জ্যোতির্ময় জিয়া এবং কালো মেঘের দল

আবদুল হাই শিকদার

এক.
এখন থেকে ৮০ বছর আগে বরিশালের কবি জীবনানন্দ দাশ লিখেছিলেন :
অদ্ভূত আঁধার এক এসেছে এ-পৃথিবীতে আজ,
যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দ্যাখে তারা;
যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেইÑ প্রীতি নেইÑ করুণার আলোড়ন নেই
পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।
যাদের গভীর আস্থা আছে আজো মানুষের প্রতিÑ
এখনো যাদের কাছে স্বাভাবিক বলে মনে হয়
মহৎ সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা
শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয়
আশ্চর্যের বিষয়, ৮০ বছর আগে লেখা এই কবিতার একটি বর্ণও পুরনো হয়নি। এখনও তা সমান প্রযোজ্য বাংলাদেশের জন্য। বিশেষ করে গত ২ বছরে আওয়ামী লীগ পরিচালিত মহাজোট সরকার যেসব কীর্তিকলাপ করেছে দেশ ও জনগণের প্রতি, বিরোধী দলের প্রতি যেসব আচার-আচরণ করেছে তা দেখে এই কবিতার কথাই ঘুরেফিরে আসে।
সত্যি তো যারা অন্ধ তারাই আজ রাষ্ট্রযন্ত্রের ঘাড়ে সওয়ার হয়ে সবচেয়ে বেশি চোখে দেখে। যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই, প্রীতি নেই, নেই মানবিকতার লেশমাত্র চিহ্ন, বাংলাদেশ যেন তাদের সুপরামর্শ ছাড় আজ অচল! যারা দেশকে, দেশের মানুষকে ভালোবাসে, ভালোবাসে দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, সম্প্রীতি, সমঝোতা, মঙ্গলবোধকে, সুস্থতা ও সৌন্দর্যকে, শান্তি ও শৃঙ্খলাকে, নীতি, নিয়ম ও নৈতিকতাকেÑশেয়াল ও শকুনের খাদ্য আজ তাদের হৃদয়। সত্যি অশুভ শক্তির দাপটে স্তব্ধ আজ বাংলাদেশের বিবেক। পেশিবাজ, অর্থবাজ ও ক্ষমতাবাজদের দখলে চলে গেছে সব কিছু। সাধারণ মানুষ নিদারুণভাবে নিপীড়িত হচ্ছে, নির্যাতিত হচ্ছে। প্রতিকারহীন শক্তির দম্ভের নিচে চাপা পড়ে বিচারের বাণী নীরবে-নিভৃতে কাঁদছে।
সত্যি ফখরুদ্দীন-মইনুদ্দিনদের অবৈধ সরকারের হাত ধরে যে আঁধার নেমে এসেছে জাতীয় জীবনে, সেই আঁধার অপসারণের বদলে আরও বেশি বেশি ঘনীভ‚ত করে তুলেছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার। তারা বাংলাদেশের জাতীয় ঐক্য ও সংহতি, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে আরও সুদৃঢ় করার বদলে দেশকে নিক্ষেপ করেছে বিভেদ, হানাহানি, হিংসা, বিদ্বেষ, ঘৃণা, প্রতিশোধ ও দুর্নীতির গহŸরে।
তাদের কাজের মূল উদ্দেশ্য দেশকে আরেকটি পলাশীতে ঠেলে দেয়া। দেশকে আর একটি বসনিয়ায় পরিণত করা। গৃহযুদ্ধ লাগিয়ে দিয়ে এদেশকে বিকৃত-বিকলাঙ্গ পরমুখাপেক্ষী করে ভারতীয় আধিপত্যবাদের পায়ের কাছে ছুঁড়ে দেয়া। জাতির আত্মপ্রতিরোধ ক্ষমতাকে বিনাশ করে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিসর্জন দিয়ে, ভারতীয় উপপতœী হয়ে থাকা। তখন হয়তো প্রেসিডেন্টের জায়গায় বসবে রাজ্যপাল, প্রধানমন্ত্রী হবেন মুখ্যমন্ত্রী, দেশ হবে রাজ্য। ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’-এর স্থান নেবেন রামরাজ্যের প্রবক্তা ‘মহাত্মা করমচাঁদ গান্ধী’। বেগম রোকেয়ার ওপর স্থান নিবেন ভগ্নি নিবেদিতা। শাকিব খানকে ধাক্কা মেরে জাঁকিয়ে বসবেন শাহরুখ খান।
আধিপত্যবাদ ও তাদের তাঁবেদারদের এই আত্মঘাতী নীলনকশা বাস্তবায়নের পথে সবচেয়ে বড় বাধা, সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধক শহীদ জিয়াউর রহমান। জিয়ার রাজনৈতিক দর্শন, উন্নয়নের রাজনীতি এবং তার ইমেজ। তারা খুব ভালো করে জানে, জিয়ার ইমেজ কালিমা মলিন করা না গেলে বাংলাদেশকে মলিন করা যাবে না। জিয়ার রাজনৈতিক দর্শনকে পরাজিত করা না গেলে বাংলাদেশকে পরাজিত করা সম্ভব নয়। জিয়ার চেতনাকে গুঁড়িয়ে না দিলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে বরবাদ করা সম্ভব নয়।
এজন্যই বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত সব ধরনের হিং¯্রতা ও ইতরতাকে একত্রিত করে, সংগঠিতভাবে জিয়া উচ্ছেদে সর্বশক্তি প্রয়োগ করেছে সরকার। জিয়ার দর্শনকে ধ্বংস করার পথে আবার সবচেয়ে প্রতিবন্ধক জিয়া পরিবার ও বিএনপি। এজন্য বেগম খালেদা জিয়াকে হেনস্তা করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে সরকার। তারেক রহমানের বিরুদ্ধে বইয়ে দেয়া হয়েছে অপপ্রচারের বন্যা। মতলবি অপ্রচারের গোয়েবলসীয় কায়দায় জাতির কান ঝালাপালা করে দেয়া হয়েছে। যদিও এখন পর্যন্ত কোনো অভিযোগই প্রমাণ করতে পারেনি। তারপরও জিয়া পরিবারের বিরুদ্ধে রাগ কমছে না।
দল হিসেবে বিএনপিকে সহ্য করতে হচ্ছে অবর্ণনীয় নির্যাতন। দলের নেতাকর্মীদের ওপর চলছে বিরামহীন অত্যাচার-নির্যাতন। ক্ষেত্রবিশেষে হত্যা করা হচ্ছে। বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে। লুট করা হচ্ছে সম্পদ। হামলা-মামলায় জেরবার লোকজন।
দুই.
চারদিকে ছড়িয়ে দেয়া এই ঘৃণা, অশ্রদ্ধা ও বিদ্বেষের নোংরা ছোবল থেকে জাতীয় নেতারাও আজ পার পাচ্ছেন না। শেরেবাংলা এখন নিদারুণভাবে উপেক্ষিত। মওলানা ভাসানীকে বলা হচ্ছে পাকিস্তানের চর। মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক এমএজি ওসমানীর নাম নেয়ারও সাহস পাচ্ছেন না কেউ। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি যে ব্যক্তিত্ব আক্রান্ত হয়েছেন তিনি শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগের নানা পর্যায়ের নেতাকর্মীরা কম করেও ৩০ লাখ বার জঘন্য ও কুৎসিত ভাষায় আক্রমণ চালিয়েছে এই মানুষটির ওপর। পাঠ্যবই, বিমানবন্দর, বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, স্টেডিয়াম, উদ্যান, শিল্প-কারখানা-যেখানেই হোক, অন্ধ-উন্মত্ত হৃদয়হীন, হিতাহিত বোধশূন্য ক্রদ্ধ দানবের মতো জিয়ার নামের ওপর চালিয়েছে হাতুড়ি, শাবল, গাইতি ও বুলডোজার।
এখন চলছে শিষ্টাচার ও সভ্যতাবর্জিত বিপুল বিশাল ভয়াল জিঘাংসা ও আক্রোশ মেশানো চোয়ালবাজি। মন্ত্রী, পাতিমন্ত্রী, সিকিমন্ত্রী সবাই তারস্বরে চিৎকার করে জিয়ার চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করছেন। এদের কেউ কেউ বলছেন, জিয়া কিসের মুক্তিযোদ্ধা, জিয়া মুক্তিযুদ্ধ করেনি, স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে তাকে বাধ্য করা হয়। তিনি ছিলেন পাকিস্তানের চর। কেউ কেউ এমনও বলছেন, জিয়া মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন কিন্তু মন থেকে মুক্তিযুদ্ধ করেননি। জিয়া স্বাধীনতাবিরোধীদের পুনর্বাসন করেছেন ইত্যাদি।
আওয়ামী লীগের এই নেতাকর্মীদের অতীত ইতিহাস কী? কোন রণাঙ্গনে যুদ্ধ করেছেন তারা? কোন মাজারের আউলিয়া তারা? কোথায় কবে কখন কীভাবে তারা মারেফত হাসিল করে অন্তদৃষ্টি লাভ করলেন, সেসব বাছ-বিচার না করে এসব অশ্রাব্য, অশ্লীল ও শিষ্টাচারবর্জিত বক্তব্যে উৎসাহিত হয়ে, তাদের ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চা, তাদের আঁচলে আশ্রয় পাওয়া রাজনৈতিক এতিমগুলো পর্যন্ত বলছেন, জিয়া ছিলেন জাতীয় বেঈমান। জিয়া ছিলেন হত্যাকারী। দেখাদেখি একদল সুবিধাভোগী, গৃহপালিত কলমবাজও যাচ্ছে তাই ভাষায় যা খুশি তা-ই লিখে বাহবা নিচ্ছে আধিপত্যবাদের।
আজকের আওয়ামী লীগের সত্যিকারের প্রতিষ্ঠাতা, স্বাধীনতার ঘোষক, বীর মুক্তিযোদ্ধা, আধুনিক স্বনির্ভর বাংলাদেশের স্থপতি, বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা, ৭ নভেম্বর সিপাহি-জনতা বিপ্লবের নায়ক, বহুদলীয় গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠাতা শহীদ জিয়া সম্পর্কে এসব কুরুচিপূর্ণ বক্তব্যÑ স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে শুনতে হবে ভাবা যায়? ভাবা না গেলেও এসব দেশবাসীকে শুনতে হচ্ছে।
রামমোহন রায় বলেছিলেন, ‘পাষÐপীড়নে’ দরকার উপযুক্ত ‘পথ্য প্রদান’। বিএনপির নেতাকর্মীদের অতিভদ্রতা কিংবা তাদের কারো কারো গায়ের চামড়া গÐার দ্বারা নির্মিত হওয়াতেই বোধ করি ক্রমাগত ছাড় দিয়ে যাচ্ছে। তাদের পাশাপাশি দেশপ্রেমিক বুদ্ধিজীবীদের বিরাট অংশ ভয়েই হোক কিংবা নোংরা পানিতে নামতে অনীহার কারণেই হোক, মাঠ ছাড়া।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং জাতীয় কবি নজরুলের বিরুদ্ধেও তাদের জীবিতকালে একদল তথাকথিত সাহিত্যসেবী বিষোদগারের বন্যা বইয়ে দিয়েছিলেন।
রবীন্দ্রনাথের নোবেল বিজয়ের পর কলকাতার সংবাদপত্রে লেখা হয়েছিল : ‘বিস্ময়ের কথা এই যে, দেখিতে দেখিতে জগতের সাহিত্য এত দরিদ্র-প্রায় দেউলিয়া হইয়া গিয়াছে যে রবীন্দ্রনাথ সর্বশ্রেষ্ঠ বলিয়া পরিগণিত হইলেন! কোন কোন সুধী এই জগৎব্যাপী কবি জরিপের সার্ভেয়ার ছিলেন, তাহা বলিতে পারি না।’… …‘ভেল্কি জগতে চিরদিন টিকে না। মানুষের অবসানের সঙ্গে সঙ্গে তাহার ভেল্কিবাজীও চিরকালের জন্য অবসানপ্রাপ্ত হয়। আমাদের বিশ্বাস রববীন্দ্রনাথের প্রভাব শুধু তাহার জীবনকাল পর্যন্ত। অতঃপর আবার বাংলা সাহিত্যে নবযুগের উদয় হইবে।’
নজরুল সম্পর্কে বলা হয়েছিল তিনি হুজুগের কবি। যুগের হুজুগ কেটে গেলে নজরুলের সাহিত্য কেউ পাঠ করবে না। বলা হয়েছিল, নজরুল হলেন প্রতিভাবান বালক। তার চিৎকার-চেঁচামেচি সাহিত্য নয়।
অতিষ্ঠ ও অস্থির হয়ে এসব বিদ্বিষ্ট নিন্দুকের বিরুদ্ধে কলম ধরেন প্রভাবকুমার মুখোপাধ্যায়। তার লেখার শিরোনাম ছিল ‘কুক্কুরের প্রতি’ :
‘চিরদিন পৃথিবীতে আছিল প্রবাদ,
কুক্কুর চিৎকার করে চন্দ্রোদয় দেখি।
আজি এ কলির শেষে অপরূপ একিÑ
কুক্কুরের মতিভ্রম বিষম প্রমাদ।

চিরদিন চন্দ্রপানে চাহিয়া চাহিয়া
এতদিনে কুক্কুর কি হইল পাগল?

ভাসিছে ‘নবীন রবি’ নভঃ উজলিয়া
তাহে কেন কুক্কুরের পরান বিকল?
নাড়িয়া লাঙ্গুল খানি ঊর্ধ্বপানে চাহি
ঘেউ ঘেউ ভেউ মরে ফুকারিয়া।

তবু তো রবির আলো ¤øান হলো নাহি,
নাহি হলো অন্ধকার জগতের হিয়া।
হে কুক্কুর ঘোষ কেন আক্রোশ নিস্ফল?
অতি ঊর্ধ্বে পৌঁছে কি কষ্ঠ ক্ষীণবল?’
নজরুল তার নিন্দুকদের প্রতি অতটা কঠোর ভাষায় না হলেও লেখেন :
‘তিনতিড়ি গাছে জোনাকী দল
চাঁদের নিন্দা করে কেবল।’
এসব সময়োচিত এবং যথোপযুক্ত জবাব পাওয়ার পর বাংলা সাহিত্যের ‘বন্যরা’ লা জবাব হয়ে গিয়েছিল। তবে তাদের ঘেউ ঘেউ কোনোদিন থামেনি। তা না থামুক। ইতিহাস কী বলে? ইতিহাস তো ওইসব নিন্দুকের জায়গা দিয়েছে ডাস্টবিনে। আর রবীন্দ্রনাথ-নজরুল স্ব-স্ব মহিমা নিয়ে জাতির মর্যাদা ও সম্মানের আকাশে আজও পতপত করে উড়ছেন। ইতিহাস তাদের নায়কের মর্যাদা দিয়েছে।
আমাদের দুর্ভাগ্য যে, আমাদের সৃষ্টিশীল ও মননশীল জগতের বাসিন্দারা প্রভাতকুমার কিংবা মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনের মতো দায়িত্বশীল নন। নইলে রাজনীতির পাটাতন ছেড়ে এই ‘অদ্ভুত অন্ধকারের’ জীবরা এতদিনে পলায়ন করত।
তিন.
এসব লোকজনের জিয়া-বিদ্বেষের কারণ আমরা আলোচনা করেছি। দেখার বিষয় এরা কারা? মরহুম শেখ মুজিব তো এদের সম্পর্কেই বলেছিলেন, ‘চাটার দল’, ‘চোরের দল’। এরা উন্মত্ত হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল গুম, খুন, রাহাজানি, ধর্ষণ, লাইসেন্সবাজি, চোরাচালান, পারমিটবাজি, দখলবাজি, চাঁদাবাজির মতো জঘন্য অপকর্মে। দেশে আইনের শাসন ভেঙে পড়েছিল। সৃষ্টি হয়েছিল নৈরাজ্যের। ব্যথিত-ক্ষুব্ধ শেখ মুজিব তার এসব ‘সোনার ছেলেদের’ সৎপথে-সুপথে ফিরিয়ে আনার জন্য খান আতাউর রহমানকে দিয়ে নির্মাণ করান বিখ্যাত চলচ্চিত্র ‘আবার তোরা মানুষ হ’। এরা মানুষ হওয়ার পথে ফিরে না আসায় ক্ষিপ্ত ক্রদ্ধ নেতা নিষিদ্ধ করে দেন আওয়ামী লীগ। অনেকটা ত্যাজ্যপুত্র করেন এই আপদগুলোকে। গড়ে তোলেন বাকশালের মতো খিচুড়ি। এতে ক্ষুব্ধ ও ক্রুদ্ধ বঞ্চিত আওয়ামী লীগেরই একটা অংশ সেনাবাহিনীর কিছু অফিসারের সহায়তায় নির্মমভাবে খুন করে শেখ মুজিবকে। গ্রহণ করে প্রতিশোধ। তারপর নেতার লাশ সিঁড়িতে ফেলে রেখে এরা বঙ্গভবনে দৌড়ায় নতুন সরকারে শপথ গ্রহণ করার জন্য। এদের বিরাট অংশ এখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আশপাশে।
সত্যিকারের গণতান্ত্রিক চেতনাসম্পন্ন আওয়ামী নেতা ও কর্মীদের অনেকেই এখন ক্ষমতার বলয়ের বাইরে। এই ফাঁকে আওয়ামী লীগের দÐমুÐের কথা সেজে বসে গেছে উচ্ছিষ্টভোগী-সুবিধাভোগীরা। এদের মধ্যে অনেকেই এখন বিরাট কর্তা। এরা শেখ মুজিবের চাইতেও বড় আওয়ামী লীগার সেজে বসেছে। অথচ এরাই শেখ মুজিবের নাম কুটি কুটি ছিঁড়ে করে রাস্তায় ফেলে পদদলিত করেছিল। দাবি করেছিল শেখ মুজিবের ফাঁসি। এরা বিলুপ্ত প্রজাতি মস্কাইডদের অপভ্রংশ। প্রাচীন বংশের নিঃস্ব সন্তান।
আওয়ামী লীগে ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চা আরও আছে। শেখ মুজিবকে খুনি, স্বৈরাশাসক ছাড়া যারা সম্বোধন করত না, জাতীয় পার্লামেন্টকে যারা ‘শূয়োরের খোঁয়াড়’ বলে উল্লেখ করত, যাদের অনেক নেতাকর্মী নিহত হয়েছে রক্ষীবাহিনীর হাতে, আবার আওয়ামী লীগের অনেক নেতা ও কর্মীর রক্তে যাদের হাত রঞ্জিত, হঠকারী ‘বৈদ্যুতিক সমাজতন্ত্রের’ ধ্বজাধারী সেই বাতিল মালগুলোও এখন আওয়ামী লীগের ঘাড়ে সিন্দাবাদের দৈত্যের মতো চেপে বসেছে।
আওয়ামী লীগ তাদের ‘ঘোষণাপত্র’ অনুসারে অগণতান্ত্রিক শক্তি নয়। তবে পরিষ্কারভাবে বলা যায়, এসব রাজনৈতিক ফকির, হাড়-হাভাতে, এতিম, আগাছা-পরগাছাই আজ আওয়ামী লীগকে দিয়ে নৃশংস ফ্যাসিস্ট কায়দায় নানা অগণতান্ত্রিক, অসাংবিধানিক ও অবৈধ কর্মকাÐ করাচ্ছে। তারাই ভেতর থেকে আওয়ামী লীগকে ফোঁপরা করে দিচ্ছে। তৈরি করছে কোলাহল, কদর্য-কুৎসিত নৈরাজ্য। এরাই নিজেদের নোংরা চেহারা আড়াল করার জন্য অতিমাত্রায় চিৎকার করে পাড়া মাথায় নিয়েছে। এসব পরগাছাই জ্যোতির্ময় জিয়ার বিরুদ্ধে ছড়াচ্ছে বিষ ও বিদ্বেষ।
এদের সমস্ত জীবন ও অবদান একত্র করে ওজন নিলেও শহীদ জিয়ার এক পার্টি জুতার সমান যে হবে না, একথা এরা ভালো করেই জানে। জিয়াকে অতিক্রম করা যায় না। জিয়া যে তাদের মতো অন্তঃসারশূন্য বেলুন ছিলেন নাÑ এটাও তাদের ক্রোধের অন্যতম কারণ।
নির্বাচন নির্বাচন খেলাতে এরা হয়তো কখনও কব্জা করে সিংহাসন। কিন্তু মানুষের মনের মণিকোঠার সিংহাসন লাভ যে দশবার জন্ম নিলেও হবে না, তা এরা জানে। সেজন্য আধিপত্যবাদের কাছে হৃদয় বন্ধক দিয়ে হলেও জিয়ার বিরুদ্ধে নিজেদের ব্যর্থতার ঝাল মেটায়। এসব অশান্তিকামী কপট, বর্ণচোরা, নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী সম্পর্কে নজরুল বলেছেন :
‘অশান্তিকামী ছলনার রূপে জয় পায় মাঝে মাঝে,
অবশেষে চির লাঞ্ছিত হয় অপমানে আর লাজে!
পথের ঊর্ধ্বে উঠে ঝড়ো বায়ে পথের আবর্জনা
তাই বলে তারা ঊর্ধ্বে উঠেছেÑকেহ কভু ভাবিও না!
ঊর্ধ্বে যাদের গতি, তাহাদেরি পথে হয় এরা বাধা;
পিচ্ছিল করে পথ, তাই বলে জয়ী হয় নাকো কাদা!’
চার.
দেশের মানুষের সর্বশেষ আশা-ভরসার স্থল সর্বোচ্চ বিচারালয়কেও এই সরকার নানা কায়দায় টেনে নামিয়েছে বিতর্কের কেন্দ্রে। ঘটনা যাই ঘটুক, দেশের মানুষ এখনও বিচারালয়ের প্রতি শ্রদ্ধা রাখতে চায়। সেই বিচারালয়কেও নানা উছিলায় ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে নিজেদের উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করার জন্য মরিয়া বর্তমান সরকার। বিষয়টি খুবই স্পর্শকাতর। সে জন্য সতর্কতার সঙ্গে মোকাবিলা করতে হবে সরকারের কুপ্রবৃত্তি। মনে রাখতে হবে, এরাই সর্বোচ্চ আদালতকে অপমান করার জন্য, তুচ্ছ করার জন্য ঝাড়–, মিছিল করেছিল। সেজন্য সর্বোচ্চ আদালতকে আমাদের দৈনন্দিন তোলপাড়ের ঊর্ধ্বে রেখে কথা বলাই ভালো। ভেবে দেখতে হবে, আদালতের এখতিয়ারবহির্ভূত বিষয়গুলো কেন আদালত কক্ষে ঠেলে দেয়া হচ্ছে।
আমাদের দেশের স্বাধীনতা কোন আদালতের রায়ে আসেনি। স্বাধীনতা এসেছে মুক্তিযুদ্ধের রক্তাক্ত প্রান্তরে। কোন মাননীয় কিংবা মহামান্য বিচারপতি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণও করেননি। করার কথাও হয়তো নয়। মুক্তিযুদ্ধ শুরু কিংবা স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন দেশমাতৃকার প্রিয় সন্তান সৈনিক জিয়া। তিনি বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি সেক্টর কমান্ডার ছিলেন।
সঙ্গত কারণেই কে স্বাধীনতার ঘোষক, কে নয়Ñনির্ধারণের ভার ঐতিহাসিকদের, গবেষকদের, মুক্তিযোদ্ধাদের, বাংলাদেশের জনগণের। এখতিয়ার বহির্ভূতভাবে এ নিয়ে আদালতকে যদি কেউ ব্যবহার করতে চায়, তাহলে মহামান্য আদালত তা গ্রাহ্যে আনবেন কেন? এভাবে জিয়ার অবদানকে খাটো করা অন্যায় হবে। এভাবে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত জিয়ার ভাবমূর্তি নষ্ট করাও সম্ভব নয়। তাছাড়া আদালতের রায় দিয়ে জাতীয় বীর বা জনগণের নায়ক বানানো যায় না। কাউকে বাতিলও করা যায় না। এর পেছনে থাকে প্রাকৃতিক ও ঐতিহাসিক কারণ।
পাঁচ.
এই যে বাংলাদেশ-বিরোধী, জিয়া-বিরোধী অপতৎপরতা, এর মোকাবিলায় জাতীয়তাবাদী শক্তির ভ‚মিকা কি? বিশেষ করে বিএনপির ভ‚মিকা হতাশাজনক। মনে হয় বিএনপি ফারসি সাহিত্যের অমর কবি শেখ সাদীর সেই নীতি কবিতাকেই মোক্ষ মেনেছেনÑ
‘কুকুরের কাজ কুকুর করেছে
কামড় দিয়েছে পায়,
তাই বলে কি কুকুরের কামড়ানো
মানুষের শোভা পায়।’
Ñতো সেজন্যই হয়তো বিএনপি কুকুরকে রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনাচ্ছেন। শোনাচ্ছেন মকছুদুল মুমিনিন।
কিন্তু একটু আগাপাছতলা ভাবলেই ধরতে পারত, কুকুরকে কামড়ানো মানুষের কাজ নয় সত্যি; কিন্তু কুকুরকে লাষ্ঠৌষধি প্রয়োগে তো কবি নিষেধ করেননি। তা প্রয়োগে সমস্যা থাকলে অন্তত দেখানোর কাজটা তো করা যেত।
ছয়.
স্টিভেনসনের কালজয়ী সৃষ্টি ‘ডা. জেকিল ও মি. হাউড’কে মনে পড়ে? মনে কি পড়ে তার অমর চরিত্র ডা. জেকিলকে? সদাশয় ডাক্তার জেকিলের দেহ ও মনের মধ্যে হিং¯্র পশু মি. হাইডের আবির্ভাব হলো। প্রথম দিকে দুই পরস্পরবিরোধী শক্তি প্রায় সমানে সমানে থাকলেও, যত দিন যায় ডা. জেকিলকে ক্রমে গ্রাস করে ফেলে হাইডের কালো ছায়া। অবশেষে একদিন হাইডের কবল থেকে আর মুক্তি পেলেন না জেকিলÑসেদিন দেশ ও সমাজকে রক্ষা করার জন্য আত্মহত্যার পথই বেছে নিলেন ড. জেকিল।
এই গল্পটা খানিক বয়ান করলাম সরকারি দল আওয়ামী লীগের দিকে তাকিয়ে। আমার মতো অনেকেরই ধারণা, ডা. জেকিলের মতোই আওয়ামী লীগের দেহ ও আত্মার মাঝে ঢুকে পড়েছে মি. হাইডরা। এই ডাইডদের কি সাচ্চা আওয়ামী লীগাররা প্রতিরোধ করতে পারবেন? আমরা কায়মনোবাক্যে চাই, আওয়ামী লীগ এই শুভ ও অশুভের দ্ব›েদ্ব বিজয়ী হোক। নইলেতো ইতিহাস তাদের ডা. জেকিলের পরিণতির কাছে নিয়ে যাবে।
সাত.
আওয়ামী লীগের ভেতর লুকিয়ে থাকা আধিপত্যবাদের চাকর-চাকররা, জিয়া-বিদ্বেষীরা যত ঘৃণ্য পথই বেছে নিকÑতারা জিয়াউর রমানকে মুছে ফেলতে পারবে না। অন্দকারের ঘৃণা অন্ধকারের বাসিন্দাদেরই পরাজিত করে। আলোর নায়ককে তারা কোনোদিন স্পর্শ করতে পারে না। সুরেশথ চন্দ্র সমাজপতি কিংবা সজনীকান্ত দাশরা শত চেষ্টা করেও রবীন্দ্রনাথ কিংবা নজরুলের মহিমাকে সামান্যতম ¤øানও করতে পারেননি। এরাও জিয়ার ইমেজ ও রাজনীতির কাছে খলনায়ক হিসেবেই চিহ্নিত হবে চিরদিন। তবে একদিকে এরা নিজেদের অমরত্বের আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছে। জিয়া বিদ্বেষের পোষক, নিন্দুক ও কুৎসা রটনাকারীরূপে এরা চিরদিন স্মরণীয় হয়ে থাকবে। এরা জ্যোতির্ময় জিয়ার পিছু পিছু চলবে চিরকাল, যেমনটি চলে আলোর পেছনে কালো ছায়া।
সত্যি বলছি, জিয়ার সঙ্গে এরাও ইতিহাসে স্থান পাবে, যেমনভাবে দেবী দুর্গার পায়ের নিচে জায়গা পেয়েছে মহিষাসুর। জিয়ার মাজার জিয়ারত করতে আসা দেশপ্রেমিক জনতা, চিরদিন হজের সময় শয়তানকে পাথর ছোড়ার মতো বিরক্তির করুণা ছুড়ে মারবে এদের দিকে। আর বিদ্বেষ ও ঘৃণার ঊর্ধ্বে উঠে শহীদ জিয়ার স্বপ্নের সুখী-সমৃদ্ধ শান্তিপূর্ণ আধুনিক বাংলাদেশ গড়ার জন্য গ্রহণ করবে শপথ।

Recent Posts