মুক্তিযুদ্ধের সূচনা : প্রথম প্রতিরোধ

লে.জে. মীর শওকত আলী (অব.), বীর উত্তম

অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেনারা অনেকটা দিশেহারা অবস্থায় ষোলশহরে জমায়েত হয়েছে। সেনাদলের উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখতে এসেছেন মেজর জিয়া, কিন্তু ধারে কাছে উঁচু কোনো জায়গা নেই, যেখানে দাঁড়ালে সৈন্যরা তাঁকে দেখতে পাবে। কিছুক্ষণের মধ্যে কয়েকজন ধরাধরি করে পাশের ভেহিকল শেড থেকে একটা খালি ৪৫ গ্যালন ড্রাম নিয়ে এল, অস্থায়ী মঞ্চ হিসেবে কাজে লাগানোর জন্য। ড্রামের ওপর দাঁড়িয়ে সৈন্যদের কাছে পরিস্থিতি সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখলেন মেজর জিয়া, বাংলাদেশকে স্বাধীন ঘোষণা করে শেষ পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাবার শপথ নিলেন। চত্বরে সমবেত অন্যান্য অফিসার ও সৈন্যরাও তাঁকে অনুসরণ করলেন। সুনির্দিষ্ট কিছু নির্দেশ দিলেন জিয়া, যেমন :
ক. আমরা কালুরঘাটে চলে যাব এবং নদীর ওপারে একটা নিরাপদ ঘাঁটি স্থাপনের মাধ্যমে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাব।
খ. চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মূল সড়কের তুলনায় নিরাপদ রেলসড়ক বরাবর অগ্রসর হব।
গ. প্রত্যেকে যার যার সাধ্যমতো অস্ত্র ও গোলাবারুদ বহন করব।
ঘ. সুবেদার মোতালেবের নেতৃত্বে একটা রিয়ব-পার্টি অবশিষ্ট ভারি অস্ত্রশস্ত্র একজোড়া তিনটনি বাহনে করে বয়ে নিয়ে কালুরঘাটে আমাদের সঙ্গে মিলিত হবে।
এ পর্যায়ে সৈন্যদের মোটামুটি এরকম নির্দেশনাই দেয়া হয়েছিল, আমরা এলাকা ত্যাগ করে যাবার তাড়ায় ছিলাম তখন। এমন বিশৃঙ্খল একটা অবস্থায় পাকিস্তানিদের কোনো রকম আক্রমণ চালালে সর্বনাশ হয়ে যেত। ভোর তিনটা নাগাদ অবশেষে ষোলশহর ছেড়ে যাই আমরা। আমার মনে হচ্ছিল, আর আমাদের পিছু হটার উপায় নেইÑ দেশ হয় স্বাধীনতা লাভ করবে আর নয়তো আমাদের সবাইকে অনিবার্যভাবে ফায়ারিং স্কোয়াডের মুখোমুখি হতে হবে।
কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরে রেললাইনের জোড়া ইস্পাত ট্রাক বরাবর এগিয়ে যাচ্ছিল গোটা ব্যাটালিয়ন, কালুরঘাট ব্রিজের উদ্দেশ্যে। সবাই নীরব। পরিস্থিতি নিয়ে যার যার ভাবনায় ডুবে আছে প্রত্যেকে।
কী হতে যাচ্ছে?
আমরা কী করব?
কী পরিণতি হবে আমাদের পরিবারের?
কী আছে ভবিষ্যতের দিনগুলোয়?
পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে কিভাবে লড়ব আমরা?
কেউ কেউ ছেলেবেলা থেকে শুরু করে আজকের দিনের কথা ভাবতে গিয়ে নস্টালজিক হয়ে পড়েছে। মোটামুটি এরকমই ছিল তখন সবার মনের অবস্থা। সকাল ৮টার দিকেও এত ঘন হয়ে কুয়াশা পড়ছিল যে ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ গজের বেশি দূরের কিছু দেখা যাচ্ছিল না। ব্যাপারটা ছিল শাপে-বরের মতো, আবার খানিকটা উদ্বেগেরও বটে। আশীর্বাদ এ কারণে যে, পাকিস্তানি বিমানবাহিনীর পক্ষে আমাদের ক্ষতি করা সম্ভব ছিল না; আবার উদ্বেগের কারণ যে কোনো সময় বা কারও হামলার মুখে পড়ার আশঙ্কা ছিল ওই অবস্থায়। সামনে কি আছে দেখতে না পেলে সৈনিকের মনে বিপদের সঙ্কেত বেজে ওঠে।
আমার বাম হাঁটুতে তীব্র যন্ত্রণা হচ্ছিল, হাড়ের পুরনো অসুখ ছিল বলে ইনজেকশনের মাধ্যমে বাম হাঁটু থেকে ফ্লুইড অপসারণ করার প্রয়োজন হয়েছিল, এক্স-রে রিপোর্টে হাড়ের অবাঞ্ছিত বৃদ্ধি ধরা পড়েছিল। যন্ত্রণা তীব্র হয়ে ওঠায় জিয়াকে এগিয়ে যেতে বললাম, আমি পরে তাঁর সঙ্গে যোগ দেব; আমার জন্য গোটা ইউনিটের দেরি হোক, চাইনি। ‘তোমাকে এখানে একা রেখে যাওয়া আমার পক্ষে অসম্ভবÑ বললেন জিয়া। পাশেই ছিলেন ক্যাপ্টেন অলি, তিনি বললেন, দরকার হলে তোমাকে আমরা বয়ে নিয়ে যাব’।
আমাকে একা রেখে না যাবার ব্যাপারে ওরা যখন দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। আমি তখন ব্যথা সহ্য করেই আবার অগ্রসর হলাম।
কালুরঘাট ব্রিজের কাছাকাছি আসার পর সহসা বিস্ময়করভাবে ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর)-এর একটা কলামের দেখা পেয়ে খুশি হয়ে উঠলাম আমরা। কাপ্তাই রোডের দিক থেকে আসছিল কলামটা। ওটা ছিল ক্যাপ্টেন হারুন নামে এক বাঙালি অফিসারের নেতৃত্বাধীন ইপিআরে সপ্তদশ ইউংয়ের একটা কোম্পানি। আমাদের সঙ্গে মিলিত হয়ে হারুন জানাল, তার অধিকাংশ সেনা বর্ডার আউট পোস্টে দায়িত্ব পালনরত ছিল। আগেই বার্তা পাঠিয়ে গত রাতে তাদের একত্রিত করা হয়েছে। সে আরও জানাল, রেলওয়ে হিল-এ ক্যাপ্টেন রফিকের সঙ্গে যোগ দেয়ার জন্য সেনা দল নিয়ে চট্টগ্রামের রেলওয়ে হিলে যাচ্ছেন। তখন অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে ওখানে যাওয়াটা ঝুঁকিপূর্ণ সে কথা উল্লেখ করে হারুনকে আমাদের সঙ্গে যোগ দেয়ার আহŸান জানালেন জিয়া। হারুন আর তার বাহিনী সানন্দ্যে যোগ দিল আমাদের সঙ্গে।
সকাল ৮টার খানিক পর অবশেষে ব্রিজে পৌঁছলাম আমরা। তারিখটা ছিল ২৬ মার্চ। ব্রিজ পেরিয়ে বোয়ালতলি নামে গাছে ছাওয়া একটা জায়গায় পৌঁছলাম এবং ফুলতলি নামের এক গ্রামে হেড কোয়ার্টার স্থাপন করে লোকজনকে বিশ্রামের সুযোগ দিলাম। অফিসাররা একসঙ্গেই বসলাম। ক্যাপ্টেন অলির নিজস্ব এলাকা এটা। লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন তিনি। ধীরে ধীরে কিছু মুরব্বি স্থানীয় লোকসহ গ্রামবাসীরা আমাদের আশপাশে জমায়েত হলো। কয়েকজন মুরুব্বির সঙ্গে আলাপ করলেন জিয়া। পরিস্থিতি সম্পর্কে তাদের অবহিত করলেন। অলিও করণীয় সম্পর্কে নিজের বক্তব্য রাখলেন। অচিরেই সংগ্রাম কমিটির কয়েকজন নেতা উপস্থিত হয়ে আমাদের খাবারের ব্যবস্থা করার সুসংবাদ দিলেন, খুশি হলাম আমরা।
সত্যি বলতে কি, মুক্তিযুদ্ধকালীন গোটা সময়টায় সম্ভাব্য সব রকম উপায়ে আমাদের চমৎকারভাবে সাহায্য করেছিলেন তারা। কিছুক্ষণ পর সব সেনার উদ্দেশ্যে ভাষণ দিলেন জিয়া। স্বাধীনতা অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাবার শপথ নিল সবাই। পাকিস্তানের ক্ষেত্রে পাকিস্তানি আর্মিতে যেমন হয়ে থাকে, তেমিন পবিত্র কোরআন ছুঁয়ে শপথ নেয়া হয়েছিল।
অপারেশন প্ল্যান প্রণয়ন করে বাস্তবায়ন শুরু হয়েছিল এরপর। সঙ্কট মুহূর্তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি ছিল বিদ্রোহী সেনাদলের মনোবল চাঙা করা। কর্মব্যস্ত থাকলেও প্রফুল্ল থাকে সৈন্যরা। অপারেশনাল প্ল্যান কার্যকর হতেই সবাই কালুরঘাটের ঘাঁটি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। চট্টগ্রাম এলাকার অন্যত্রও পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা ব্যুহ তৈরিতে লিপ্ত হল অন্যরা। এ পর্যায়ে অষ্টম ইষ্ট বেঙ্গল বা তার অবশিষ্টাংশের দায়িত্ব বণ্টিত হল এভাবে :
ক. আমার সঙ্গের একটি কোম্পানি বন্দর এলাকা পাহারায় নিয়োজিত থাকবে।
খ. ক্যাপ্টেন সাদেকের অধীনে একটি কোম্পানি কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থেকে আগত সম্ভাব্য রিইনফোর্সমেন্ট প্রতিহত করতে সীতাকুÐে যাবে।
গ. লেপটেন্যান্ট শমসের মবিনের নেতৃত্বে এক কোম্পানি সৈন্য চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ এলাকায় প্রতিরক্ষার দায়িত্ব নেবে।
ঘ. লেফটেন্যান্ট খালেকুজ্জামানের নেতৃত্বে এক কোম্পানি কালুরঘাট ঘাঁটিতে অবস্থান করে বেতার কেন্দ্রটি রক্ষা করবে।
ঙ. ইপিআরের একটি কোম্পানি ইতিমধ্যে ইষ্ট পাকিস্তান রাইফেলসের আওতাধীন কোর্ট বিল্ডিং এলাকা দখল করে অবস্থান গ্রহণ করবে।
চ. ক্যাপ্টেন হারুনের নেতৃত্বে ইপিআরের একটি কোম্পানি চট্টগ্রাম কলেজ এলাকায় অবস্থান নেবে।
ছ. বিভিন্ন ট্রপ থেকে বাছাই করে লোক নিয়ে কালুরঘাটে অবস্থান নেয়ার জন্য একটা রিজার্ভ বাহিনী গড়ে তোলা হল। লেফটেন্যান্ট ্এওয়াই এম মাহফুজুর রহমানকে ওটার নেতৃত্ব দেয়া হল।
মোটামুটি এরকমই ছিল পরিকল্পনা। এবং ২৬ মার্চ ১৯৭১-এই তা কার্যকর করা হয়। ক্যাপ্টেন অলিকে দেয়া হয়েছি। সমন্বয়কারীর দায়িত্ব। দুপুরের দিকে জিয়া আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, চট্টগ্রামের অবস্থা জানতে আমি শহরে যেতে পারব কিনা। বললাম কোন সমস্যা নেই; তারপর দুজন সৈন্্যসহ একখানা জিপ নিয়ে শহরের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম। শহর এলাকায় আসার পর মনে হল চট্টগ্রাম ভ‚তুরে শহরে পরিণত হয়েছে। বেশ কয়েকটা ভস্মীভ‚ত বাড়িঘর চোখে পড়ল। রাস্তায় খুব একটা লোক চলাচল নেই। হীন মনোবল বেশ কিছু পুলিশকেও দেখলাম, উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমার দিকে বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিল তারা। কোন গাড়ি দেখা যাচ্ছিল না রাস্তায়। আশপাশে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর কাউকে দেখলাম না।
কিন্তু স্টেশন রোডের কাছাকাছি আসতেই এলএমজির গোলাবর্ষণের আওয়াজ কানে এল, আমাদের জিপে এসে লাগল একটা বুলেট। তবে সৌভাগ্যক্রমে কারও গায়ে লাগল না। গতি বাড়িয়ে স্টেশনে যাবার বদলে একটা গলিতে ঢুকে পড়লাম। স্থানীয় লোকজন আমাদের পাকিস্তানি সৈন্য ভেবে পালাবার উপক্রম করল। বাংলায় চিৎকার করে ডাকলাম ওদের, কয়েকজন থাকলেও আমাদের কাছে আসার সাহস পেল না। জিপের সৈন্যরা এবার চিৎকার করে নিজেদের বাঙালি বলে পরিচয় দিল; বলল, ভয়ের কোনো কারণ নেই। আমাদের সবাইকে বাংলায় কথা বলতে দেখে কয়েকজন এগিয়ে এল। ওদের কাছে জানতে পেলাম, রেলওয়ে হিল থেকেই এসেছে এলএমজির আওয়াজ, তবে পাহাড়ে অবস্থানকারীরা ইপিআরেরই সদস্য। পরে জানতে পেরেছি, রেলওয়ে হিল ক্যাপ্টেন রফিকের আওতাধীন ছিল এবং তার কয়েকজন সেনাই আমাদের উদ্দেশ্যে গুলিবর্ষণ করেছিল। যা হোক, সাবধানীর মার নেই ভেবে দ্রæত কালুরঘাটে ফিরে এলাম আমরা। মেজর জিয়াকে জানালাম, পাকিস্তানিরা নতুনপাড়া আর বন্দর এলাকায় ঘাঁপটি গেড়েছে, শহরে শত্রæবাহিনীর কেউ নেই।
সারাদিন ধরে সৈন্যদের পুনঃসংগঠন আর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা প্রস্তুতি চলল। কোনো পক্ষ থেকেই কোনো রকম আক্রমণ সূচিত হল না। হঠাৎ করেই যেন সন্ধ্যা নেমে এল। নিকষ অন্ধকার গ্রাস করে নিল কালুরঘাট এলাকা। দূরে চট্টগ্রাম শহরে আলো দেখা যাচ্ছিল, মাঝে মাঝে গুলির শব্দ কানে আসছিল আমাদের।
কক্সবাজার যাবার পথে কালুরঘাট ব্রিজ-পেরোলেই রাস্তাটা একটা ঢালের ওপর তীক্ষè বাঁক নিয়েছে। তারপর এগিয়ে গেছে সোজা পটিয়া, ডুলাহাজরা এবং কক্সবাজার হয়ে মূল ভ‚খÐের সর্ব দক্ষিণের প্রান্ত টেকনাফের দিকে। ঢালের শেষ মাথায় যেখানে রাস্তাটা আবার সোজা হয়েছে, একটা পেট্রল পাম্প আছে। পাম্পটা ইতিমধ্যে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল, অন্ধকারে ডুবে ছিল জায়গাটা। একপাশে কিছু গাছের গুঁড়ি স্ত‚পাকারে রাখা, কিছু খালি বাসও ছিল ওখানে- পলায়নপর ড্রাইভাররা ফেলে রেখে গিয়েছিল। পাম্প স্টেশনের আশপাশে গোটা কতক গাড়ি আর পিকআপও ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা ছিল। ক্রমশ রাত ঘনিয়ে এল।
রাত তখন ৮টা। একটা গুঁড়ির ওপর বসে কথা বলছিলাম আমি আর অলি। একটা বাসের ভেতরে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন জিয়া। হঠাৎ এক লোককে এগিয়ে আসতে দেখলাম আমরা; মোটামুটি দীর্ঘকর, চমৎকার চেহারা, মাথায় লম্বা চুল, বয়স মধ্য তিরিশের মথো হবে। আগন্তুক আমাদের কাছে এসে জানালেন, জিয়ার খোঁজ করছেন তিনি। মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম আমি আর অলি। কারণ ওই অবস্থায় ব্যাপারটা কেমন যেন রহস্যময় মনে হচ্ছিল। যা হোক, আমরা তার পরিচয় জানতে চাইলাম। জিজ্ঞেস করলাম, জিয়াকে তিনি চেনেন কিভাবে। কিন্তু পরিচয় বা উদ্দেশ্য জানাতে রাজি হলেন না ভদ্রলোক। জিয়ার সঙ্গে দেখা করার জন্য জোর করলেন। আমি যখন চমৎকার আমেরিকান উচ্চারণ ভঙ্গিতে আলাপরত আগন্তুককে নিয়ে ব্যস্ত ঠিক তখন ক্যাপ্টেন অলি গিয়ে জিয়াকে নবাগতের উপস্থিতির কথা জানালেন। একটু বাদেই অলি ফিরে এসে বললেন, ভদ্রলোককে বাসের বেতরে নিয়ে যেতে বলেছেন জিয়া। আগন্তুককে নিয়ে আমরা বাসে অপেক্ষারত জিয়ার কাছে এলাম। জিয়া আমাদের দু’জনকে বেরিয়ে যেতে ইশারা করলেন। আগন্তুককে আগেই তল্লাশি করা হয়েছিল, জিয়ার একখানা ফটোগ্রাফ ছাড়া আর কিছু পাওয়া যায়নি তার কাছে। তো আগন্তুকের সঙ্গে জিয়াকে একা রেখে বেরিয়ে এলাম আমরা। গাছের গুঁড়িটার ওপর বসে বাসের দিকে নজর রাখতে লাগলাম।
কিছুক্ষণ পর দীর্ঘদেহী আগন্তুকসহ বাস থেকে বেরিয়ে এলেন জিয়া। আমাদের দিকে ইশারা করে বললেন, ‘একটা গাড়ি আর দু’জন লোকসহ ওকে টেকনাফে পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করো’। একজন বেসামরিক ড্রাইভারের খোঁজ করলাম আমরা, পেয়েও গেলাম। বেশ কয়েকটা পরিত্যক্ত গাড়ি পড়ে ছিল আশপাশেই, ওগুলোরই একটা দেয়া হল দীর্ঘদেহীকে। খুশি মনে নিজের পথ ধরলেন তিনি। আগন্তুক বিদায় নেয়ার পর ব্যাপার কী, জানতে চাইলাম আমি জিয়ার কাছে। জিয়া বললেন, ‘আমাদের জন্য একটা কাজ করবে সে, এ ব্যাপারে পরে জানাব তোমাদের। এখন চল, একটু বিশ্রাম নেয়া যাক।’
বলতে গেলে সারা রাতই জেগে ছিলাম আমরা। নিজের পরিবারের কথা ভাবলাম, কি হয়েছে ওদের? একমাত্রা আল্লাহই জানেন? যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় আবার ওদের সঙ্গে মিলিত হতে পারব কিনা কে জানে? স্ত্রী আর তিন মেয়েকে কুমিল্লায় বাবা-মায়ের কাছে রেখে এসেছি, অবসর গ্রহণের পর ওখানেই সেটলড হয়েছিল বাবা। কৃষিজমি ঘেরা তিন বেডরুমের সাদামাটা একখানা বাড়ি। কুমিল্লা স্কুল ও কলেজে অধ্যায়নরত আমার তিন বোনও ছিল বাবা-মায়ের সঙ্গে। কিছু যদি হয়ে যায়, আমার গোটা পরিবার, বাবা-মা, তিন বোন, স্ত্রী-কন্যা সবাই একসঙ্গে শেষ হয়ে যাবে। আমার ছেলেটার জন্ম হয়েছিল স্বাধীনতার পর। সুবেদার মোতালেব অলি আর আমার জন্য দু’মগ ধূমায়িত চা নিয়ে আসতেই চিন্তার সুতো ছিঁড়ে গেল। নদীপাড়ে বেশ শীত শীত লাগছিল। এক মগ গরম চা খুশি মনেই নিলাম। সুবেদারকে তার সুবিবেচনার জন্য ধন্যবাদ জানালাম আমরা। জিয়ার বাসের পাশের একটা বাসেই বাকি রাতটুকু কাটিয়ে দিলাম তারপর। সকালে কোনমতে প্রকৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে নতুন দিন শুরুর প্রস্তুতি নিলাম। জেগেই ছিলেন জিয়া। জানতে চাইলেন, সব ঠিক আছে কিনা। বলার মতো তেমন কিছু ছিল না। অলি জিয়ার সঙ্গে থাকার সিদ্ধান্ত নিলেও আমি অনতিদূরের ব্রিজের দিকে যেতে মনস্থ করলাম। ব্রিজে অন্য অফিসারদের বসে থাকতে দেখলাম, শরণার্থীদের শ্রোত দেখছে ওরা। লোকজন তাদের জিনিসপত্র কাঁধে বা ঠেলাগাড়িতে কিংবা রিকশা করে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। চট্টগ্রাম শহর ছেড়ে গ্রামে চলে যাচ্ছে ওরা। মানুষের দুর্দশা চেয়ে চেয়ে দেখতে লাগলাম আমরা। আমাদের অবাক করে দিয়ে নার্সের পোশাক পরা একদল মেয়ে হাজির হল। বিধ্বস্ত রক্তাক্ত অবস্থা ওদের; বুঝতে পারলাম পাকিস্তানিরা রাতে মেডিকেল কলেজে হানা দিয়ে পুরুষ কর্মীদের হত্যা করেছে এবং মহিলাদের ধর্ষণ করার পর বিতাড়ণ করেছে। পাকিস্তানিদের হাতে লাঞ্ছিত অন্য নারীরাও ছিল, তাদের অবস্থাও ছিল বিধ্বস্ত, রক্তাক্ত। এভাবেই ২৭ মার্চ, ১৯৭১-এর সকালের মুখোমুখি হয়েছিলাম আমরা।
আনুমানিক দশটার দিকে ব্রিজে উঠে এলেন জিয়া। ওকে স্বাগত জানাতে অফিসাররা উপস্থিত ছিলেন। জুনিয়র অফিসারদের উদ্দেশ্যে হাসিমুখে জিয়া বললেন, ‘চিন্তা কর না, সব ঠিক হয়ে যাবে।’ জিয়ার সঙ্গে ব্রিজে উঠলাম আমি। রেলিংয়ের ওপর ঝুঁকে বয়ে যাওয়া জলধারা দেখছিলাম আমরা; ভাবছিলাম যার যার ভাবনা। কালুরঘাট থেকে খোলা সমুদ্র বড়জোর ৩ থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে বলে জোয়ার-ভাটার প্রভাব ওখানটায় জোরালভাবে অনুভ‚ত হয়। ব্রিজের ওপর থেকে ভাসমান কিছু পানিতে ফেললে ভাটার সময় তা সাগরের দিকে যাবে, জোয়ারের সময় আবার ফিরে আসবে ব্রিজের ঠিক নিচে। আমার মনে হয় অন্য কোনো সময় ব্যাপারটা দেখতে ভালোই লাগবে। আমি যেভাবে দেখেছি সেভাবে নয়। জোয়ার-ভাটায় একই লাশ বরাবর যাওয়া আসা করতে দেখেছি আমি, তারপর এক সময় মাছের দল খেয়ে নিয়েছে কিংবা পচে গলে গেছে।
সহসা মৃদু স্বরে কথা বলে উঠলেন জিয়া, ‘মীর, আমরা তো বিদ্রোহ করে টিকে গেছি, কিন্তু অন্যান্য এলাকার কি অবস্থা?’
‘নিশ্চয় আমাদের মতোই হবে’, জবাব দিলাম।
খানিক্ষণ চুপ করে থেকে জিয়া আবার বললেন, ‘রেডিওতে কারও কিছু বলা দরকার’।
‘কাছেই একটা ট্রান্সমিটার আছে, ওখানে আপনিই যেহেতু সিনিয়র একটা কিছু তো বলতে পারেন’, বললাম আমি।
‘কিন্তু কী বলব?’ প্রশ্ন করলেন জিয়া।
প্রশ্নটা আমাকে করা হয়নি বলে নীরব রইলাম। আসলে ওটা স্বাগত সংলাপ ছিল জিয়ার।
অন্য অফিসাদের কাছে ফিরে এলাম আমরা। লেফটেন্যান্ট মাহফুজের দিকে তাকিয়ে রসিকতার ঢঙে জিয়া বললেন, ‘ওপারে গিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করছ না কেন?’ বিভ্রান্ত বোধ করল মাহফুজ। তাকে স্বস্তি দিতে আমি বললাম, জিয়া হানাদার বাহিনীর কথা বুঝিয়েছেন। স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল মাহফুজ।
দু’জনেই হাসলাম আমরা। তারপর হাঁটতে হাঁটতে এগোলাম পেট্রল পাম্পের দিকে। ওখানকার একটা পরিত্যক্ত বাস ইতিমধ্যে আমাদের অপারেশন হেড কোয়ার্টারে পরিণত হয়েছে। এগোনোর ফাঁকে জিয়া বললেন, আমি চট্টগ্রামে গিয়ে আওয়ামী লীগ নেতাদের খোঁজ নিলে ভালো হয়। জিয়া আরো বলফলেন, কালুরঘাট থেকে পিছু হটতে হলে পরদিন কক্সবাজারে চলে যাব আমরা, স্থানীয় জনগণকে সংগঠিত করার জন্য। এরপর সেই দীর্ঘদেহীর সঙ্গে আলোচনার কথা উল্লেখ করে জিয়া বললেন, ভদ্রলোক সাহায্য জোগাড়ের প্রতিশ্রæতি দিয়ে গেছেন, কক্সবাজার গেলে তার খোঁজ পাওয়া যেতে পারে।
যুদ্ধক্ষেত্রে তথাবঞ্চিত অবস্থায় টেনশন বৃদ্ধি পায়। প্রকৃত লড়াই উপভোগ করা যায়, কারণ তখন প্রতিপক্ষের ব্যাপারে কোনো রকম অনিশ্চয়তা থাকে না, জানা থাকে সবখানে শত্রæ আছে। কিন্তু আমাদের বর্তমান অবস্থা পুরোপুরি অনিশ্চিত। শত্রæর অবস্থান আমাদের অজ্ঞাত। তার উদ্দেশ্য অজানা। এরপর কি ঘটতে যাচ্ছে তাও জানা ছিল না আমাদের। তো, চট্টগ্রাম যেতে বলার আমি খুশি হয়ে উঠলাম।
উর্দিপরে আওয়ামী লীগ নেতাদের খোঁজ করতে যাওয়াটা ঝক্কি হবে, ভাবলাম আমি, তাই ছদ্মবেশে এগোনোর সিদ্ধান্ত নিলাম। পরিত্যক্ত গাড়ির ভিড় থেকেই সহজেই একটা বেসামরিক জিপ খোঁজে নিলাম। তারপর ছদ্মবেশ গ্রহণ করলাম- লুঙ্গি আর লম্বা জোব্বা জোগাড় করা হলো। সাধারণত গ্রামের প্রবীণতারা এ ধরনের পোশাক পরে থাকে। গোঁফ কামিয়ে ফেলার নিজেকেই চিনতে কষ্ট হচ্ছি আমার। এ পর্যন্ত চমৎকার চলছিল। এরপর সঙ্গীর সন্ধান করলাম আমি, কোনো সৈনিক নয়। কারণ তাহলে মিলিটারি হাবভাবে আমার ছদ্মবেশ ফাঁস হয়ে যাবে। সৌভাগ্যক্রমে স্থানীয় দু’জন ছাত্রকে পেয়ে গেলাম। চট্টগ্রাম শহরের অলিগলি তাদের নখদর্পণে। তাছাড়া ওরা শহরের অভিজাত আবাসিক এলাকা কুলশিতে বসবাসরত ওদের পরিবারের কাছে যেতে উদগ্রীব হয়েছিল। তো, সঙ্গে নিলাম ওদের অবাক ব্যাপার, ছেলে দু’টোর নামও ছিল ‘শওকত’। আমরা তিন শওকত মিলে একটা জিপে চেপে দুপুরের আগেই শহরের পথ ধরলাম।
শহরে লোকজন বলতে নেই। দোকানপাটও বেশির ভাগ বন্ধ। মাঝে মাঝে দলবদ্ধ মানুষ হয়তো কোনো এক গলি থেকে বেরিয়ে দ্রæত আবার অন্যত্র অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। সবার চেহারায় পরিষ্কার উদ্বেগের ছাপ। অবশেষে এক লোকের দেখা মিলল। আমাদের কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতার কাছে নিয়ে যেতে পারবে বলে জানাল সে। কোন এক গলির একটা দালানে আশ্রয় নিয়ে আছেন তারা। আমরা তাকে অনুরোধ করলাম নেতাদের কাছে নিয়ে যেতে, খুশি মনে রাজি হল সে।
ড্রাইভারসহ জিপখানা এক জায়গায় রেখে আমরা তিন শওকত স্থানীয় লোকটার পেছন পেছন অলিগলি পেরিয়ে অবশেষে একটা ভগ্নদর্শন দোতলা বাড়ির সামনে এসে হাজির হলাম। লোকটি ইশারায় জানাল, এটাই সেই ভবন। আমরা দরজার দিকে পা বাড়ানোর আগেই অদৃশ্য হয়ে গেল সে। খানিকটা বেকায়দায় পড়লেও যেহেতু প্রত্যেকের সঙ্গে আগেই অদৃশ্য হয়ে গেল সে। খানিকটা বেকায়দায় পড়লেও যেহেতু প্রত্যেকের সঙ্গে একটা করে হ্যান্ডগান ছিল তাই খুব বেশি উদ্বিগ্ন বোধ করলাম না। একটু ভেবে কাঠের পাল্লায় টোকা দিলাম আমি। কিন্তু কোনো সাড়া মিলল না। খানিক পর পর টোকা দিয়ে চললাম আমরা। দীর্ঘ অপেক্ষার পর মৃদু শব্দ করে খুলে গেল দরজাটা। নিজেদের বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্য হিসেবে পরিচয় দিয়ে বললাম, আওয়ামী লগি নেতাদের সঙ্গে দেখা করতে চাই। খানিক জিজ্ঞাসাবাদ শেষে আমাদেরকে অপেক্ষা করতে বলা হলো। সশব্দে আবার বন্ধ হয়ে গেল দরজাটা। ভেতর থেকে খিড়কি আটকে দেয়া হয়েছে বলেও মনে হলো আমাদের।
একটু বাদে ভিন্ন দু’জন লোক এসে দরজা খুলল। কেবল আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো দোতলায়। বাকি দুই শওকত রয়ে গেল নিচতলায়। আমাকে একটা ছোট ঘরে এনে অপেক্ষা করতে বলা হলো। দরজাটা অবশ্য আটকে দিয়েছিল ওরা। গোটা কয়েক চেয়ার ছিল ঘরে, ওগুলোই একটা টেনে নিয়ে বসে পড়লাম। একটু আশঙ্কিত ছিলাম, অস্ত্র প্রস্তুত রেখেছিলাম তাই। লম্বা সময় নিচ্ছিল ওরা, আমি তাই উঠে দরজা কিঞ্চিৎ ফাঁক করে উঁকি দিলাম এবং বিস্ময়ের সঙ্গে দেখলাম এক লোক অন্য দু’জনের সাহায্যে রাইফেলে গুলি ঢোকানোর চেষ্টা করছে। অস্ত্রশস্ত্রের ব্যাপারে লোকটা একেবারেই অজ্ঞ ছিল সম্ভবত। শর্ট গানের মতো করে সরাসরি চেম্বারে গুলি ঢোকাতে চাইছিল সে, ফলে ঢুকছিল না ওটা। ওটা ছিল ৩০৩ ম্যাগাজিন-ফেড রাইফেল, অর্থাৎ আগে ম্যাগাজিনে বুলেট ঢুকিয়ে তারপ তা রাইফেলের ব্যারেলের চেম্বারে ঢোকাতে হয়। তা না হলে গুলি ঢোকার পথ তৈরির জন্য হয় ম্যাগাজিন খুলে ফেলতে হবে নয়তো ঢিলে করতে হবে। বিস্ময় গোপন করতে না পেরে বেরিয়ে এসে রাইফেল লোড করার কায়দা দেখিয়ে দিলাম তাকে। এ সময় প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা এম আর সিদ্দিকী বেরিয়ে এলেন একটা রুম থেকে। যোগ দিলেন আমার সঙ্গে। আমি তাকে আমাদের হাল আর কালুরঘাটে অবস্থান নেয়ার কথা জানালাম। এ-ও বললাম, মেজর জিয়া পাঠিয়েছেন আমাকে, আমরা রাজনৈতিক নেতাদের খোঁজ করছি। জনাব সিদ্দিকী রুমের অন্যান্যদের সঙ্গে আলোচনা করলেন, তারপর আমাকে জানালেন, যত তাড়াতাড়ি পারা যায় কালুরঘাটে যাবেন তারা। খুশি মনে ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে অন্য শওকতদের সঙ্গে কুলশিতে তাদের বাড়িতে ঢুঁ মারলাম। তারপর মেজর জিয়ার কাছে ফিরে গিয়ে বিস্তারিত খুলে বললাম তাঁকে। আমি জনাব সিদ্দিকীর সঙ্গে কথা বলার সময় নিচতলায় অপেক্ষারত দুই শওকত অদ্ভুত ঘটনার কথা জানাল আমাকে। বিল্ডিংয়ের সবাই নাকি আমাদের পাকিস্তানি গোয়েন্দা ভেবেছিল। এতক্ষণে বুঝলাম এত দীর্ঘ সময় কেন লেগেছিল ওদের। অবশ্য সে জন্য ওদের দোষ দেয়া যায় না, বিশেষ করে যখন এক শওকতের আদি বাড়ি ছিল আসামে আর আরেক শওকতকে দেখে মাকরানি (বেলুচিস্তানি) বলে মনে হয়। চেহারার কল্যাণে আমাকেও অবাঙালি বলে ধরে নেওয়া হয়েছিল, আমার পূর্বপুরুষদের কেউ কেউ সম্ভবত মঙ্গলয়েড নারীদের প্রতি দুর্বল ছিলেন, আমার অমন চেহারা হওয়ার সেটাই কারণ।
মাঝ দুপুরে কালুরঘাটে ফেরার পর জিয়া জানালেন, কালুরঘাট রেডিও স্টেশন থেকে আমাদের বিদ্রোহ আর বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন তিনি।
বিকাল ৩টার দিকে চট্টগ্রাম শহর থেকে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ এসে যোগ দিলেন আমাদের সঙ্গে। উর্দিপরা বাঙালি সৈন্যদের দেখে বেশ চাঙা হয়ে উঠলেন তারা। শহরের সেই দোতলা ভবনে যেমন দেখেছিলাম ঠিক তার বিপরীতে। জিয়ার ঘোষণা তারা শুনেছিলেন; প্রথমেই যে কাজটি তারা করলেন তা হলো, জিয়াকে ধমক দিয়ে একজন জানতে চাইলেন, বঙ্গবন্ধু জীবিত থাকতে কেন একজন মেজর হিসাবে তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করে নিজেকে প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করলেন? গম্ভীর চেহারায় আমার দিকে তাকালেন জিয়া। পরিস্থিতি শান্ত করতে অলি সবাইকে করণীয় স্থির করতে আলোচনার আহŸান জানালেন। আরো কিছু সময় হম্বিতম্বি করার পর শান্ত হলেন তারা। শান্ত কণ্ঠে জিয়া বললেন, ‘আপনাদের কাউকে পাওয়া যাচ্ছিল না। কারো একটা কিছু বলার প্রয়োজন ছিল, আমি বলেছি, এতে কারো কোনো ক্ষতি হয়নি, কোনো সমস্যাও নেই।’
‘আপনি সামান্য একজন মেজর, আপনার কথা কে শুনবে?’ ধমক দিলেন একজন নেতা।
‘রেডিও স্টেশন এখানেই, আপনারাও এখন উপস্থিত আছেন, দয়া করে যা আপনারা ঠিক মনে করেন, বলুন।’ আবার শান্ত কণ্ঠে জবাব দিলেন জিয়া।
‘ঠিক, ঠিক’ জবাব দিলেন নেতৃবৃন্দ।
অচিরেই সবাই মিলে আলোচনা শুরু করলেন। ইতিমধ্যে আমাদের চারপাশে ছোটখাটো একটা জটলা তৈরি হয়ে গেছে। কাছের গ্রামের এক প্রবীণ মহিলা বড় এক গøাস দুধ নিয়ে হাজির হলেন, আমরা জিয়াকে দেখিয়ে দিলাম। দুধটুকু পান করে মহিলাকে ধন্যবাদ জানালেন জিয়া।
আলোচনা চলছে, হৈচৈ, চেঁচামেচি, নীরবতা, তারপর আবার হল্লা। সমস্যা হলো সবাই ঘোষক হতে ইচ্ছুক, কিন্তু নিজেকে প্রকাশ করার ঝুঁকি নিতে রাজি নন কেউ। অল্প দূর থেকে সবই শুনছিলাম আমরা, বলছিলাম না কিছুই। আনুমানিক দু’ঘণ্টা পর আমাকের কাছে এলেন ওরা। জিয়াকে জানানো হলো, তাদের পরিবার চট্টগ্রাম আছে বিধায় এখন কিছু বলা ঠিক হবে না যাতে তারা বিপদে পড়তে পারে। তাছাড়া যেহেতু যুদ্ধ চলছে, সেহেতু সেনাবাহিনীর সদস্য হিসেবে মেজর জিয়ার স্বাধীনতা ঘোষণা করাটাই মানানসই হবে। শর্ত একটাই ঘোষণাটা বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে হতে হবে। হাসিমুখে অলি আর আমার দিকে তাকিয়ে জিয়া বললেন, ‘বেশ, আপনারা যা ভালো মনে করেন।’
শেষ বিকালে, বলতে গেলে তখন সন্ধ্যা প্রায় ঘনিয়ে এসেছে; ১৯৭১-এর ২৭ মার্চ জিয়া আবার কালুরঘাট রেডিও স্টেশন থেকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা করলেন। এই ঘোষণাটিই ৩০ মার্চ পর্যন্ত রেডিও স্টেশনের দায়িত্বে নিয়োজিত লেফটেন্যান্ট শমসের মবিন বেশ কয়েকবার পাঠ করেছিলেন।
২৮ মার্চ সকাল আমি আর জিয়া অল্প সংখ্যক সৈন্যসহ কক্সবাজারে উদ্দেশে রওনা দেই। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল স্থানীয় জনগণকে যথাসম্ভব সংগঠিত করে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে পাকিস্তানি সৈন্যদের যে কোনো রকম অবতরণ প্রতিহত করা। যদিও একটা আধুনিক সেনাবাহিনীর উচ্চাভিলাষী অবতরণ নিরস্ত্র লোকজন দিয়ে ঠেকানোর খুব একটা আশা আমাদের ছিল না, কিন্তু তবু চেষ্টা চালানোর প্রয়ৈাজন ছিল। এতে করে এই নিশ্চয়তাটুকু পাওয়া গিয়েছিল যে, কোনো অবতরণের ঘটনা ঘটলে কালুরঘাটে তার সংবাদ পৌঁছবে। কক্সবাজার যাওয়ার অন্য একটা কারণও ছিল, সেই দীর্ঘদেহী আগন্তুকের সাহায্যের ব্যবস্থা করার ব্যাপারটা। তখন আমাদের অস্ত্র-গোলাবারুদ ইত্যাদির অভাব ছিল বলে ভেতর বা বাইরের যে কোনো রকম সাহায্য আমাদের কাক্সিক্ষত ছিল।
আমাদেরকে পেয়ে আনন্দিত হয়ে উঠেছিলেন কক্সাবাজারের জনগণ। তারা লড়াইয়ের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে ওঠেন। যুদ্ধে যথাসাধ্য সাহায্য করতে আগ্রহী হলেও আধুনিক সেনাদলের যুদ্ধের কলাকৌশল সম্পর্কে কোনো ধারণা তাদের ছিল না। আমি আর জিয়া ৩০ মার্চ পর্যন্ত কক্সবাজারে ছিলাম। এরপর আমাকে কক্সবাজারের পুলিশ, ইপিআর, আনসার, মুজাহিদ, মুক্তিযোদ্ধা ও জনতাকে সংগঠিত করার দায়িত্বে রেখে জিয়া আবার কালুরঘাট ফিরে যান। ঘটনাক্রমে প্রতিশ্রæত সাহায্যে আমরা পাইনি। স্বাধীনতার পর আমাকে চট্টগ্রাম এলাকার কমান্ডারের দায়িত্বে দেয়া হয়েছিল, তখন জানতে পারি ডুলাহাজরায় দীর্ঘদেহী লোকটি ধরা পড়েন এবং প্রাণ হারান। অর্থাৎ তিনি তার উদ্দেশ্য অর্জন করতে পারেন।
কক্সবাজারের স্থানীয় কর্মকর্তারা খুবই আন্তরিক আর উৎসাহী ছিলেন। আসলে পরবর্তী দু-তিনদিনে আমরা অবতরণ প্রতিহত করার মতো একটা বাহিনী সংগঠিত করতে সক্ষম হয়েছিলাম। কক্সবাজারের ডিসি. এসপি আর সংগ্রাম কমিটির চমৎকার সহযোগিতা দিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতাও জনগণকে সংগঠিত করার ব্যাপারে সাহায্য করেছেন। ঘটনাক্রমে সার্কিট হাউজের কাছেই একটা টিলার চ‚ড়ায় আবহাওয়া রাডার ছিল, ওখানকার দায়িত্বপ্রাপ্ত ভদ্রলোক ছিলেন খুবই করিৎকর্মা। এ সময়টায় আবহাওয়ার খোঁজ নিতে রাডারকে বাতাসের দিকে তাক করার পরিবর্তে সাগরবক্ষ জরিপ করার কাজে ব্যবহার করছিলেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম নৌবহর কক্সবাজারের আশপাশে থাকার গুজব শুনে কৌত‚হলবশে কাজটি করেছিলেন তিনি। যে কোনো রকম নৌ যান রাডারে ধরা পড়ার আশ্বাস দিয়ে আমাদেরকে আগেই সাবধান করার দায়িত্ব নিয়েছিলেন ভদ্রলোক।
ইতিমধ্যে গুজব রটে গিয়েছিল যে, এক অবাঙালি অফিসার নাকি কক্সবাজারের আত্মগোপন করে আছে। বাঙালি অফিসারদের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তারা জানাল, ব্যাপারটা সত্যি। লোকটার অবস্থান সম্পর্কে জানতে চাইলাম আমি। আসলে স্থানীয় অফিসাররাই তাদের এক সহকর্মীকে লুকিয়ে রেখেছিল, কারণ লোকটা ছিল ভালো আর নিরীহ ধরনের। তার কোনো বিপদ হবে না বলে আমি তাকে দেখতে চাইলাম। আমাকে সৈকতের কাছে এক বাংলোতে নিয়ে যাওয়া হল। ওখানেই তার দেখা পেলাম। কক্সবাজারের দায়িত্ব পালনরত একজন বিহারি অফিসার। ততদিনের দাড়ি রেখে দিয়েছিল সে, তার চেহারায় আতঙ্ক আর যন্ত্রণার ছাপ ফুটেছিল। জায়নামাজে বসে কোরআন তেলাওয়াত করছিল সে। আমি ঢুকতেই কাঁপতে শুরু করল সে, এবং আরো জোরে কোরআন তেলাওয়াত করতে শুরু করল। আমি খানিকক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থাকার পর অফিসারদের বললাম, ওরা যদি তাকে নিরীহ মনে করে থাকে তাহলেফ আমার আর কিছু করার নেই। অন্যান্য এলাকা থেকে অবশ্য লুটপাটের খবর পাওয়া যাচ্ছিল।

দৈনিক যুগান্তর, ২৬ মার্চ, ২০০১ সংখ্যা থেকে সংকলিত;
লেখক : মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার, প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ ও সাবেক মন্ত্রী।

Recent Posts