এ কেমন বিজয়?

মো. মিজানুর রহমান

জাতি হিসেবে আমরা কেমন বিজয় পেলাম? এ প্রশ্ন রেখেই লেখাটা শুরু করলাম। এই দেশ স্বাধীন বা বিজয় হওয়ার পটভূমিতে আছে সুদীর্ঘ ইতিহাস। ১৯৪৭-এ দেশ ভাগ হলো। এরপর আইয়ুব এর সেনাশাসন চলল এবং সেই সাথে চলল পশ্চিম পাকিস্তানি কর্তৃক আমাদের অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানিদের প্রতিটি ক্ষেত্রে বৈষম্য, শোষণ আর লাঞ্ছনা-বঞ্চনার শিকার। এর মধ্যে ১৯৬৫-তে পাক-ভারত ‘কারগিল’ যুদ্ধ হলো, সে যুদ্ধে তৎকালীন সেনা জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে সেই অংশে বা ইউনিটে পাকিস্তান বিজয়লাভ করলো। ১৯৬৬ তে ছয়দফা এলো। ১৯৬৯-এ গণঅভ্যুত্থান হলো। ১৯৭০-এ নির্বাচন হলো। আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেল। শেখ মুজিব প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য দেন-দরবার চালাতে লাগল। পাকিস্তান তথা ইয়াহিয়া-ভুট্টোরা শেখ মুজিবকে প্রেসিডেন্সি না দেওয়ার জন্য টালবাহানা করতে থাকল। শেখ মুজিব প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য নিজ সিদ্ধান্তেই অনঢ় রইল। গোপনে গোপনে পাকিস্তান এ দেশে যুদ্ধের রশদ যোগান দিতে থাকল। শেখ মুজিব নিজে প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য ছাড় না দিতে অটল রইল। ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঢাকার নিরীহ মানুষের ওপর ট্যাঙ্ক-কামান-গুলিবর্ষণ চালিয়ে নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালাতে থাকল এবং সেই সাথে শেখ মুজিবকে বন্দি করে পাকিস্তানে নিয়ে গেল। সাথে সাথে তৎকালীন বহু আওয়ামী নেতা জাতিকে ফেলে ভারতে আশ্রয় নিল। জাতির আকাশে যেনো অমানিশার ঘোর আঁধার নেমে এল। ছিল না তখন জাতির কোনো কাÐারি। অন্ধকার-শূন্য-বিভীষিকাময় সময় তখন। চারদিকে থমথমে পরিবেশ। ঠিক এমনি সময় ‘মেজর জিয়াউর রহমান’ চট্টগ্রামে প্রথম ‘রিভল্ট’ ঘোষণা করলেন এবং চট্টগ্রাম এর কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে ১৯৭১ এর ২৬ মার্চ বাংলাদেশের ‘স্বাধীনতা ঘোষণা’ করলেন। যা সারা দেশে তো বটেই; বিদেশেও ছড়িয়ে গেল। এই মেজর জিয়াউর রহমান-ই ছিলেন ১৯৬৫-তে পাক-ভারত ‘কারগিল’ যুদ্ধের বিজয়ী সেনা। যিনি ‘হিলাল-ই-জুরাত’ খেতাবপ্রাপ্ত। এছাড়াও তৎকালীন সময়ে (১৯৬৫ সালে কারগিল যুদ্ধের সময়) জিয়াউর রহমানের ইউনিট এই যুদ্ধে বীরত্বের জন্য দুটি ‘সিতারা-ই-জুরাত’ এবং নয়টি ‘তামঘা-ই-জুরাত’ মেডেল লাভ করেন। সেই মেজর জিয়াউর রহমান কর্তৃক ‘স্বাধীনতা ঘোষণা’র সাথে সাথে সারা দেশে ‘আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা-কৃষক-শ্রমিকসহ সকল জনতা’ লাঠি হাতে-পাকিস্তানি অস্ত্র ছিনিয়ে নিয়ে-প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিবাহিনীসহ বিভিন্ন গেরিলা বাহিনী গঠন করে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকে। মেজর জিয়াউর রহমান ‘স্বাধীনতার ঘোষণা’ দিয়ে জনমত গঠনসহ নিজেও ১নং সেক্টর কমান্ডারের দ্বায়িত্ব নিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকেন। চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের জন্য যুদ্ধকে আরো বেগবান করার লক্ষ্যে মেজর জিয়াউর রহমান ‘জেড ফোর্স’ এর নেতৃত্ব দিয়ে অবিরত যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকেন। যুদ্ধে তিরিশ লক্ষ শহিদ আর দেড় লক্ষ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে ১৯৭১ এর ১৬ই ডিসেম্বর তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বিকালে এ কে খন্দকার ও জেনারেল নিয়াজী’র মধ্যে এক স্বাক্ষরের মাধ্যমে অর্জিত হয় লাল-সবুজ পতাকার বাংলাদেশের চূড়ান্ত বিজয় এবং ১৯৭২ সাল থেকে ১৬ ডিসেম্বর জাতীয়ভাবে বিজয় দিবস পালন করা হয়। (মেজর জিয়াউর রহমান দেশ স্বাধীনের পর স্বাধীন দেশে স্ব-পদে চাকরি করেন। আর শেখ মুজিব বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেয়ে ক্ষমতায় বসেন।)

বৈষম্য, শাসন-শোষণ, লাঞ্ছনা-বঞ্চনার বিরুদ্ধে আর জনগণের রায়ের চূড়ান্ত রূপ দিতেই অর্থাৎ গণতন্ত্রের বিজয় হতেই সৃষ্ট ইয়াহিয়া-ভুট্টো-মুজিবের মধ্যে আলাপ-আলোচনা চলাকালে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে মেজর জিয়াউর রহমান কর্তৃক স্বাধীনতা ঘোষণার মাধ্যমে সে সময় সু-দীর্ঘ নয় মাসে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে বিজয় অর্জিত হয়েছিল। আজ সেই বিজয়ের প্রায় সাড়ে চার দশক পরে এসে বর্তমান পরিস্থিতিতে সুশীল সমাজ-সুধীজন, রাজনীতিবিদ-অর্থনীতিবিদসহ সচেতন জনগণ ভাবছে-আমরা ‘এ কেমন বিজয়’ পেলাম?

কেন আজ রাজনীতিতে বৈষম্য? সরকারি দল বা জোটের জন্য এক নীতি। সরকারি দল বা জোটের বাইরের দল বা জোটের জন্য অন্য নীতি। সরকারি দলের নেতা-কর্মীরা শত শত অপরাধ করলেও কোনো মামলা হয় না বা থানায় মামলা নেয় না বরং আগের মামলা থাকলে তা তুলে নেওয়া হয়। সরকারি দল বা জোটের বাইরের দল বা জোটের নেতা-কর্মীদের মামলা তুলে নেওয়া তো দূরের কথা বরঞ্চ কোনো অপরাধ না করলেও তাদের নামে বা বেনামে হাজার হাজার মামলা-হামলা-জেল-জুলুম-রিমান্ড-নির্যাতন-অপহরণ-গুম-পঙ্গু-খুন হতে হয়। একদল দেদারছে সভা-সমাবেশ, মিছিল-মিটিং করতে পারে। অপরদল সভা-সমাবেশ করতে চাইলে দেওয়া হয় বাধা-প্রশাসনিক নিষেধাজ্ঞা।

সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে লাগে সরকার দলীয় সমর্থকের সার্টিফিকেট। না হলে ধরা হয় বিরোধী দলের লোক অতএব তাদের চাকরি নেই। অথচ বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের ইস্তেহার ছিল ঘরে ঘরে চাকরি দেওয়ার। আজ কোথায় সে প্রতিশ্রæতি? এগুলো কি ১৯৭১ সালের বিজয়ের তাৎপর্য বহন করে?

তাহলে আজ কোথায় স্বাধীনতা? কোথায়-ই বা বিজয়ের তাৎপর্য? আজো কেন এই দেশে একসাথে সাত-সাতটি খুন হয়-যার সুবিচার হয় না? অজো কেন মেধাবী ছাত্র ত্বকি হত্যার বিচার হয় না? আজো কেন সিলেটের রাজন, খুলনার রাকিব, বরগুনার রবিউল-এর মতো শিশুরা নির্মমভাবে হত্যার শিকার হয়? আজো কেন গার্মেন্টকর্মীরা কাজ শেষে ঘরে ফেরার পথে বা স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়–য়া মেয়েরা পড়া শেষে বাড়ি ফেরার পথে নির্যাতন-ধর্ষণের শিকার হয়। আজো কেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ কর্তৃক নিরীহ দর্জি হত্যা হয়-যার চূড়ান্ত সাজা হয় না? আজো কেন এই দেশে ‘রানা প্লাজা’র মতো ট্র্যাজেডি ঘটে? সরকারি দল করার জন্য অপরাধীর বিচার হয় না। আজো কেন হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট হলেও ‘সোনালী ব্যাংক-হলমার্ক কেলেঙ্কারি বা বাংলাদেশ ব্যাংকের মতো রিজার্ভ চুরি হোতাদের ধরা হয় না, বিচার হয় না। আজো কেন শেয়ার বাজারের টাকা লুটকারীদের হদিস দেওয়া হয় না বা এ বিষয়ে কোনো তথ্য প্রকাশ করা হয় না? আজো কেন সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা চলে? আজো কেন এ দেশে কেউ কেউ জাতি-উপজাতি বলে বিভেদ তোলে? আজো কেন ইয়াবা বা মাদক নামক মরণ নেশার ব্যবসা চলে? আজো কেন সাংবাদিক দম্পতি ‘সাগর-রুনি’ হত্যার কোন কূল-কিনারা বের করা হয় না-বিচার হয় না। আজো কেন সাংবাদিকদের স্বাধীনভাবে কলম ধরতে আসে বাধা? তাহলে কোথায় আজ বিজয়ের তাৎপর্যতা? এ কেমন বিজয় আমাদের?

আজো কেন পথে-ঘাটে রাতে বা দিনে নিরীহ মানুষের গুলি খেতে হয়? এমনকি মায়ের পেটেও নিষ্পাপ শিশুর গুলি খেতে হয়-যার বিচার হয় না। আজো কেন এই দেশে হয় বোমা হামলা-মরে মানুষ। অফিসে যেতে বা পথে-ঘাটে এমনকি ঘরের ভেতরে হতে হয় খুন। আজো কেন মানুষের জীবনযাপন করতে হয় ভয়-ভীতির মধ্যে? আজো কেন অস্ত্রের মুখে সন্ত্রাসীরা টাকা লুটে? আজো কেন মানুষের জান-মালের কোন নিরাপত্তা নেই? …এ কেমন বিজয়?

আজো কেন এই দেশে উন্নয়ন প্রকল্পে দফায় দফায় বাজেট বাড়িয়ে টাকা লুটপাট করে? আজো কেন সংসদে মিথ্যা কথার ফুলঝুরি ঝরে? বিচারের বাণী আজো কেন আদালতে কেঁদে মরে? আজো কেন এ দেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতি চলে? আজো কেন আফিসে ফাইল চলে ঘুষের বলে? আজো কেন এই দেশে কালো টাকার খেলা চলে? আজো কেন এই দেশে ভাই দুর্নীতি চলে? আজো কেন চাঁদাবাজি-ছিনতাই আর রাহাজানি চলে? আজো কেন সন্ত্রাসীদের গডফাদাররা দম্ভভরে মাথা উঁচু করে চলে? আজো কেন সীমান্তে ফেলানীদের লাশ ঝোলে? আজো কেন চুক্তিগুলো জনসন্মুখে প্রকাশ করা হয় না? কোন ভয়ে? আজো কেন তিস্তার পানির ন্যায্য পাওনা আদায় হয় না? ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বরে পিন্ডির জিঞ্জির ছিড়লেও দিল্লির দাসত্বের জিঞ্জির আজো কেন চলছে? এসব প্রশ্ন থেকে কি সহসাই এই জাতির মুক্তি মিলছে?

এদেশে কেন এখনও চলে ভোটের নামে তামাশা? ভোটের দিন জনগণ ভোট দিতে গেলে বলা হয় ভোট দেওয়া হয়েছে, বাড়ি যাও। ভোটের আগেই কেন ব্যালট বাক্স ভরা থাকে? দলীয় ক্যাডার দ্বারা কেন আগেই ভোটকেন্দ্র দখল করা হয়ে যায়? পোলিং অফিসার কেন একাই একাধিক সিল মেরে ব্যালট বাক্স ভরায়? রক্ষক কেন ভক্ষক হয়ে ফলাফল দেয় পাল্টে? নির্বাচন কমিশন কেন কোনো দ্বায়-দ্বায়িত্ব না নিয়ে দায়সারা বক্তব্য দিয়ে যায় পার পেয়ে? কেন-ই বা নির্বাচন কমিশন অথর্ব, ইতর, মেরুদÐহীন উপাধি পায়? পুলিশ-প্রশাসন কেন নীরবে পক্ষপাতিত্ব দেখিয়ে সব সয়ে যায়? পুলিশ-প্রশাসন কেন আজ নির্বিকার? কেন তারা নিরপেক্ষতা বজায় রাখছে না? ভোটের আগেই কেন একদল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় বা কূটকৌশলে বিনাপ্রতিদ্ব›িদ্বতায় নির্বাচিত হয়? মন্ত্রী-এমপিরা নিজের ভোটটা পর্যন্ত না দিয়ে কীভাবে সংসদে যায়? আজব-বিচিত্র এ দেশ যেন আশ্চর্য এক সেলুকাস।

এ কোন বিজয়? এ কিসের বিজয়? তাহলে আমরা ‘কেমন বিজয় পেলাম’? ১৯৭১ এর রণাঙ্গনের জীবিত বীরযোদ্ধারা আজ চুপ কেন? এসব বৈষম্য বা দুর্নীতি-লুটপাট-অনিয়মের বিষয়ে মুখ খুলতে বা কথা বলতে কোথায় তাদের বাধা? তারা তো ১৯৭১-এ পাক-হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে অসীম সাহসিকতার সাথে লড়ে দেশ ও জাতিকে পরাধীনতা, বৈষম্য, শাসন-শোষণ, লাঞ্ছনা-বঞ্চনা থেকে মুক্তি দিয়ে বিজয় উপহার দিয়েছিল। তবে আজ কেন তাঁরা হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকার মতো আছে? নতুন প্রজন্মের কাছে তাঁরা এর কি-ই বা জবাব দেবে? প্রায় সাড়ে চার দশক পরে বিজয়ের তাৎপর্য-ই বা আজ কোথায়, প্রশ্ন থেকেই যায়? তাই তো আজ এই লগ্নে এসে সুশীল সমাজ-সুধীজন, রাজনীতিবিদ-অর্থনীতিবিদসহ সচেতন জনগণ ভাবছে- “এ কেমন বিজয়” আমাদের।

লেখক: সাংবাদিক, কবি ও কলামিস্ট

Recent Posts