তার মধ্যে ইতিহাসবিদের মূল্যায়ন, দৃষ্টিভঙ্গি, সিদ্ধান্ত ও ভ্রান্তির প্রতিফলন ঘটে। এ কারণেই ইতিহাস মানসিকও বটে।
ইতিহাসের সত্য অনুসন্ধানে বিখ্যাত উপন্যাস লেখক ও প্রবন্ধকার জর্জ অরওয়েলের লেখা থেকে দুটি উদ্ধৃতি দেয়া যায়। প্রথম উদ্ধৃতি : ‘হু কন্ট্রোলস দ্য পাস্ট, কন্ট্রোলস দ্য ফিউচার, হু কন্ট্রোলস দ্য প্রেজেন্ট, কন্ট্রোলস দ্য পাস্ট।’ যার বাংলা ভাবার্থ : যিনি বর্তমানকে নিয়ন্ত্রণ করেন, তিনি অতীতকেও নিয়ন্ত্রণ করেন; যিনি অতীতকে নিয়ন্ত্রণ করেন তিনিই ভবিষ্যৎকে নিয়ন্ত্রণ করেন। দ্বিতীয় উদ্ধৃতি : ‘দ্য মোস্ট ইফেক্টিভ ওয়ে টু ডেসট্রয় পিপল ইজ টু ডিনাই অ্যান্ড অবলিটারেট দেয়ার ওউন আন্ডারস্ট্যান্ডিং অব দেয়ার হিস্টোরি।’ এর বাংলা ভাবার্থ : একটি জনগোষ্ঠীকে ধ্বংস করার জন্য সবচেয়ে কার্যকর পন্থাটি হলো সেই জনগোষ্ঠীকে তাদের নিজেদের মতো করে নিজেদের ইতিহাস বোঝা ও মূল্যায়ন করার সুযোগ না দেওয়া। কথা দুটি বাংলাদেশ নামক স্বাধীন-সার্বভৌম (?) দেশের অভ্যন্তরে বসবাসকারী পুরো জনগোষ্ঠীর জন্য যেমন সার্বিকভাবে প্রযোজ্য, তেমনি জনগোষ্ঠীর বিবিধ খÐের জন্যও বিভিন্ন আঙ্গিকে প্রযোজ্য।
ইতিহাসের কোনো বিষয় মীমাংসীত হয় না। আর আদালত দিয়ে তো ইতিহাস লেখার প্রশ্নই উঠেনা। কিন্তু তা করা হচ্ছে, সব সম্ভবের দেশ বাংলাদেশে। ইতিহাস হচ্ছে সত্যের জন্য অনুসন্ধান। কেউ কেউ হয়তো এর বিরোধিতা করবেন; কিন্তু মনে রাখা প্রয়োজন, ইতিহাসে যা ঘটেছে তা না জানলে পৃথিবী সম্পর্কে আমরা অজ্ঞ থেকে যাব। চ‚ড়ান্ত সত্য একটি কঠিন পণ্য এবং বিভিন্নভাবে একে খুঁজে বের করতে হয়। ইতিহাসে যা লেখা হয়েছে তার সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে সচেতন থাকলেই ইতিহাসকে নির্মোহভাবে বোঝা সহজ হয়। এভাবে দেখলেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা সম্পর্কে যে বিতর্ক চলছে, তাকে উপলব্ধি করা যাবে এবং তথ্যের বিনিময়ে সত্যকে খুঁজে বের করা সহজ হবে।
বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান বাংলাদেশের প্রথম প্রেসিডেন্ট ও স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে যে বক্তব্য দিয়েছেন তা নিয়ে দেশে-বিদেশে আলোচনার ঝড় বইছে। ঐতিহাসিক দালিলিক প্রমাণের ভিত্তিতে তিনি বলেছেন, জিয়াউর রহমানই হচ্ছেন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি ও মহান স্বাধীনতার ঘোষক। আর এ নিয়েই শাসক দল আওয়ামী লীগে তোলপাড় চলছে। আওয়ামী লীগের স্থানীয় পর্যায়ের নেতা থেকে শুরু করে শীর্ষ পর্যায়ের নেতারাও এ নিয়ে কথা বলছেন, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করছেন, এমনকি সংসদও সরব হয়েছে তারেক রহমানের বক্তব্য নিয়ে। বাংলাদেশে ভোটার বিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে অবৈধভাবে ঘোষিত সংসদ সদস্যরা নানা ভাষায় কটাক্ষ করেছেন তারেক রহমান ও তাঁর পিতা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে।
বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের এই তথ্যের সত্যতা বিচার হবে ইতিহাসের আলোকে। যেসব বক্তব্যে তারেক রহমান দলিল প্রমাণের ভিত্তিতে এই তথ্যটি উপস্থাপন করেছেন, সেখানে তিনি স্পষ্টভাবেই বলেছেন এর বিপরীতে কোনো দলিল প্রমাণ থাকলে সেটি উপস্থাপন করার জন্য। অথচ দেখা গেল, দলিল প্রমাণ নয়, লাঠি হাতে মাঠে নামিয়ে দেয়া হলো যুবলীগকে। ব্যাংক ডাকাতি কিংবা টেন্ডারবাজির ইতিহাস হলে সেখানে যুবলীগের লাঠিসোঁটা মানায়। কিন্তু তারেক রহমান উপস্থাপন করেছেন ঐতিহাসিক তথ্য। এখানে যুবলীগের কিছু করার নেই। নারী নির্যাতন, বৈশাখী মেলায় বস্ত্রহরণ, হল দখল, গোরস্থান দখল, ব্যাংক ডাকাতি, লুটতরাজ, টেন্ডারবাজি আর জঙ্গিবাদ এসব হলো যুবলীগের ইতিহাস। অপ্রিয় হলেও সত্য, যুবলীগের এই লাঠি বাহিনীর কারণেই প্রকৃত ও সত্য ইতিহাস নিয়ে স্বাধীনতার ৪৪ বছর পরও প্রশ্ন তুলতে হয়। তারেক রহমানের বক্তব্যের পর আওয়ামী লীগ ও ক্ষমতাসীন সরকারের এমন কিছু লোক কোনো প্রকার যুক্তিবুদ্ধি ছাড়াই যুবলীগের লাঠিয়াল বাাহনীর সর্দার হিসেবে মাঠে নেমেছেন যাদের অতীত প্রশ্নবিদ্ধ। শেখ মুজিবুর রহমানের এককালের কঠিন শত্রæ যারা তাঁর চামড়া দিয়ে ডুগডুগি বানাতে চেয়েছিলেন, আওয়ামী লীগের সভাপতিমÐলীর সদস্য শেখ সেলিমও স¤প্রতি যাদেরকে শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার ক্ষেত্র প্রস্তুতকারী হিসেবে স্বীকার করেছেন সেই ইনু-মতিয়ারা এখন শেখ হাসিনার চেয়েও শেখ মুজিবুর রহমানের বড় ভক্ত। এরা ইতিহাসের সত্য প্রমাণের পরিবর্তে হুমকি-ধমকি শুরু করেছেন। আসলে যারাই স্বাধীনতার পর থেকে ইতিহাস লেখায় মনোনিবেশ করেছেন, তাদের কাউকে কাউকে সর্বদা তাড়িয়ে বেড়িয়েছে যুবলীগের লাঠি। আর মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ না করেও যারা এতোদিন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ফেরি করে বেড়িয়েছিল তাদের হয়েছে গাত্রদাহ।
দেশনায়ক তারেক রহমানের ঐতিহাসিক তথ্য উপস্থাপনের পর এর সাথে নতুন করে যুক্ত হয়েছে ‘তাজউদ্দীন আহমদ: নেতা ও পিতা’ বইটি। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক তাজউদ্দীন আহমদের কন্যা শারমিন আহমদ লিখেছেন বইটি। বইটি মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে নতুন প্রজন্মকে অনেক অজানা তথ্য দেবে সন্দেহ নেই। তবে এই বইটিও অনেকের আলোচনার খোরাক জোগাবে।
বইটিতে শারমিন আহমদ লিখেছেন, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করলে পাকিস্তান সরকার দেশদ্রোহিতার অভিযোগে বিচার করতে পারে এমন আশঙ্কায় শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করেননি।
তিনি লিখেছেন, পূর্ব-পরিকল্পনা অনুযায়ী আব্বু স্বাধীনতার ঘোষণা লিখে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে গিয়েছিলেন এবং টেপ রেকর্ডারও নিয়ে গিয়েছিলেন। টেপে বিবৃতি দিতে বা স্বাধীনতার ঘোষণায় স্বাক্ষর প্রদানে মুজিব কাকু অস্বীকৃতি জানান। কথা ছিল যে, মুজিব কাকুর স্বাক্ষরকৃত স্বাধীনতার ঘোষণা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে (পরে শেরাটন, বর্তমানে রূপসীবাংলা) অবস্থিত বিদেশি সাংবাদিকদের কাছে পৌঁছে দেয়া হবে এবং তাঁরা গিয়ে স্বাধীনতাযুদ্ধ পরিচালনা করবেন। শারমিনের তথ্য অনুযায়ী শেখ মুজিব তাতে স্বাক্ষর করেননি। বরং বলেছিলেন, বাড়ি গিয়ে নাকে তেল দিয়ে ঘুমিয়ে থাকো, পরশু দিন (২৭ মার্চ) হরতাল ডেকেছি।
শারমিন আহমদ আরও উল্লেখ করেছেন, মুজিব কাকুর তাৎক্ষণিক এই উক্তিতে (বাড়ি গিয়ে নাকে তেল দিয়ে ঘুমিয়ে থাকো) আব্বু বিস্ময় ও বেদনায় বিমূঢ় হয়ে পড়লেন। এদিকে বেগম মুজিব ওই শোবার ঘরেই সুটকেসে মুজিব কাকুর জামাকাপড় ভাঁজ করে রাখতে শুরু করলেন। পাকিস্তানি সেনার হাতে মুজিব কাকুর স্বেচ্ছাবন্দি হওয়ার এই সব প্রস্তুতি দেখার পরও আব্বু হাল না ছেড়ে প্রায় এক ঘণ্টা ধরে বিভিন্ন ঐতিহাসিক উদাহরণ টেনে মুজিব কাকুকে বোঝাবার চেষ্টা করলেন। তিনি বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের উদাহরণ তুলে ধরলেন, যাঁরা আত্মগোপন করে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন। কিন্তু মুজিব কাকু তাঁর এই সিদ্ধান্তে অনড় হয়ে রইলেন। আব্বু বললেন যে, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মূল লক্ষ্য হলো- পূর্ব বাংলাকে সম্পূর্ণ রূপেই নেতৃত্বশূন্য করে দেওয়া। এই অবস্থায় মুজিব কাকুর ধরা দেয়ার অর্থ হলো আত্মহত্যার শামিল।
মুজিব কাকু বললেন, ‘তোমরা যা করবার কর। আমি কোথাও যাবো না।’ তাজউদ্দীন কন্যার তথ্য অনুযায়ী স্বাধীনতার ঘোষণা সম্পর্কে শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘এটা আমার বিরুদ্ধে দলিল হয়ে থাকবে। এর জন্য পাকিস্তানিরা আমাকে দেশদ্রোহের জন্য বিচার করতে পারবে।’
শারমিন আহমদ আরও লিখেছেন, ভারতে যাওয়ার পথে পদ্মার তীরবর্তী গ্রাম আগারগাঁয়ে শুকুর মিয়া নামের আওয়ামী লীগের এক কর্মীর বাড়িতে তারা আশ্রয় নেন। সেখানে তারা শুনতে পান মেজর জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণা। তিনি বলেন, ২৭ মার্চ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে স¤প্রচারিত এই ঘোষণাটি আব্বুসহ সামরিক ও বেসামরিক সকল বাঙালিকে অনুপ্রাণিত করে। বইটিতে মুজিব বাহিনীর এক নেতা তাজউদ্দীন আহমদকে হত্যারও চেষ্টা চালান বলে লিখেছেন শারমিন।
তারেক রহমানের বক্তব্য নিয়ে যখন তোলপাড় ঠিক তখনই ‘তাজউদ্দীন আহমদ: নেতা ও পিতা’ বইটি আরও একটি আলোচনার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। বইটি নিয়ে চুলচেড়া বিশ্লেষণ করবেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। বিশেষ করে স্বাধীনতার ঘোষণায় স্বাক্ষর করেননি শেখ মুজিব এই তথ্যটি নিঃসন্দেহে স্বাধীনতার সত্য ইতিহাস অনুসন্ধানে ভ‚মিকা রাখবে।
তবে আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক তাজউদ্দীন আহমদের অভিজ্ঞতা থেকে লেখা বইটি সম্পর্কে এখন পর্যন্ত কোনো সদুত্তর দিতে পারে নাই। আওয়ামী লীগের এই নীরবতা থেকে কি প্রমাণ হয় না তারেক রহমানের তথ্য নির্ভর বক্তব্য সঠিক?
দুই.
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমাদের প্রিয় মাতৃভ‚মি স্বাধীন হলেও দেশীয় অপশক্তি, আধিপত্যবাদী ও স¤প্রসারণবাদী পরাশক্তির ষড়যন্ত্র আমাদেরকে নতজানু করার প্রয়াস বন্ধ হয়নি। মাঝে মধ্যে এসব অপশক্তি আমাদের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বকে ¤øান করে দিতে চায় এরকম এক ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে ৭ নভেম্বর অভ‚তপূর্ব সিপাহী জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে জাতীয়তাবদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে অপশক্তিকে পরাস্ত করা সম্ভব হয়েছিল।
প্রকৃতিক সম্পদ আর ভ‚-রাজনীতিক কারণে বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান আমাদের দেশ মাতৃকা নিয়ে ষড়যন্ত্রের মূল কারণ। আঞ্চলিক পরাশক্তি তাদের তাঁবেদার রাজনৈতিক গোষ্ঠীর মাধ্যমে বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে পিছনের দিকে ঘোরাবার জন্য মরিয়া। বাংলাদেশের গার্মেন্টসশিল্প, ছোট ও মাঝারী অন্যান্য শিল্প কারখানা উন্নত বিশ্বে তাদের পণ্য রফতানির মাধ্যমে বিশ্ববাজারে, প্রতিযোগিতায় যাতে টিকতে না পারে তার জন্য হরহামেশা চলছে নানা ষড়যন্ত্র। আর এ ষড়যন্ত্রের ছক সাজানো হয় দূরে বসে আর বাস্তবায়ন হয় দেশীয় তাবেদারদের মাধ্যমে।
আমাদের স্বার্বভৌমত্বের প্রতীক সশস্ত্র বাহিনী ও সাধারণ জনতার জাতীয় ঐক্য ও স্বাধীনচেতা মানুষের মিলিত সংগ্রাম আমাদের জাতি হিসেবে মাথা উঁচু করে বেচে থাকার প্রেরণার পাশাপাশি শক্তি ও সাহস জোগায় ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার। ৭ নভেম্বর সিপাহী-জনতার বিপ্লবের মধ্য দিয়ে দেশের রাজনীতিতে চালু হয় বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবক্তা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রীয় মৌলিক নীতিমালাগুলো।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে যে সরকার গঠিত হয় তা খুবই দ্রæত জনপ্রিয়তা হারাতে থাকে। সকল অপশাসন, দুর্নীতি আর পরিবারকেন্দ্রীক শাসনের বিরুদ্ধে যখন দেশের জনগণ ফুসতে থাকে তখন গঠন করা হয় রক্ষীবাহিনী। হাজার হাজার বিরোধী মতের নেতা-কর্মীদের ওপর চলে নির্মম অমানবিক জুলুম নির্যাতন আর গুম-খুন। প্রশাসনের ছত্রছায়ায় গুম-খুন নিত্যদিনের ঘটনায় পরিণত হয়। এমনকি জেলের মধ্যেও রাজনৈতিক নেতা হত্যা করা হয় এবং পরে মস্তকবিহীন লাশ পড়ে থাকতে দেখা যায় নদীর পাড়ে কিংবা মাঠে ময়দানে। তৎকালীন আওয়ামী সরকারের জনপ্রিয়তা যখন শূন্যের কোঠায় নেমে আসে তখন গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে একদলীয় বাকশালী শাসন ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়। শুধু কি তাই, সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে শেখ মুজিবুর রহমানসহ সকল সংসদ সদস্যকে পরবর্তী পাঁচ বছরের নির্বাচিত ঘোষণা করা হয়। দলীয়করণ, পরিবারতন্ত্র আর আত্মীয়করণের মাধ্যমে দেশে অন্ধকার যুগের সূচনা করা হয়। দেশবাসী দেখতে পায় রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আলামত, কেড়ে নেয়া হয় মানুষের মৌলিক অধিকারের সব ব্যবস্থা। কটি পত্রিকা ছাড়া অন্যসব পত্রিকা বন্ধ করা হয়।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রবীণ নেতা খন্দকার মোশতাক আহমদের নেতৃত্বে নতুন সরকার গঠিত হয়। তৎকালীন সেনাবাহিনী প্রধান বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতা মেজর জেনারেল শফিউল্লাহ, বিমান বাহিনী প্রধান এ কে খন্দকার সেই সরকারের প্রতি পূর্ণ আনুগত্য প্রকাশ করেন। সেই সরকারের শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন আজকের আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনার অন্যতম উপদেষ্টা এইচটি ইমাম। এভাবেই শেখ মুজিবুর রহমানের একদলীয় বাকশালী শাসনব্যবস্থার অবসান ঘটে। আজকের আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনার শাসন আবারও সেখ মুজিবের রক্ষী বাহিনীর শাসনের কথা স্বরণ করিয়া দেয়। আওয়ামী লীগের অপশাসন থেকে তাদের কর্মীরাও আজ নিরাপদ নয়। বাংলাদেশকে একটা শশ্মানে পরিণত করছে বর্তমান শাসকগোষ্ঠী।
অপরদিকে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে ১৯৮১ সালের ৩০ মে পর্যন্ত তিনি রাষ্ট্র পরিচালনার কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করেন। তার এই শাসনকালে মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রীয় জীবনে কতগুলো মৌলিক নীতিমালা পরিবর্তিত হয়: ১. জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে রাষ্ট্র পরিচালিত হবে। ২. বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতা ৩. সংবাদ পরিবেশনের পূর্ণ স্বাধীনতা। ৪. বিভেদের রাজনীতি পরিহার ও পরিত্যাগ করে জাতীয় ঐক্য অর্থাৎ বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ, অর্থনীতিতে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের পরিবর্তে ব্যক্তি উদ্যোগকে সহযোগিতা প্রদান, পররষ্ট্রনীতিতে সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও আশ্রিত রাষ্ট্রে পরিণত না হওয়া, বিশেষ করে মুসলিম দেশ ও তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর সঙ্গে নিবিড় বন্ধুত্ব প্রতিষ্ঠা করা সর্বোপরি রাজনীতি ও প্রশাসনকে দুর্নীতিমুক্ত করা জাতীয় নিরপত্তার প্রশ্নের শক্তিশালী সেনাবাহিনী গঠন করা।
শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের উন্নয়নের রাজনীতি বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া ঘোষিত নতুন ধারার প্রগতিশীল রাজনীতির অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান কর্মসূচিভিত্তিক রাজনীতির পাশাপাশি মানুষের চাহিদাকে সামনে রেখে তৃণমূল পর্যায় থেকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনার শুভ সূচনা করেছিলেন। শিক্ষা-স্বাস্থ্য সচেতনার যে ধারার যাত্রা শুরু হয়েছিল তাকে অব্যাহত গতিতে চলতে দেয়া হয়নি ষড়যন্ত্রমূলকভাবে। এই ষড়যন্ত্র দেশ ও জাতির বিরুদ্ধে। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশর ইতিহাসে এই জাতীয় ষড়যন্ত্র বার বার হয়েছে। প্রতিবারই এই ষড়যন্ত্রকারীরা দেশের সচেতন মানুষের কাছে পরাজিত হয়েছে। সর্বত্র রাজনৈতিক মেরুকরণ, দুর্নীতি, লুটপাট বাংলাদেশকে আজ সার্বিকভাবে পিছিয়ে দিচ্ছে, আন্তর্জাতিক পরিসরে দেশটির ভাবমূর্তি নি¤œগামী। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরোনের পথ হচ্ছে সৎ, দেশপ্রেমিক নেতৃত্ব পুনপ্রতিষ্ঠা করা।
শহীদ জিয়ার শাহাদাৎবার্ষিকীতে আজকের প্রত্যাশা তাঁর আদর্শে উজ্জিবিত হয়ে দেশ মাতৃকার বিরুদ্ধে বর্তমান আওয়ামী বাকশালী সরকারের সকল ষড়যন্ত্র ঐক্যবদ্ধভাবে রুখে দাঁড়াতে হবে আর গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে দেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার পিরিয়ে আনার দৃঢ় অঙ্গীকার নিতে হবে।
লেখক : ড. এম মুজিবুর রহমান, গবেষক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সাবেক সহকারী অধ্যাপক
শাহজালাল (রহ.) বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট

Recent Posts