সঞ্জয় দে রিপন
“I do not fight fascists because I will win. I fight fascists because they are fascists.”— Chris Hedges অর্থাৎ “আমি জিতব বলে ফ্যাসিবাদীদের সাথে লড়াই করি না। আমি ফ্যাসিস্টদের সাথে লড়াই করি কারণ তারা ফ্যাসিবাদী।”- ক্রিস হেজেস
ক্রিস হেজেসের এই বয়ানের প্রতিচ্ছবি হচ্ছে জনাব তারেক রহমানের দুই দশকের আন্দোলন সংগ্রাম। বাংলাদেশে গণতন্ত্র নেই কথাটি বিশ^ব্যাপি প্রমাণিত। গণতন্ত্র সমুন্নত রাখার ব্যাপারটি খালেদা জিয়া আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে চেষ্টা করেছিলো ২০১৪ সাল পর্যন্ত। ২০১৪ সালের পর রাষ্ট্রীয় সঙ্কটটি আর সে জায়গায় থাকলো না। রাষ্ট্র ধীরে ধীরে একটি গণবিরোধী চিন্তাকে লালন করতে থাকলো; যেখানে রাষ্ট্রের সাথে জনগণের সম্পর্কটি পরিবর্তিত হয়ে প্রজা ও দাস প্রথার মতো সম্পর্কের দিকে উত্তীর্ণ হলো; যেখানে সুনিশ্চিতভাবে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, ভোটাধিকার ও ভিন্নমত পোষণকরাকে আইনি কায়দায় দমন করতে থাকলেন রাষ্ট্র। রাষ্ট্রটি হয়ে উঠলো একটি পরিবারের সম্পত্তি আর সাধারণ মানুষকে ভয় দেখিয়ে একটি উন্নয়নের স্বপ্নবানে জর্জরিত করে প্রতিষ্ঠা করা হলো ফ্যাসিবাদ।
২০১৪ সাল পরবর্তী অন্ধকার সময়ে গণমানুষের অধিকার পুণঃপ্রতিষ্ঠার লড়াই সংগ্রামে তারেক রহমান যে ভূমিকা রেখেছেন সেখান থেকেই তিনি গণমানুষের আস্থা ও বিশ^াসকে লালন করে অবিস্মরণীয় নেতৃত্বের স্থান দখল করেছেন। ১৯৭১ সালের সঙ্কটে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মতোই ধৈর্য্য এবং সাহসিকতার সাথে সমকালীন সঙ্কটকালে (২০১৪ সালে থেকে ২০২৩ সাল) তারেক রহমান বাংলাদেশের মানুষের দিকপাল হয়ে উঠেছেন। ফ্যাসিবাদ এর বিরুদ্ধে তারেক রহমানের আন্দোলন আজ বাংলাদেশের ২০ কোটি মানুষের আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়েছে। আওয়ামী ফ্যাসিবাদের একমাত্র লক্ষ্য ছিলো খালেদা জিয়াকে শেষ করে দেয়া এবং পরবর্তীতে তাদের একমাত্র প্রতিপক্ষ হিসেবে তারেক রহমানকে সনাক্ত করেন তারা। এর প্রধানতম কারণ হচ্ছে আওয়ামী ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে একমাত্র তারেক রহমান যিনি গণতন্ত্রের পক্ষে লড়াই সংগ্রাম চালিয়ে যাবার সামর্থ্য দেখিয়েছেন ও গণমানুষের আস্থা কুড়িয়েছেন ত্যাগ এবং নির্যাতনের স্বীকার হয়ে। গোটা জাতীকে গণতন্ত্র পুণঃপ্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সাহস জুগিয়েছেন বাংলাদেশের প্রাণনাথ তারেক রহমান। কারন তিনি ২০১৪ সাল পরবর্তী সময় থেকে নব্য ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করছেন।
Journal of Comparative Fascist Studies G “The appeal of neo-fascism in times of crisis. The experience of CasaPound Italia” . প্রবন্ধে Castelli Gattinara, Pietro; Forio, Caterina; Albanese, Marco
নব্য-ফ্যাসিবাদের চরিত্র সম্পর্কে বলেছেন “কর্তৃত্ববাদ, নেটিভিজম, জেনোফোবিয়া এবং অভিবাসন বিরোধী মনোভাব, সেইসাথে উদার গণতন্ত্র, সামাজিক গণতন্ত্র, সংসদীয়তাবাদ, উদারনীতিবাদ, মার্কসবাদ, নব্য উদারনীতিবাদ বিরোধিতা অন্তর্ভুক্ত থাকে।”
আমরা যদি লক্ষ্য করি তাহলে দেখবো সবগুলি উপাদানই আমাদের রাষ্ট্রে এখন আর নেই। শুধু বিরোধীতা করা নয় সংসদীয়তাবাদকে একেবারে ধ্বংস করে দিয়েছে এই আওয়ামী সরকার। আর তাই আওয়ামী ফ্যাসিবাদ ২০১৪ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাস থেকে বাংলাদেশে প্রমাণিত ও প্রতিষ্ঠিত সত্য।
এখন আমরা জেনে নেবো আওয়ামী ফ্যাসিবাদ কেনো তারেক রহমানকে ভয় পায়?
আওয়ামী ফ্যাসিবাদ হল এমন একটি সরকার ব্যাবস্থা ব্যবস্থা যারা সাধারণত জোরপূর্বক, হিংসাত্বকভাবে ভিন্নমত ও বিরোধী সমালোচনাকে দমন করেছে; যারা অনৈতিকভাবে সকল শিল্প ও বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করেছে; লুটপাট করেছে রাষ্ট্রীয় ব্যাংক, শেয়ার বাজার এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে। আওয়ামী ফ্যাসিবাদের সময়কালে বিচার বিভাগকে আজ্ঞাবহ করে রায় দেয়া হচ্ছে গত ১২ বছর ধরে। আওয়ামী ফ্যাসিবাদের একটি চূড়ান্ত রূপ হচ্ছে রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে (যেমন র্যাব, পুলিশ, বিজিবি) দলীয় বাহিনীতে পরিণত করা; এই সরকারের সময় গোয়েন্দা সংস্থার নিয়ন্ত্রণ দ্বারা গণমাধ্যমকে প্রভাবিত করা হয়েছে। গুমের সংস্কৃতি তৈরি করে গণমানুষের মধ্যে ভীতির সঞ্চার ঘটিয়ে ক্ষমতা দীর্ঘমেয়াদি করা হয়েছে যাতে মানুষ প্রতিবাদ করতে ভয় পায়।
এমন একটি বাংলাদেশের জন্য একমাত্র আশির্বাদ হচ্ছেন তারেক রহমানের বিদেশে অবস্থান করা। কারণ তিনি দেশের বাইরে ছিলেন বলেই দেশের মানুষের পাশে দাঁড়াতে পেরেছেন; জনমত তৈরি করেছেন বিশ^ব্যাপি যা গণতন্ত্র পুণঃপ্রতিষ্ঠার জন্য সহায়ক ভূমিকা রেখেছে বলে বাংলাদেশের মানুষ বিশ^াস করে।
আওয়ামী ফ্যাসিবাদ এর একমাত্র লক্ষ্য ছিলো কেউ যেনো গণআন্দোলন তৈর করতে না পারে। এমন চিন্তা ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মধ্য, দক্ষিণ এবং পূর্ব ইউরোপের অনেক অংশে বিস্তার করেছিল এবং পশ্চিম ইউরোপ, দক্ষিণ আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকা, জাপান এমনকি মধ্যপ্রাচ্যেও বিকশিত হয়েছিলো। কিন্তু কালের যাত্রায় বাংলাদেশে একজন তারেক রহমান ছিলেন; যিনি জাতিগত অধিকার রক্ষার আন্দোলনের দৃঢ় প্রতিজ্ঞ; গণ-মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে জীবন দানের জন্য মৃত্যুর পথে সদা প্রস্তুত। মায়ের আদর ত্যাগ করেছেন বছরের পর বছর; ভাইকে হারিয়েছেন কিন্ত গণতন্ত্র পুণঃপ্রতিষ্ঠার লড়াই সংগ্রাম থেকে পিছু হঠেননি। তিনিই আজ বাংলাদেশের মানুষের প্রবাদপ্রতীম নেতা । তিনি জনমুখি বলেই আওয়ামী ফ্যাসিবাদের একমাত্র শত্রু হিসেবে তারেক রহমানকে তারা চিহ্নিত করেছেন। যার ফলাফল ২ আগষ্ট ২০২৩ খ্রিস্টাব্দে আওয়ামী আজ্ঞাবহ আইন বিভাগ দেশনায়ক তারেক রহমান ও তাঁর স্ত্রী জোবায়দা রহমানের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলার রায় প্রদান করা।
মামলার রায়টি রাষ্ট্রীয়ভাবে তারেক রহমানের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করলো কিভাবে?
এই রায়ে খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রকাশ পেলো যে আওয়ামী ফ্যাসিবাদ তারেক রহমানের নেতৃত্বকে ভয় পায়। তারেক রহমানের সঙ্গে রয়েছেন বাংলাদেশের মানুষ। আর তাই গোটা আওয়ামী সরকার, তারেক রহমানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছেন প্রায় ১৪ বছর ধরে। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের জন্য সকল বাঁধা উপেক্ষা করে হিমালয়সম দাড়িয়ে রয়েছেন তারেক রহমান। যিনি এই সরকারের ফ্যাসেসগুলোকে উপরে ফেলতে কাজ করে যাচ্ছেন এবং একমাত্র তিনিই যে বাংলাদেশের হারিয়ে যাওয়া গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম সেটাও প্রমাণ করেছে এই মামলার রায়।
ফ্যাসিবাদ (ভধংপরংস) শব্দটি ল্যাটিন ফ্যাসেস (ভধংপবং) থেকে এসেছে; যার অর্থ হচ্ছে প্রসারিত কুঠার ফলক। ক্ষমতা এবং কর্তৃত্বের প্রতীক হিসাবে ফ্যাসেসগুলো বা কুঠার ফলক ১৮ এবং ১৯ শতকে প্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্রগুলোতে প্রতিষ্ঠা করা হতো। আওয়ামী ফ্যাসেস এর মৌলিক বিকাশ হচ্ছে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস; যার মাধ্যমে রাষ্ট্র নিজেই সন্ত্রাস সৃষ্টি করে ও প্রতিনিয়ত এই সন্ত্রাসের আওতায় ভিন্নমত দমন করে থাকে। পাড়ায় পাড়ায় মহল্লায় মহল্লায় এই ফ্যাসেস দিয়েই ভয় দেখিয়ে গণ-আন্দোলনকে দাবিয়ে রেখেছে আওয়ামী ফ্যাসিবাদ। এই ফ্যাসেস প্রতিষ্ঠীত করতে গিয়েই আওয়ামী সরকার একের পর এক গুম ও বিচার বহির্ভূত হত্যাকা- ঘটিয়েছে। ব্যবহার করেছে রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে।
এক ওসি প্রদীপ কক্সবাজারে মাদক দমনের নামে হত্যা করেছে ২০০ মানুষকে। ফ্রান্সের একটি স্থানীয় মিডিয়া সর্বপ্রথম সেই খুন গুলো নিয়ে প্রতিবেদন করেছে। আওয়ামী সরকারের আরেকটি ফ্যাসেস হচ্ছে ডিজিটাল সিকিউরিটি এক্ট, যার মাধ্যমে গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করে গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ গুলো আড়াল করে রেখেছে। কিন্তু ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দের পর বাংলাদেশের মহানায়ক তারেক রহমান যিনি সরকারের সকল অপকর্মের চিত্র উপস্থাপন করেছেন এবং প্রতিবাদ করেছেন। সাম্প্রতিক কালে তাঁর নেতৃত্বে আওয়ামী ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে গণজোয়ার সৃষ্টি হয়েছে। আর একারনেই তারেক রহমানের নেতৃত্ব গণমানুষের মনে জায়গা করে নিয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধর্মের মতো করে ব্যবহার করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সত্যিকারের চেতনাকে ভূলুন্ঠিত করেছে আওয়ামী ফ্যাসিবাদ। মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক লক্ষ্য ছিলো শোষণহীন সমাজ, গণতন্ত্র ও সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করা কিন্ত আওয়ামী ফ্যাসিবাদ তা ধ্বংস করে চৈনিক রাষ্ট্র নির্মাণের লক্ষ্যে জনগণকে দাসে রূপান্তর করেছে। আর এই জনগণকে তাদের রাষ্ট্র ফিরিয়ে দেয়ার লড়াই সংগ্রাম করছেন তারেক রহমান; এজন্যই বাংলাদেশের মানুষের প্রাণের নেতা তারেক রহমান এখন মানুষের প্রাণনাথ হয়ে উঠেছেন।
২০১৪ সালে আওয়ামীলীগ ও বিএনপি’র ঐতিহাসিক দ্বন্দ শেষ হয়ে গিয়েছে। কারণ ক্ষমতায় অধিষ্ঠীত হওয়া বা ক্ষমতা হারিয়ে ফেলার লড়াই এখন আর নেই; বর্তমানে বাংলাদেশের মানুষের লড়াই হচ্ছে দেশটাকে টিকিয়ে রাখার লড়াই; মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় রাষ্ট্রকে বিনির্মান করার লড়াই। বাংলাদেশের মানুষের মৌলিক সঙ্কট গণতন্ত্র; যে গণতন্ত্রের ধারায় বাংলাদেশকে ফিরতেই হবে। এই আন্দোলন একটি দলের নয়, এই আন্দোলন বাংলাদেশের সকল জনগণের। এই আন্দোলনের পক্ষ-বিপক্ষ এখন আওয়ামী ফ্যাসিবাদ বনাম জনগণ। আওয়ামী ফ্যাসিবাদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন শেখ-হাসিনা আর জনগণের পক্ষে নেতৃত্ব দিচ্ছেন তারেক রহমান।
বাংলাদেশের মানুষের এই গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরিয়ে আনার যে আন্দোলন বিএনপি ও বিরোধী দলের কর্মীরা করছেন সেইটা একটা পিউর হিরোইক এক্ট এবং এর মধ্যে সুপার এক্ট করছেন জনাব তারেক রহমান। তাইতো বিশ^ব্যাপী তারেক রহমান এখন গণতন্ত্রকামী মানুষের আশা-আকাঙ্খার প্রতীক এবং মহা-সঙ্কটকালের অবিসংবাদিত নেতা। তারেক রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশের মানুষ প্রমাণ করবে এই রাষ্ট্র জনগণের; কোন ফ্যাসিস দিয়ে জনগণকে আর দাস বানিয়ে রাখা যাবেনা।
লেখক: প্রভাষক, শান্ত-মারিয়ম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজি
সম্পাদক, জিয়াউর রহমান আর্কাইভ
তথ্য সহায়িকা:
- Castelli Gattinara, Pietro; Forio, Caterina; Albanese, Marco (1 January 2013). “The appeal of neo-fascism in times of crisis. The experience of CasaPound Italia”. Journal of Comparative Fascist Studies. 2 (2): 234–258. doi:10.1163/22116257-00202007. Previous research has established that there is a connection between economic crises and the emergence of fascism, and that the critique of neo-liberalism and market economy constitutes a central feature of neo-fascist groups.
- https://www.azharbdacademy.com/2022/01/what-is-fascism-and-its-characteristics.html
- Fritzsche, Peter (1 October 1989). “Terrorism in the Federal Republic of Germany and Italy: Legacy of the ’68 Movement or ‘Burden of Fascism’?”. Terrorism and Political Violence. 1 (4): 466–481. doi:10.1080/09546558908427039. ISSN 0954-6553.