ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অনুভূতি

মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, বীর প্রতীক

বিজয় দিবস সমাগত। বিজয়ের আনন্দে উৎফুল্ল, চেহারা উৎফুল্ল মুখ কিন্তু হৃদয় ব্যথিত। দীর্ঘ নয় মাসের যুদ্ধে পথ চলতে চলতে অনেক সাথীকে রেখে এসেছি, তাদের স্মৃতি হৃদয়কে ভারাক্রান্ত করে রাখে। নয় মাস পথ চলতে চলতে কত আলাপ হয়েছে সে কথাগুলো মনে আসে। বারবার আলাপ করেছি যুদ্ধের পর বাংলাদেশ কেমন হবে, আমরা কীভাবে দেশটি চালাবো, আমরা কীভাবে দেশটিকে সুন্দর করবো এসব কিছু নিয়ে। কিন্তু ভাগ্য বিধাতা তাদেরকে নিজের কাছে নিয়ে গিয়েছেন আমাদেরকে রেখে গেছেন এই মাটির পৃথিবীতে।

বিজয়টি ছিল একটি অস্ত্রধারী যোদ্ধাগোষ্ঠীর ওপর আরেকটি অস্ত্রধারীগোষ্ঠীর। বিজয়টি ছিল রণাঙ্গনের যোদ্ধাদের। রণাঙ্গন ছিল বাংলার মাটি। হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর অত্যাচারে আমার দেশের মাটি ও মানুষ নির্যাতিত নিপীড়িত রক্তরঞ্জিত হয়েছে। তাদের প্রতিরোধ করতে গিয়ে আমাদের রক্ত দিয়েই মাটিকে আমরা রঞ্জিত করেছি। শেষমেষ আমাদের কাতারে এসে যোগ দিয়েছিল বন্ধুপ্রতীম দেশ ভারতের সামরিক বাহিনী। মার্চের ২৬ তারিখ থেকে ডিসেম্বরের ১৬ তারিখ পর্যন্ত ২৬৬ দিন। শেষের ১৬ দিন বাদ দিলে, ২৫০ দিনই একলা যুদ্ধ করেছি আমরা বাংলার তরুণেরা, বাংলার সৈনিকেরা, বাংলার দামাল ছেলেরা। পরবর্তী ১৬ দিন আনুষ্ঠানিকভাবে নাম হয়েছিল যৌথ বাহিনী। ভারতীয় বাহিনী এবং আমাদের বাহিনী মিলে সম্মিলিত আক্রমণ চালিয়েছি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। আমরা বিজয়ী হয়েছি
ভারতীয় কূটকৌশলের কাছে আমরা পরাজিত হয়েছি বিজয় দিবসেই। বাংলাদেশের কোনো প্রতিনিধি পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর করেনি। কারণ স্বাক্ষর করার জন্য কাউকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি, স্বাক্ষর করার জন্য কোনো পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়নি। ভারতীয় কৌশল ছিল যেন বাংলাদেশের প্রধান সেনাপতি কর্নেল এমএজি ওসমানী কলকাতাতেই না থাকেন, যাতে করে তাকে নামকাওয়াস্তে দাওয়াত দেওয়া হলেও তিনি উপস্থিত হতে না পারেন। তৎকালীন বাংলাদেশ সরকার তা বুঝতে পারেনি। অগত্য বাংলাদেশ সরকার উপ-প্রধান সেনাপতি গ্রæপ ক্যাপ্টেন একে খন্দকারকে অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্য মনোনীত করেন। তিনি বেসামরিক পোশাকে দশজনের ভিড়ের মধ্যে একজন উপস্থিত ছিলেন। নয় মাসের গৌরব কয়েক মুহূর্তের অবহেলায় ভূলুণ্ঠিত হয়ে যায়। আমরা সেই বেদনা আজও ভুলতে পারিনি।

বিজয়টি ছিল রণাঙ্গনের। অতি স¤প্রতি ভারতীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর পারিকর কাশ্মির ও পাকিস্তান প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে বাংলাদেশকে নিয়েও যাচ্ছেতাই বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন। জনাব পারিকর বলেছেন, রাম যেমন সিংহল দখল করে বিভিষণের হাতে তুলে দিয়েছিলেন অনুরূপ ১৯৭১ সালের ভারতও পূর্ব পাকিস্তান দখল করে বাংলাদেশের হাতে তুলে দিয়েছেন। অবাস্তব অবমাননাকর আক্রমণাত্মক কূটনীতি বহির্ভূত বক্তব্য, আমরা তার প্রতিবাদ করি। আমরা ভারতীয় সৈন্য বাহিনীর অবদানকে কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করি, আমাদের স্বাধনতার জন্য তারা প্রাণদান করেছেন এই কথাটিকে আমরা ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখে রেখেছি। আমরা আশা করবো ভারতীয় কর্তৃপক্ষও তাদের ইতিহাসকে পুনরায় লিখবেন।

মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্যবস্তুগুলোর মধ্যে অন্যতম দুইটি ছিল। গণতন্ত্র ও সাম্য। একবিংশ শতাব্দীতে এসে আমরা সাক্ষ্য দিতে পারবো না যে, আমরা গণতন্ত্র অনুসরণ করছি এবং মানুষে মানুষে সাম্য স্থাপন করতে পেরেছি। এই ব্যর্থতা জাতির এবং এই ব্যর্থতা সকলের। মুক্তিযোদ্ধাগণকেও এই ব্যর্থতার দায় স্বীকার করতে হবে। কারণ মুক্তিযোদ্ধাগণ ১৯৭২ সালে মিষ্টি কথায় ভুলে গিয়েছিল। বলা হয়েছিল, যার যার পেশায় ফিরে যাও। অতএব রাজনীতিবিদগণ রাজনীতিতে ফেরত গিয়ে দেশ শাসনের দায়িত্ব নিয়েছিল। যারা বুকের রক্ত দিয়েছিল, তারা দেশ শাসনে জড়িত থাকলো না। দেশ গঠনে অবদান রাখতে পারলো না। মুক্তিযোদ্ধাগণকে দূরে ঠেলে দেওয়ার পরিণতি আজ একটি বিভক্ত বাংলাদেশ। শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ছিলেন রণাঙ্গনের বীর মুক্তিযোদ্ধা। অন্য সেক্টর কমান্ডারগণও ছিলেন, আমরাও ছিলাম। এই দেশ, আজকের যেই সমাজ এটি মুক্তিযোদ্ধাগণের স্বপ্নের বিকৃত প্রতিফলন, এর জন্য দায়ী যারা আমাদেরকে দূরে ঠেলে দিয়েছিলেন তারা।

লেখক: চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
ইমেইল: সমংসরনৎধযরস@মসধরষ.পড়স

Recent Posts