রেজাবুদ্দৌলা চৌধুরী
আজ (৩০ মে) শহীদ জিয়াউর রহমানের ৩৬ তম প্রয়ান দিবস। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এই দেশের মুক্তিযুদ্ধের এবং পরবর্তীকালের রাজনীতির ইতিহাসে এক সফল রাষ্ট্রনায়কের নাম- এক বীর যোদ্ধার নাম। জাতিরাষ্ট্র গঠন ও তাকে এগিয়ে নেয়ার, সমৃদ্ধ পরিণত করার লড়াইয়ের নাম এক মহাবীরের নাম।
আমি শহীদ জিয়ার বাংলাদেশী রাজনীতির একজন সামান্য অনুসারী-কর্মী হিসেবে তারঁ সান্নিধ্যে আসার সুযোগ লাভ করতে পেরে গর্বিত, ধন্য। ১৯৭৯ সালের শুরুতে বিএনপি এর অঙ্গসংগঠন জাতীয়তাবাদী সামাজিক সাংস্কৃতিক সংস্থা (জাসাস) গঠনের প্রক্রিয়া থেকে এই সংগঠনটির প্রথম সারির নেতৃত্ব ছিলাম। ওই বছরই শেষ-ভাগে আমাকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়। সভাপতি ছিলেন প্রখ্যাত কবি ও কথাসাহিত্যিক আলমাহমুদ।
বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন আমাদের নেতা জিয়াউর রহমানের আর্দশ-তারঁ কবিতা, তাঁর গান, তার অন্যসব সাহিত্য-কর্ম এবং সেসবের ভেতরকার সংগ্রামী চেতনার এবং সব অনাচারের বিপরীতে লড়াইয়ের প্রেরণার যে মূলধারা তা ছিল জিয়াউর রহমানের প্রাণের, হৃদয়ে-মগজের ভেতরে ঘাঁথা এক অমূল্য সম্পদ।
১৯৮০ সালের ২৫ মে মানে ১১ জ্যৈষ্ঠ কাজী নজরুলের জন্ম দিবস পালনের সময়ে বিএনপি সরকার মানে খোদ জিয়াউর রহমানের নির্দেশে তৎকালীন ঢাকা নগরীর মেয়র ব্যারিস্টার আবুল হাসনাত পুরোনো ময়মনসিংহ রোড (সেই সময়কার এয়ারপোর্ট রোড)-টিকে কাজী নজরুর ইসলাম এভিনিউ করলেন। জাসাস সেই আনুষ্ঠানিকতার আয়োজন করলো-প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান কবির নামে এভিনিউটি উদ্বোধন করলেন। আমি যথারীতি সেই আনুষ্ঠানিকতায় উপস্থিত ছিলাম-উপস্থাপকের ভূমিকায়, স্মরণীয় একটি অনুষ্ঠান ছিল তা। আমি জাসাস সাধারণ সম্পাদক হিসেব সংগঠনের পক্ষ থেকে ফার্মগেট থেকে কবি নজরুলের মাজার অবধি সড়কটির নামকরণ কবির নামে করার প্রস্তাব দেই। অনুষ্ঠানে নজরুল একাডেমী ও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের কর্মীরা অংশ নেন। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান নিজে ফার্মগেট থেকে কবির মাজারে একটি বৃক্ষরোপন করে কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ উদ্বোধন করেন।
এই ঘটনার ২/৩ দিন আগেরকার ঘটনা। আমরা জাসাস এর পক্ষ থেকে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিবস সামনে রেখে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের উদ্ভাবক রাষ্ট্রনায়ক জিযাউর রহমানের ভাবমূর্তিকে একটু উজ্জ্বলভাবে তুলে ধরার লক্ষ্য নিয়ে সহজ সরল দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে একটা পোস্টার ছাপালাম- সেটিতে কবির ধূমকেতু কবিতার একটা অংশ তুলে দিলাম-“আমি যুগে যুগে আসি, আসিয়াছি পুনঃমহাবিপ্লব হেতু—–আমি—-” ইত্যাদি। পোস্টারের ছবিতে- নজরুলের মুখচ্ছবির আদল থেকে বেরিয়ে আসছেন জিয়াউর রহমান। আমরা এই পোস্টারটি ছেপে সারা ঢাকা নগরীর দেয়ালে-দেয়ালে সাঁটালাম, লোকজন দিয়ে। অবাক কা-, আমরা একের পর এক দেয়ালে পোস্টার লাগাচ্ছি, আর পুলিশ তা তুলে ফেলছে-ব্যাপারটা কি ! ২/১ দিনের মধ্যে দেখলাম সব পোস্টার গায়েব হয়ে গেছে। আমরা তো হতবাক! এই সময়েয় আমরা জিয়াউর রহমানের সাথে দেখা করতে গেলাম। তিনি আমাদেরকে হালকা ধমক দিলেন। জিয়াউর রহমান বললেন, “আরে, তোমরা বোঝ না কোন-কবি নজরুল ইসলাম আমাদের জাতীয় কবি, তিনি কতো বড় ব্যক্তিত্ব! তার সাথে আমাকে তুলনা করবে তোমরা! এটা কি অসম্ভব কথা। আমার মা মিসেস জাহানারা রহমান করাচি রেডিও তে নজরুলের গান গাইতেন, আমি আবাল্য কবির সব কবিতা, গান, সাহিত্যকর্মের পাঠক, তার এক গুনমুগ্ধ অনুসারী –তারঁ সব সাহিত্যের সংগ্রামী চেতনার, সমগ্র প্রেরণার উত্তরাধিকার অর্জনের সাথে আমার নিজেকে তুলনা করার দুঃসাহস বা ধৃষ্টতা আমার কখনও হবে না। সেই কারণেই জাসাস এর পোস্টার তুলে নিয়েছি।” আমি অবাক বিস্ময়ে দেখলাম-আমাদের নেতার মহানুভবতা, তার সাংস্কৃতিকবোধ, তাঁর মূল্যবোধের উচ্চতা। বুঝলাম-আমাদের জাতীয় কবির প্রতি জিয়াউর রহমান অগাধ শ্রদ্ধাবোধ যা ছিল শতভাগ অকৃত্রিম।
এরপরের ঘটনাবলী তো চলমান, বহমান- আমরা জাসাস নিয়ে ব্যস্ত, প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান সরকার পরিচালনা, রাষ্ট্র পরিচালনা নিয়ে ব্যস্ত, বিশ্ব-রাজনীতির বহু বিষয় নিয়ে ব্যতিবস্ত। বিশেষভাবে তিনি বিশ্ব-রাজনীতিতে, ভূ-রাজনৈতিক কর্মতৎপরতায় নিজ রাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষা ইত্যাদি, মুসলিম-ভ্রাতৃঘাতি ইরান-ইরাক যুদ্ধ এর অবসান ঘটানো এই সব নিয়ে প্রচ- ব্যস্ত দিনানিপাত করছিলেন।
পরের বছর (১৯৮১) জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিন উপলক্ষে ১১ জ্যৈষ্ঠ (২৫ মে) জাসাস যে অনুষ্ঠান আয়োজন করলো তার ২/৩ দিন আগেকার ঘটনা। জাসাস এর সেই কর্মসূচি ছিল সীমিত-পর্যায়ের। তাই প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে প্রধান অতিথি করার ভাবনা আমাদের মাথায় ছিল না। প্রধান অতিথি করার কথা বিএনপি মহাসচিব প্রফেসর ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে। আমরা জাসাস এর কয়েকজন নেতা-কর্মী বিএনপি ধানম-ি অফিসে (চেয়ারম্যান অফিস) দলের চেয়ারম্যান এবং দেশের প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সাথে সাক্ষাত করতে গেলাম।
কিছু সময় অপেক্ষার পরে আমাদের সাক্ষাতের অনুমতি মিলল। আমি রুমে ঢোকা মাত্রই প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বলে উঠলেন- “কি খবর রেজাবুদ্দৌলা, তোমরা এবার, কবি নজরুলের জন্মদিন করছো না! আমাকে তো কার্ড দাও নি, কিছুই বলো নি!” আমি বললাম- “স্যার, এবার সীমিত পর্যায়ের অনুষ্ঠান করছি, তাই আপনাকে জানাইনি, প্রধান অতিথি এবার মহাসচিব সাহেব (ডা. বি. চৌধুরী)। আগামীবারে বড় অনুষ্ঠান করবো, আপনি থাকবেন স্যার।” তিনিও তাতে সম্মতি দিলেন।
প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ছিলেন ভিন্ন-মাপের এক মানুষ, তাঁর হৃদয় ছিল মমতাপূর্ণ, এই দেশের প্রতিটি মানুষের সব পাওয়া না-পাওয়ার দায় বহন করতেন মনে-প্রাণে, কোনও কৃত্রিমতা ছিল না তাতে। তিনি ইরান-ইরাক যুদ্ধ বন্ধে বিশ্ব নেতার ভূমিকা পালন করে গেছেন। আসলে বাংলাদেশকে একটি কর্ম-উদ্দীপনাময়, সমৃদ্ধ রাষ্ট্রের পথে ধাবিত করে গেছেন দিন-রাত পরিশ্রম করে, নিজের আরাম-আয়েশ সব ছেড়ে দিয়ে, নিজের পরিবার পরিজনের অর্থ-নিরাপত্তার কথা না ভেবে। সারাক্ষণই তাঁর ভাবনা ছিল সমগ্র বাংলাদেশকে নিয়ে। তিনি এই দেশে কৃষি বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন। অইন শৃঙ্খলার দারুণ উন্নতি ঘটিয়েছিলেন। এই উপমহাদেশীয় ভূ-রাজনৈতিক সমস্যাসমূহ সমাধানে বাংলাদেশের ন্যায্য হিস্সা আদায়ে সর্বত্রগামী তৎপরতা চালিয়ে গেছেন, কারও বড় ভাইসুলভ রক্তচক্ষুকে পাত্তা না দিয়ে। তিনি এই দেশের শিক্ষা সংস্কারে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছিলেন এবং ১৯৭৮-৭৯ সালের অন্তর্বর্তীকালীন শিক্ষানীতি প্রণয়নের মাধ্যমে তা দ্রুততার সাথে বাস্তবায়ন করেছিলেন। জিয়াউর রহমানই এই দেশে প্রথম শিল্পকলা একাডেমী, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রনালয়, যুব মন্ত্রনালয়সহ অসংখ্য প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিনে জনকল্যাণে।
শেষে সাহস করে একটা কথা বললাম। বললাম- “স্যার, ভোলা থেকে এক দরিদ্র ভদ্রলোক এসেছেন, খুব বিপদে পড়ে, উনি আপনার সাথে দেখা করতে চান।” প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান একটু অবাক হয়ে ভাবলেন ২/১ মিনিট, তারপর ডাকলেন সেই দরিদ্র ভদ্রলোককে। সেই ভদ্রলোক ঢোকার পর তাঁর বক্তব্য শুনলেন। তিনি বললেন, তাঁর জায়গাজমি সব চলে যাচ্ছে স্থানীয় কিছু লোকের ষড়যন্ত্রে, কোনও প্রতিকার-চেষ্টাই সফল হচ্ছে না, তিনি সর্বস্বান্ত, এখন প্রেসিডেন্ট সাহেবই তার একমাত্র ভরষা।” প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান তৎক্ষনাৎ বিএনপি নেতা অ্যাডভোকেট জুলমত আলী খানকে ডেকে তাঁকে ঐ ভদ্রলোকের জমিজমা উদ্ধার করাসহ সব সমস্যা সমাধানের নির্দেশ দিলেন। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান সেদিন একটা কথা বলেছিলেন- “এই দেশের কোন প্রান্তে একটি লোকও যদি না-খেয়ে থাকে দেশের প্রেসিডেন্ট হিসেবে আমাকে দায়-দ্বায়িত্ব বহন করতেই হবে, নিজ- বিবেকের কাছে, মহান আল্লাহ তায়ালার কাছে।”
প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ছিলেন ভিন্ন-মাপের এক মানুষ, তাঁর হৃদয় ছিল মমতাপূর্ণ, এই দেশের প্রতিটি মানুষের সব পাওয়া না-পাওয়ার দায় বহন করতেন মনে-প্রাণে, কোনও কৃত্রিমতা ছিল না তাতে। তিনি ইরান-ইরাক যুদ্ধ বন্ধে বিশ্ব নেতার ভূমিকা পালন করে গেছেন। আসলে মানুষের বাংলাদেশকে একটি কর্ম-উদ্দীপনাময়, সমৃদ্ধ রাষ্ট্রের পথে ধাবিত করে গেছেন দিন-রাত পরিশ্রম করে, নিজের আরাম-আয়েশ সব ছেড়ে দিয়ে, নিজের পরিবার পরিজনের অর্থ-নিরাপত্তার কথা না ভেবে। সারাক্ষণই তাঁর ভাবনা ছিল সমগ্র বাংলাদেশকে নিয়ে। তিনি এই দেশে কৃষি বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন। অইন শৃঙ্খলান দারুণ উন্নতি ঘটিয়েছিলেন। এই উপমহাদেশীয় ভূ-রাজনৈতিক সমস্যাসমূহ সমাধানে বাংলাদেশের ন্যায্য হিসসা আদায়ে সর্বত্রগামী তৎপরতা চালিয়ে গেছেন, কারও বড় ভাইসুলভ রক্তচক্ষুকে পাত্তা না দিয়ে। তিনি এই দেশের শিক্ষা সংস্কারে বিশাল আয়োজন করেচিলেন-১৯৭৮-৭৯ সালের অন্তর্বর্তীকালীন শিক্ষানীতি প্রণয়নের এবং তা দ্রুততার সাথে বাস্তবায়ন শুরুর মাধ্যমে। জিয়াউর রহমানই এই দেশে প্রথম শিল্পকলা একাডেমী, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রনালয়, যুব মন্ত্রনালয় প্রভৃতিসহ প্রচুরসংখ্যক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিনে জনকল্যাণে। তিনি ছিলেন আসল ভিশনারী-তাঁর সময় থেকে পরবর্তী অর্ধ শতাব্দীর ভিশন তিনি দিয়ে গেছেন যার কোনও তুলনা নেই, সেই ভিশন-এর সুফল এখন আমরা পাচ্ছি।
অত্যন্ত বেদনাহত চিত্তে আমরা ১৯৮১ সালের ৩১ মে সকাল সাড়ে নয়টার দিকে জানলাম-তাঁর নির্মম হত্যাকা-ের খবর। সেই দিন সুগন্ধায় অনুষ্ঠান ছিল-ছাত্রদলের বর্ধিত সভা। সেখানে উপস্থিত বিএনপি-এর যুগ্ম মহাসচিব ফেরদৌস আহমেদ কোরেশী তাৎক্ষণিকভাবে সারা ঢাকা শহরে মাইকিং করে ঢাকা স্টেডিয়ামে (বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম) জিয়াউর রহমানের গায়েবানো জানাযায় উদ্যোগ নিলেন। বিশাল জানাযা হলো দুপুরের দিকে। পরে ২ জুন জিয়াউর রহমানের মরদেহ ঢাকায় এলে মানিক মিয়া এভিনিউতে এই দেশের নজিরবিহীন বড় জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। প্রেসিডেন্ট জিয়ার হত্যাকা-ে সারাদুনিয়ার নেতারা রাষ্ট্রনায়কেরা শোক ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন। তাঁর এই রাষ্ট্রের সব ক্ষেত্রে যেসব অবদান রয়েছে তা অমর নিঃসন্দেহ।