জননেতা জিয়াউর রহমান

অধ্যক্ষ দেওয়ান মো. আজরফ

জননেতা শব্দটি অত্যন্ত ঢিলেঢালাভাবে আমাদের ভাষায় ব্যবহৃত হয়। দেশের কোন এক মানবগোষ্ঠীকে পরিচালনা করার ক্ষমতা থাকলেই সাধারণত তাকে আমরা জননেতা বলে থাকি। দেশের মধ্যে একাধিক দল থাকলে জননেতার সংখ্যাও সঙ্গে সঙ্গে বহু হয়ে দেখা দেয়। অথচ সূ²ভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় জননেতার সংখ্যা বহু হলেও প্রকৃত জননেতা ইতিহাসের ধারায় খুব অল্পই দেখা দেয়।
প্রাচীনকালে এবং মধ্যযুগে এ দুনিয়ার প্রায় সর্বত্রই সামন্ততন্ত্রীয় শাসনব্যবস্থার প্রচলনকালে, দেশের জনগণকে যে সব রাজা বা স¤্রাটরা নানাভাবে শাসন, পীড়ন ও শোষণ করতেন তারাও জননেতা বলে অভিহিত ছিলেন। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নগরকেন্দ্রিক রাষ্ট্রগুলোকে একত্রিত করে আলেকজান্ডার গ্রিক সা¤্রাজ্যের পত্তন করেও সন্তুষ্ট ছিলেন না, এ দুনিয়ার এক বিরাট অংশও জয় করেছিলেন। তার নির্দেশে একজন লোক যন্ত্র চালিতের মত কাজ করতো বলে তিনিও নিশ্চয়ই তৎকালীন মানবসমাজে জননেতারূপ পর্যুদস্ত মানুষের শ্রদ্ধার্ঘ পেয়েছিলেন। তেমনি চেঙ্গিস খান, হালাকু খান, তৈমুর, বাবুর প্রমুখ বিজেতাগণও জননেতা বলেও কোন এক সময় অভিনন্দিত ছিলেন।
আধুনিক যুগে নেপোলিয়ানও সেরূপভাবে মানুষের শ্রদ্ধা অর্জন করেছিলেন, তবে এদের মধ্যে কাউকেই প্রকৃত জননেতা বলা যায় না। কারণ এরা বিজিত জাতির তো নয়ই, তাদের স্বদেশীয় সকল লোকেরও শ্রদ্ধা লাভে সমর্থ হননি। এদের বলা যায় বিশেষ কোন গোষ্ঠীর নেতা। এরা তাদের অধীনস্থ সৈন্য-সামন্তকে নানাবিধ প্রলোভনে সম্মোহিত করে তাদের দ্বারা দিগবিজয় তথা মানব বংশের এক বৃহত্তম সংখ্যাকে পর্যুদস্ত করতে সমর্থ হয়েছিলেন। এদের মধ্যে সকলেই ধনবলের লোভে উন্মুত থাকলেও কেউই সাধারণ সৈনিকের সঙ্গে একই সারিতে দাঁড়িয়ে প্রতিপক্ষীয় শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেননি। মধ্য যুগে তার ব্যতিক্রম ছিলেন শাহানশাহ আওরঙ্গজেব আলমগীর। তিনি সকল যুদ্ধের সাধারণ সেনার পার্শ্বে দাঁড়িয়ে তাদের পরিচালনা করতেন। তবে তা সত্তে¡ও তিনি প্রকৃত জননেতা হতে পারেননি। তবে কারণ এই যে, সব যুদ্ধে তিনি সাধারণ সৈন্যের পার্শ্বে দাঁড়িয়ে অকুতোভয়ে সৈন্য পরিচালনা করেন। তাতে তার মূল উদ্দেশ্য ছিল তাদের উৎসাহ দান করে বিজয় লাভ। সে বিজয়ের ফল কিন্তু সৈন্যরা পেতেন না পেতেন স্বয়ং শাহানশাহ আওরঙ্গজেব। প্রকৃতপক্ষে জননেতা তাকেই বলা যায় যিনি জনগণের স্বার্থের সঙ্গে আপনার স্বার্থকে সম্পূর্ণভাবে একই বিষয়বস্তুতে পরিণত করে, জনগণের পার্শ্বে দাঁড়িয়ে তাদের সুখ-দুঃখ উত্থান-পতনের সঙ্গে সম্পূর্ণ একাত্ম হয়ে জীবনের সকল ক্ষেত্রে জনগণের মঙ্গলের জন্যই কাজ করে যান।
এরূপ আদর্শ এ দুনিয়ার ইতিহাসে সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয় হযরত রাসুলই আকরাম (দ.) জীবনে। প্রত্যেকটি জেহাদে যেমন তিনি তার অনুসারী সৈন্যদের এক সারিতে ছিলেন, মেনি জীবনের অন্যান্য নানাবিধ গঠনমূলক কাজেও তিনি সব সময়ই জনগণের প্রকৃত নেতারূপেই কর্মশীল ছিলেন। তার অনুসারীগণের মধ্যে এ নীতি গৃহীত হলেও সকল সময় তাদের পক্ষে সাধারণ সৈনিকের পার্শ্বে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করা সম্ভবপর ছিল না।
বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে প্রথম মহাসমরের পরিসমাপ্তিতে গ্রিক সৈন্যগণ এশিয়া মাইনর দখল করে নিলে তার পুনরুদ্ধারের জন্য গাজী মোস্তফা কামাল পাশা আল্লাহর রাসুলের (দ.) সে নীতিরই পুনঃপ্রবর্তন করেন, সাধারণ সৈনিকের সঙ্গে এক সারিতে যুদ্ধ করে গ্রিকদের পরাজিত করেন।
হৃতরাজ্য পুনরুদ্ধার করেই গাজী মোস্তফা (দ.) থেমে যাননি। অতিশয় অল্প অজিফা বা রাষ্ট্র থেকে গ্রহণ করে, তার উন্নতির জন্য দিনের পর দিন এবং রাতের পর রাত স্বজাতির সেবায় আত্মনিয়োগ করেন। এর পরে যে মহামানব এভাবে রাষ্ট্রগত প্রাণ হয়ে অহর্নিশি রাষ্ট্রের কল্যাণের জন্য আত্মহুতি দিয়েছেন তিনি হচ্ছেন বাংলাদেশের সর্বজনপ্রিয় জননেতা জিয়াউর রহমান। এ জননেতা কোন ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য নয়, দেশের সব সাধারণ মানুষের সঙ্গে তার ব্যক্তিগত সত্তাকে সম্পূর্ণভাবে একীভ‚ত করে, একদিকে যেমন দেশের স্বাধীনতার জন্য ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে মারাত্মক সংগ্রামে লিপ্ত ছিলেন, তেমনি এ বাংলাদেশেরই মজে যাওয়া খাল, নালা, নদীর সংস্কারে কোদাল হাতে খননের কাজে লিপ্ত ছিলেন। কাজেই একেই প্রকৃত জননেতা নামে অভিহিত করা যায়। কেবল জনগণের সঙ্গে এক সারিতে কাজ করার জন্যই তাকে জননেতা বলার স্বার্থকতা নেই। ইতিহাসের ধারায় যারা বাংলাদেশের জনগণ বলে পরিচিত ছিল তাদের জানমাল রক্ষা করার দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন বলেও তাকে জননেতা বলা যায়।
এদেশের ইতিহাসের দিক আলোচনা করলে একে এক মহাবিড়ম্বনা বললে অত্যুক্তি হয় না। বার বার এদেশের লোকদের দ্বারা প্রতিশ্রæতি ভঙ্গ করা হয়েছে। ইংরেজ শাসনের সর্বশেষ পর্যায়ে এবং পাকিস্তান আন্দোলনের সর্বোচ্চ পর্যায়ে এ উপমহাদেশের সকল মুসসলিমই উদাত্তস্বরে ঘোষণা করেছিল পাকিস্তান হবে এ উপমহাদেশের সকল মুসলিমের জাতীয় আবাসস। বার বার সকল মুসলিমই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিল পাকিস্তান কোন বিশেষ অঞ্চলের লোকের বা কোন বিশেষ ভাষাভাষী লোকের একচেটিয়া ভোগ দখলের মূল হবে না। এ ওয়াদায় আশ্বস্ত হয়ে উত্তর প্রদেশ, বিহার আসাম প্রভৃতি প্রদেশে সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায় এ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। তাদের ফলে আসামের তৎকালীন কংগ্রেস সরকার আসাম থেকে আঠার হাজার মানুষকে এক মাসের মধ্যে উৎখাত করে দেয়। তেমনি ১৯৪৬ সালে ডাইরেক্ট একশান ডে এর প্রতিক্রিয়ার ফলে বিহারের পয়ত্রিশ হাজার মুসলিম এক সপ্তাহের মধ্যে শাহাদত বরণ করে। অতঃপর পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর এ শাহাদতপ্রাপ্ত বিহারী মুসলিমদের সন্তান-সন্ততি ও আত্মীয়-স্বজন এবং আসাম থেকে উৎখাত আঠার হাজার মুসসলিমেরা ও তাদের আত্মীয়-স্বজন এ বাংলাদেশেরই মাটিতে আশ্রয় নেয়। তখন ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সূচনা থেকে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এসব সর্বহারা মানুষ ক্রমেই এ দেশীয় লোকদের দুশমন শ্রেণিতে পরিণত হয়। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সৈন্যের সঙ্গে যোগসাজশের জন্য এরাই আবার বাংলা ভাষাভাষী মানুষের কাছে দুশমন শ্রেণিতে পরিণত হয়। শুধু তাই নয়, একদা যারা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য বা তার মধ্যে প্রজাতন্ত্রের নীতি বজায় রাখার জন্য আমরণ সংগ্রাম করেছিলেন তারা হয়ে পড়েন দেশের ঘোরতর শত্রæ। কায়েদে আজম মুহম্মদ আলী জিন্নাহ, নওয়াবজাদা লিয়াকত আলী খান, চৌধুরী খালিক উজ জামান, সরদার আব্দুর রব নিশতার আজ বাংলাদেশের শত্রæ শ্রেণিতে পরিণত। এমনকি বাংলাদেশবাসী মহান বীর তার জীবনের মায়া তুচ্ছ করে পাকিস্তানি নেতাদের ভ্রূকুটি অগ্রাহ্য করে জীবনপণ করে পাকিস্তানে গণতন্ত্র রক্ষা করার জন্য আমরণ সংগ্রাম করেছিলেন সেই মৌলভী তমিজ উদ্দিন খান আজ বিস্মৃতির অতল তলায় নিমজ্জিত। ইতিহাসকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করলে যে কোন জাতির পক্ষেই নিস্তার লাভের আশা নেই, এ কথা সর্বদা স্মারণ করে যিনি এ দেশের সকল রাজনৈতিক দলের মধ্যে যোগসূত্র প্রতিষ্ঠার জন্য সচেষ্ট ছিলেন এবং পাকিস্তান পূর্ব এবং পাকিস্তান উত্তর নানাবিধ দল ও মতবাদের মধ্যে সমন্বয় সাধন করার চেষ্টা করেছিলেন অর্থাৎ পাকিস্তানের জন্য যারা সংগ্রাম করলেন, তারা দেশের শত্রæ নয় তারা মিত্র। তারাই বাংলাদেশকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র করে গড়ে তোলার ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিল। যারা ১৯৭১ সালে এদেশকে পাকিস্তানের তথাকথিত নেতৃবৃন্দের কবল থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে যে ভ‚মি পেয়েছিল তাকেই তারা স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রে পরিণত করেছিলেন। তাদের মধ্যে অনেকেই বিগত ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছিল। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগে যারা ঊনবিংশ শতাব্দীতে সশস্ত্র সংগ্রাম করে পরাজিত হয়েছিল, তাদের মধ্যে মহামানব তিতুমীর, সমাজ সংস্কারক ইংরেজদের বিরুদ্ধে শাসনপ্রণালীর সম্পূর্ণ বিরুদ্ধ ভাবাপন্ন হাজী শরীয়ত উল্লাহ, নবযুগের ভাবধারা আমদানি করতে উৎসাহী ও মুসলিমদের জীবনে জ্ঞান বিজ্ঞানের আলোক দান করাতে আজীবনলিপ্ত মরহুম নওয়াব আ: লতিফ, বাঙালি মুসলিম জীবনে আবার আত্মপ্রতিষ্ঠার নীতি প্রচলনে কর্ম চঞ্চল মরহুম নওয়াব স্যার সলিমুল্লাহ, বাংলার তথা ভারতীয় মুসলিম জীবনে ইসলামী ভাবধারার সংস্কার সাধনে ব্রতী মরহুম মাওলানা আকরাম খা ও তার সাময়িক আহলে হাদিসের ভাবধারার চিন্তানায়কগণ, দরিদ্র ও বিত্তহীন মুসসলিম জনসাধারণকে জমিদার ও মহাজন নামক দুটো শোষক শ্রেণির কবল থেকে মুক্ত করতে নিবেদিতপ্রাণ শেরে ই বাংলা এ কে ফজলুল হক, এ দেশীয় মুসলিম জীবনকে এক বিশ্বের অন্য জাতির সঙ্গে একতাবদ্ধ করতে সর্বপ্রথম প্রয়াসী মরহুম হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী প্রমুখ নেতৃবৃন্দের অবদান কিছুতেই বিস্মরণীয় নয়। এরাই বাংলাদেশের ইতিহাসের গোড়া পত্তন করে দেন এবং এদের সঙ্গে যারা কলমের অথবা তরবারির যুদ্ধে যোগদান করেছিলেন তারা সকলেই বাংলাদেশের জনসাধারণের কাছে স্মারণীয় ও বরণীয়। এজন্য তিনি সংকীর্ণ দৃষ্টিকোণের আলোকে রাজনৈতিক পাঠ না করে এক বৃহত্তর ও মহত্তর দৃষ্টির আলোকে তাকে পাঠ করেছিলেন বলে তিনি বাংলাদেশের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। রাজনীতিতে সকল দেশেই বিভিন্ন মতো বা দল থাকবেই। একনায়কত্বের ফল সকল সময় মোটেই দেশের পক্ষে মঙ্গলদায়ক নয়। তবে যে বা যারা যে মতবাদই পোষণ করেন না কেন তাদের সে মতবাদে দৃঢ় প্রত্যয়শীল হওয়া প্রয়োজনীয়। দ্বিতীয়ত জননেতার পক্ষে উন্নত চরিত্রের লোক হওয়া প্রয়োজনীয়। ব্যক্তিগত স্বার্থের ঊর্ধ্বে অবস্থান করে, দেশের সুখ দুঃখের সঙ্গে সঙ্গে একীভ‚ত তাকে কল্যাণের পথে যিনি নিয়ে যান তিনিই প্রকৃত দেশপ্রেমিক জননেতা এবং কেবল কালের ধ্বংসশীল নীতিকে অতিক্রম করে চিরজীবন লাভ করতে পারেন।
নীতিগতভাবে তাকে অনুসরণ না করলেও তার চরিত্রের মহানুভবতা যে সকল লোকের পক্ষে অবশ্যই আদর্শের আলোকস্তম্ভ স্বরূপ একথা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। তাই তার জীবনের অমানুষিক বিভীষিকার কালো অন্ধকার নামবার ক্ষণে আমরা বিদেহী আত্মার উদ্দেশ্যে বলবো জিয়া আমরা তোমাকে ভুলব না কোনদিন, তোমার অ¤øান চরিত্রের আদর্শে আমরা আবার জীবন গঠন করবো এবং এদেশকে আমরা প্রাণ দিয়েও ভালোবাসব তোমার মতই।

অধ্যক্ষ দেওয়ান মো. আজরফ (মরহুম) : বিশিষ্ট দার্শনিক ও জাতীয় অধ্যাপক

Recent Posts