স্বাধীনতা, মুক্তি ও জিয়াউর রহমান

বীর মুক্তিযোদ্ধা এম এ মালেক

আমাদের প্রাকৃত মধ্যবাংলা বা আজকের বাংলাদেশের ভূ-খ-ের স্বাধীনতার ইতিহাস ও মুক্তির ইতিহাস একই ধারার অনুরণন। স্বাধীনতা পূর্ব বাংলাদেশের আন্দোলন-সংগ্রাম যা ছিল জনগণের সার্বিক মুক্তির আন্দোলন যা ধীরে ধীরে ‘৪৭’ এর পরবর্তী সময় আন্দোলন থেকে স্বাধীনতার সংগ্রামের রূপ নেয়। যে কারণে এ দেশের রাজনীতির প্রতিষ্ঠান মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ‘৭০ এর নির্বাচন পূর্ব অবস্থায় ঘোষণা করেছিলেন “ভোটের মুখে লাথি মার-বাংলাদেশ স্বাধীন কর”। সেই দিন এ দেশের রাজনীতিকরা মাওলানা সাহেবের কথায় কর্ণপাত করেননি। কিন্তু ‘৭০ এর নির্বাচনের পর আওয়ামীলীগ নির্বাচনে ৩১৩ আসনের মধ্যে ১৬৯ টি আর পশ্চিম পাকিস্তানীরা পায় ১৪৪ টি অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামীলীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করলেও পশ্চিম পাকিস্তানী জান্তারা তা মেনে না নিয়ে গণতন্ত্রের পথকে রুদ্ধ করে দেয়। এবং তারা ৩রা মার্চ ‘৭১ পার্লামেন্টের সভা আহবান করলেও তা ১লা মার্চ ‘৭১ স্থগিত করে দেয় এবং ৭ ই র্মাচ ১৯৭১ ঢাকায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনসভা আহবান করেন।
উক্ত সভায় জননেতা শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণে মূলত এদেশের আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের কথাই বলেন-যা ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনি ইশতেহারের অনুরূপ। ‘৭০ এর নির্বাচনী ইশতেহারেও একই কথা বলা হয়। আওয়ামীলীগ জোট নির্বাচনী ইশতেহার ও ঘোষণা পত্রে উল্লেখ করেন “পাকিস্তান হবে একটি প্রজাতন্ত্র যার প্রতিটি ইউনিট ছয় দফার ভিত্তিতে স্বায়ত্তশাসন ভোগ করবে।” ঘোষণাপত্রে ধর্ম নিরপেক্ষতার কথাও উল্লেখ ছিল না। বরং বলা হয়েছিল ‘পবিত্র কোরআন ও সুন্নাহ বিরোধী কোন আইন পাস করা হবে না।’ সমাজতন্ত্রের কথাও ছিল না। সেখানে বলা হয়েছিল ‘অর্থনৈতিক কর্মসূচির লক্ষ্য হবে, ন্যায় ও সমতাভিত্তিক একটি শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা করা।’ আওয়ামীলীগের নির্বাচনী ইশতেহারে যাহাই কিছু উল্লেখ থাক না কেন তা কিন্তু ‘৭৮ সালে জিয়াউর রহমান কর্তৃক আনীত সাংবিধানিক সংশোধনীগুলো থেকে খুব একটা আলাদা কিছু নয় বরং কাছাকাছি। তাই বুঝা যায় ১৯৭০ এর নির্বাচনী বাস্তবতা ছিল ভিন্ন রকম। কিন্তু নির্বাচনের পর পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ভিন্নধারায় প্রবাহিত হয়। জনগণ পাকিস্তানীদের শোষণ, শাসন, নিপীড়ন আর মুখ বুজে সহ্য করতে না পারায় অতিষ্ট হয়ে ওঠে। তাই শেখ মুজিবের ছয় দফার আন্দোলন এক দফায় পরিণত হয়। কিন্তু জনগণের নেতা তা বুঝে না বুঝার ভান করে অতি সন্তর্পনে ৭ ই মার্চে তার ঐতিহাসিক ভাষণে ব্যাপারটি এরিয়ে গিয়ে বলেন, “এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম”। কিন্তু স্বাধীনতা বলতে তো বুঝায় জনগনের সার্বিক মুক্তির লক্ষ্যে একটি নির্দিষ্ট ভূখ-ের রাজনৈতিক স্বাধীনতা যুদ্ধ আর মুক্তি বলতে বুঝায় জনগণের সার্বিক মুক্তি অর্থাৎ স্বাধীন দেশের জনগণের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক মুক্তি। যে আন্দোলন চলছিল ‘৪৭-২৫ মার্চ ‘৭১ পর্যন্ত-যা এখনও চলছে। তাই আরো বলতে হয় স্বাধীনতা ও মুক্তি হাত ধরাধরি করে চলে না বলেই এ দু’টি বিষয়ের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে অনেক। কারণ মুক্তির প্রশ্নটি আসে স্বাধীনতার পর। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান যখন ভাষণ দেন তখন মুক্তির কথা বলাই স্বাভাবিক। কিন্তু তার ভাষণে দু’টির কথাই বলেছিলেন। যা ছিল একে অপরের সাংঘর্ষিক। কারণ দু’টির সত্তাই আলাদা। তাই বলতে হয় সত্তায় নির্মীত হয় চেতনা, চেতনায় কখনো সত্তা নির্মীত হয় না। বাংলাদেশের স্বাধীনতা পূর্বাবস্থায় ৭ মার্চের ভাষণ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় ঐ ভাষণে মূলত স্বায়ত্তশাসনের কথা বলা হয়েছিল। স্বাধীনতার কথা নয়। তাই হয়তো শেখ মুজিবুর রহমান ‘৭১ এর ১৬ মার্চ হতে ২৩ শে মার্চ পর্যন্ত ইয়াহিয়া-ভূট্টোর সাথে বৈঠক করে বলেছিলেন “আমাদের আলোচনা ফলপ্রসূ”। যা ২৪ শে মার্চ দৈনিক আজাদ/ ইত্তেফাক-এ প্রকাশ পায়। এ ব্যাপারে আলোচনার পূর্বে আমরা পাকিস্তান সৃষ্টির কথা কিছুটা উল্লেখ করতে চাই। কারণ পাকিস্তানের জন্ম হয়েছিল একটি ধর্মীয় আবেগে সেই দিন অর্থাৎ ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট ব্রিটিশ ভারতের শাসন হইতে এ অঞ্চলের জনগণ পৃথক হয়েছিল ধর্মীয় মূল্যবোধে, কোন প্রাকৃত চেতনায় নয়। এখানে ধর্মীয় মূল্যবোধ কাজ করায় ৭০০০ মাইলের ব্যবধানে প্রাকৃত মধ্য বাংলা তা আজকের বাংলাদেশ অর্থাৎ সে দিন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের চেতনা পশ্চিম পাকিস্তানী জনগণের পাশে দাড়িয়ে এক হয়ে গিয়ে স্বাধীন হয়েছিল। সেটাও ছিল স্বাধীনতা। কিন্তু স্বাধীনতার ওপর জনগণের সার্বিক মুক্তির প্রশ্নে পশ্চিম পাকিস্তানীদের সাথে এ আন্দোলনে জনগণ এক হয়ে উঠতে পারেনি। পশ্চিম পাকিস্তানীরা তখন স¤্রাজ্যবাদী নীতির ভূমিকায় অবর্তীণ হয়ে তারা সর্বপ্রথম এ অঞ্চলের জনগণের মায়ের ভাষা তথা আমার মায়ের ভাষা কেড়ে নিতে চায়। এই দ্বন্দ্ব থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানীদের সাথে মূলত দ্বন্দ্বের সুত্রপাত ঘটে এবং তাদের শাসনের-শোষণের পদ দলে এই অঞ্চলের জনগণ পৃষ্ট হয়। অর্থাৎ ‘৪৭ সালের পরবর্তী সময় হইতেই পশ্চিম পাকিস্তানীরা পূর্ব পাকিস্তানী জনগণকে দাবিয়ে রাখার পরিকল্পনা করে। প্রথমতঃ র্পূব পাকিস্তানী জনগণের মায়ের ভাষাকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি না দিয়ে পাকিস্তানী সংখ্যালঘু জনগণের মায়ের ভাষা উর্দ্দুকে রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদা দিতে চায়। পশ্চিম পাকিস্তানীদের এই সিদ্ধান্তের জন্য এ দেশের জনগণ প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠে। এই প্রতিবাদ থেকে আন্দোলনের জন্ম নেয়। এই আন্দোলন প্রথমে থেমে থেমে তারপর সর্বত্র ছড়িয়ে পরে। পাকিস্তানের জাতির পিতা কয়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পূর্ব পাকিস্তান সফর করেন ১৯৪৮সালে। ১১ ই মার্চ রেসকোর্সের এক জনসভায় পাকিস্তানের জাতির পিতা কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ তার বক্তব্যে বলেন,“টৎফফঁ, টৎফফঁ ংযধষষ নব ঃযব ংঃধঃব ষধহমঁধমব ০ভ ঃযব ঢ়ধশরংঃধহ.” তখনই মুর্হু মুর্হু প্রতিবাদ ধ্বণি দিতে দিতে জনগণ রেসকোর্স ময়দান থেকে বেরিয়ে যান। এমনি করে প্রতিবাদের ভাষা তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকলে দেশব্যাপী হরতাল মিটিং মিছিলে রাজপথ প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। পশ্চিম পাকিস্তানীরা ছাত্র-জনতার মিছিলে গুলি করে। এমনি অবস্থায় আন্দোলন তীব্র করার লক্ষ্যে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন হয়। উল্লেখ থাকা ভাল যে, পশ্চিম পাকিস্তানীদের এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে সর্বপ্রথম ড. মোঃ শহীদুল্লাহ ও মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী তীব্র প্রতিবাদ করেন। ‘৫২ এর ২১ ফেব্রুয়ারী সারা বাংলায় হরতাল আহ্বান করলে পশ্চিম পাকিস্তানীরা ১৪৪ ধারা জারী করে। ছাত্ররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে খ- খ- মিছিল নিয়ে এগুতে গেলে পুলিশের গুলিতে সালাম, জব্বার, রফিক, বরকত নিহত হলে আন্দোলন আরো বেগবান হয়। তখন পশ্চিম পাকিস্তানীরা রণ ভঙ্গ দিয়ে বাংলাভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদা দেয়। এখান থেকেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সূচনা।
পশ্চিম পাকিস্তানীদের ষড়যন্ত্র এখানেই শেষ নয়। এখানকার চা, চামড়া, পাট বিদেশে রপ্তানী করে প্রচুর আয় করে কিন্তু এদেশের উন্নয়নে একটি পয়সাও খরচ না করে সব পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার করতে থাকে। শোষণের এই ধারা অব্যহত থাকলে এর প্রতিবাদে পুনঃরায় আন্দোলন জাগরিত হয়। যা ‘৬২ শিক্ষা আন্দোলন, ৬৯ এর গণ অভ্যুত্থান পর্যায়ে পৌছায়। আর এই আন্দোলনের মধ্যে দিয়েই ‘৭০ এর নির্বাচন। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে ৩ রা মার্চ পাকিস্তানের পার্লমেন্টের অধিবেশন আহবান করে তা আবার ১লা মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বন্ধ করে দেয়। এ পর্যায়ে শেখ মুজিব বেলা ২টা পর্যন্ত হরতাল ও ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে জনসভা আহবান করে। এ কথা বলা যেতে পারে পশ্চিম পাকিস্তানীদের শোষণ-শাসনে পৃষ্ট পূর্ব-পাকিস্তানের জনগণ সে দিন থেকেই আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খানের পার্লমেন্টের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করার পর পরই পূর্ব বাংলার জনগণ বিপ্লবের পথে এগিয়ে গিয়েছিল। আর এটার বলার অপেক্ষা রাখে না যে, অধিবেশন বন্ধ ঘোষণার সাথে সাথেই পশ্চিম পাকিস্তানীদের ভাঙ্গন শুরু হয়ে গিয়েছিল। এ পর্যায়ে ছাত্র জনতা শেখ মুজিবের সাথে সাক্ষাৎ করলে তিনি জনগণকে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ ছাড়া আর কিছুই বলেন নি। তিনি আরো বলেন, জনতার শোষণ মুক্তিই আমাদের লক্ষ্য। আমরা এই চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করবই। তিনি উপস্থিত জনতার উদ্দেশ্যে বলেন, ‘আগামী ৭ মার্চ পর্যন্ত সমগ্র পূর্ব বাংলায় বেলা ২ টা পর্যন্ত হরতাল চলবে। এর পর থেকে দেশে অসহযোগ আন্দোলন তথা ১ দফার আন্দোলন চলতে থাকে। ৬ মার্চ লন্ডনের ‘দি টাইম্স’ এর সম্পাদকীয় মন্তব্য করেন ‘প্রতিবাদমুখর পূর্ব বাংলা পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে সর্ম্পক চ্যুত হওয়ায় দাবি ঘণ্টায় ঘণ্টায় তীব্রতর হচ্ছে। লন্ডনের দি টাইমস্ আরো উল্লেখ করেন পূর্ব পাকিস্তানের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের সামনে দু’টি পথ খোলা রয়েছে। ৭ মার্চ তিনি একতরফা স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে পারেন অথবা সংসদ ডেকে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানী নেতাদের বৈঠকে যোগদানের আহবান জানাতে পারেন।
দেশময় এমন পরিস্থিতিতে পাকিস্তানীরা কৌশলের আশ্রয় নেয়। এই বিষয়ে পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক সরকারের তৎকালীন তথ্য কর্মকর্তা মেজর সিদ্দিক সালিকের ‘উইটনেস টু স্যারেন্ডার’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন। পূর্ব পাকিস্তানের জিওসি ৭ মার্চের জনসভার আগে আওয়ামীলীগের নেতাদেরকে স্পষ্টভাবে জানান যে, পাকিস্তানের সংহতির বিরুদ্ধে কোন কথা বলা হলে তা শক্তভাবে মোকাবেলা করা হবে। বিশ্বাসঘাতকদের হত্যার জন্য ট্যাঙ্ক, কামান, মেশিনগান সবই প্রস্তুত রাখা হবে, প্রয়োজনে ঢাকাকে মাটির সাথে মিশিয়ে দেওয়া হবে। অপরদিকে বিভিন্ন নেতা-কর্মী ও ছাত্র নেতারা শেখ মুজিবুর রহমানকে ৭ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার চাপ দেন।
এমনি কঠিন সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে সেদিন শেখ মুজিবুর রহমান রেসকোর্স ময়দানে তার ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। দিনটি ছিল রোববার, পুরো রেসকোর্স ময়দান সকাল থেকেই পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। এই জন¯্রােতের মাঝে শোভা পায় মানুষের হাতে পূর্ব বাংলার মানচিত্র খচিত পতাকা। শ্লোগানে শ্লোগানে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে তোলে। সবার মুখে একই শ্লোগান “আপস না-সংগ্রাম, সংগ্রাম সংগ্রাম। আমার দেশ, তোমার দেশ বাংলাদেশ, বাংলাদেশ। বীর বাঙ্গালী অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর।”
এই শ্লোগান যখন চলছিল তখন শেখ মুজিবুর রহমান ৩টা ১৫ মিনিটে মঞ্চে ওঠে তার ১৯ মিনিটের ভাষণে বলেন, আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তার অধিকার চায়। এর অর্থ তিনি তার বক্তব্য চয়নের ভিতর দিয়ে বাংলার মানুষকে জাগ্রত করতে চান। শেখ মুজিব তার ভাষণে আরো বলেন, আজ দুঃখের সঙ্গে বলতে হয় ২৩ বছরের করুণ ইতিহাস বাংলার অত্যাচারের ইতিহাস, বাংলার মানুষের রক্তের ইতিহাস। ২৩ বছরের ইতিহাস মুর্মূষু নর-নারীর আর্ত-নাদের ইতিহাস। বাংলার ইতিহাস এদেশের মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস। এর মধ্যে দিয়ে তিনি পরাধীনতার শৃঙ্খলে বন্দী প্রাকৃত মধ্য বাংলার বাঙালীদের দুর্বিষহ জীবনের তথা এ অঞ্চলের জনগণের উপর পশ্চিম পাকিস্তানীদের নির্মম শোষণ-শাসন ও নির্যাতনের প্রতিচ্ছবি তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। তিনি তার বক্তব্যে আরো উল্লেখ করে বলেন, ‘তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু-আমি যদি হুকুম দিতে না পারি তোমরা বন্ধ করে দিবে।’ এই লাইন দিয়ে তিনি বুঝিয়েছেন পাকিস্তানীদের সাথে আমাদের নায্য অধিকার আদায়ের জন্য জীবন দিয়ে সব কিছু মোকাবেলা করার সময় হয়ে গেছে।
তিনি আরো বলেন, ‘রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দিব। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে চাড়ব ইনশাআল্লাহ।’ তিনি এই শব্দ চয়নের মধ্যদিয়ে এ দেশের জনগণকে ত্যাগ স্বীকার করার জন্য প্রতিশ্রুতবদ্ধ হতে উদ্বুদ্ধ করেন। পরিশেষে তিনি তার বক্তব্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে কথাগুলো বলেন তা হলো,‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ আর এর মধ্যে দিয়েই তিনি স্বাধীনতার বিপ্লবকে পাশ কাটিয়ে প্রকারান্তে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন তথা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের কাছে শোষণমুক্ত সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার কথাই উল্লেখ করেছেন মাত্র। একথা সত্য যে, সেদিন তিনি সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা করেন নি বা করার মতো কোন পরিবেশ-পরিস্থিতি তার ছিল না।
কারণ তিনি ১৯৭২ সালের ১৮ জানুয়ারী ব্রিটিশ এক সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্ট এর কাছে এক সাক্ষাৎকার দেন তাতে সাংবাদিক শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রশ্ন করেন,‘আপনি যদি বলতেন আজ আমি স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ঘোষণা করছি, তো কি ঘটতো ?’ জবাবে শেখ মুজিব বলেন ‘বিশেষ করে এই দিনটিতে আমি এটা করতে চাই নি।’ কেননা বিশ্বকে তাদের (পশ্চিম পাকিস্তানীদের) আমি এটা বলার সুযোগ দিতে চাই নি যে, মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন। শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ বিশ্লেষণে সে দিন স্বাধীনতার ঘোষণা নয় বরং জনগণের স্বায়ত্তশাসনের মধ্য দিয়ে সার্বিক মুক্তির কথা উল্লেখ করেছিলেন মাত্র। কিন্তু স্বাধীনতা উত্তর প্রায় এক দশক পর স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে ঘোলা জলে মাছ শিকারের যে প্রতিযোগিতা চলছে তা অত্যান্ত দুঃখজনক।
স্বাধীনতা ও মুক্তির বিষয়টি আলোকপাত করলে সর্বপ্রথম যে বিষয়টি জনগণের সামনে আসে তা হলো একাত্তরের যুদ্ধ কি মুক্তির ছিল, না-কি স্বাধীনতার, না উভয়ের।

৭ মার্চের সেই জনসভার ভাষণে শেখ মুজিবুর রহমান দু’য়ের কথাই বলেছিলেন। কিন্তু স্বাধীনতা সংগ্রাম আর স্বাধীনতা বিপ্লব বা স্বাধীনতার যুদ্ধ এক কথা নয়। কারণ জননেতা শেখ মুজিব সেদিন স্বাধীনতা বিপ্লবের কথা বলেননি, বলেছেন সংগ্রামের কথা। যে কারণে জনগণ তখন বা স্বাধীনতা উত্তর যুদ্ধের পরও এর পার্থক্যটা খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন নি। তবে পার্থক্য ছিল না তা নয়, পার্থক্য অবশ্যই ছিল। নইলে জিয়াউর রহমানের সময়ে সংবিধানে যে পরিবর্তন আনা হয়েছে তাতে ‘মুক্তি’ সরিয়ে নিয়ে সে জায়গায় ‘স্বাধীনতা’ বসানো হয়েছে কেন ? সংবিধানের এই সংশোধন কি ঐচ্ছিক না প্রয়োজনীয় তা ভেবে দেখতে হবে।
আসা যাক আমাদের আমাদের দেশের প্রথম সংবিধানের প্রস্তাবনার শুরুতে ১ নং অনুচ্ছেদেই বলা হয়েছিল আমরা বাংলাদেশের জনগণ ১৯৭১ খিস্টাব্দের মার্চ মাসের ২৬ তারিখে স্বাধীনতার ঘোষণা করি জাতির মুক্তির জন্য । ঐতিহাসিক সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করিয়াছি। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সালে এক ফরমান বলে সংবিধানের এমন অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় পরিবর্তন করেন। যেমন প্রস্তাবনার উপরে লেখা হয়েছে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’। এবং প্রথম অনুচ্ছেদের যেখানে লেখা ছিল জাতীয় মুক্তির জন্য । ঐতিহাসিক সংগ্রাম এর কথা, সেখানে এ কথা বদল করে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে ‘জাতীয় স্বাধীনতার জন্য ঐতিহাসিক যুদ্ধ।’ শুধু তাই নয় এর পর দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে যেখানে অঙ্গীকারের কথা বলা ছিল সেখানেও জাতীয় মুক্তির সংগ্রাম কেটে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে ‘জাতীয় স্বাধীনতার যুদ্ধ।’ সেই সাথে যোগ করা হয়েছে সর্ব শক্তিমান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থার কথা। আমাদের দেশের প্রথম সংবিধানে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার ছিল বিদ্যমান এবং তার স্থান ছিল জাতীয়তাবাদের পরেই। অর্থাৎ প্রথম অঙ্গীকার জাতীয়তাবাদের, দ্বিতীয় অঙ্গীকার সমাজতন্ত্রের। জিয়াউর রহমান কর্তৃক সংশোধনীতে সমাজতন্ত্র বাদ দেওয়া হয় নি সত্য কিন্তু তা নেওয়া হয়েছে সর্বশেষে এবং সমাজতন্ত্র বলতে কি বুঝানো হচ্ছে তাও বলে দেওয়া হয়েছে। সমাজতন্ত্র অর্থ অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুবিচার। দেশের প্রথম সংবিধানে নাগরিকদের জাতীয়তাবাদ ছিল বাঙালী, সংশোধনীতে তা পরিবর্তন করে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে ‘বাংলাদেশি’।
সংবিধানের দু’টি পাঠ ছিল-একটি বাংলা অপরটি ইংরেজী। সেখানে অর্থের ব্যাপারে বলা হয়েছিল দু’টি পাঠের মধ্যে বিরোধ দেখা দিলে বাংলা পাঠই প্রধান্য হবে। ১৯৭৮ সালের সংশোধনীতে বলা হয়েছে এ ক্ষেত্রে বিরোধ দেখা দিলে ইংরেজী পাঠই প্রধান্য পাবে। এর ফলে সংশোধনগুলো পরস্পর বিচ্ছিন্ন নয় বরং এতে অভিন্ন চিন্তা ধারার প্রতিফলন ঘটে। এতে করে মুক্তি ও স্বাধীনতা যে এক নয় তা স্পষ্ট হয়েছে। এই সংশোধনীতে স্বাধীনতাকে রাজনৈতিকভাবে ভূ-খ- এর স্বাধীনতা ও মুক্তিকে ব্যাপকভাবে আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক তথা শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার কথা উল্লেখ করেছেন। কারণ প্রকৃত অর্থে মুক্তির অর্থ ব্যাপক অর্থাৎ মুক্তি বলতে বুঝাবে জনগণের সার্বিক মুক্তি অর্থাৎ সামাজিক মুক্তি। তাই বলতে দ্বিধা নেই স্বাধীনতার জন্য ‘৭১ এ যে যুদ্ধ হয়েছে তা ছিল জনগণের সার্বিক মুক্তির লক্ষে ভূ-খ-ের স্বাধীনতা আর স্বাধীনতা উত্তর আমরা আজো যে আন্দোলন করে যাচ্ছি তা হলো মুক্তির আন্দোলন অর্থাৎ সামাজিক আন্দোলন। যা মুক্তির সংগ্রাম পর্ব শেষ করে আজ রাজপথে রক্ত ঝড়িয়ে মুক্তির বিপ্লব অধ্যায় পার করছি। ‘৭১ এ আমরা জনগণের সার্বিক মুক্তির লক্ষেই পাকিস্তান রাষ্ট্রের স্বাধীনতা থেকে বের হয়ে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলাম। তা আমরা অর্জন করেছি। কিন্তু এই স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাই একমাত্র আমাদের কাম্য ছিল না। আমাদের মূল লক্ষ্য ছিল জনগণের সার্বিক মুক্তি তথা শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা, ন্যায়বিচার ভিত্তিক সমাজ গঠন, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। সে জন্য সংবিধানের রাষ্ট্রীয় মূলনীতিতে জাতীয়তাবাদের পাশাপাশি সমাজতন্ত্রের উল্লেখ করতে হয়েছে। বলতে হয়েছে ধর্ম নিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্রের কথা। তাই বলতে হয় মুক্তির মূল লক্ষ্যেই স্বাধীনতার প্রয়োজন ছিল। তাই স্বাধীনতা উত্তর সদ্য স্বাধীন দেশে মুক্তির আন্দোলন-সংগ্রাম যখন শুরু হলো তখনই আর এক মহা বিপর্যয় ঘটে। এই আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী স্বাধীনতা উত্তর আওয়ামীলীগ সরকার ও তাদের চেলা-চামুন্ডারা দেশ লুণ্ঠনে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পরে। তাই মুক্তির আন্দোলন শুরু থেকেই আলোর মুখ দেখতে পায় নি। তা আজো বিরাজমান। মুক্তির চেতনায় লড়াইয়ে ‘৪৭ সালের স্বাধীনতা পরবর্তী যদি জনগণ সার্বিক অর্থে আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার পেত তাহলে হয়তো ‘৭১ এর স্বাধীনতার কথা তারা ভাবতো না। আর ৭১ এর স্বাধীনতা উত্তর গঠিত সরকার থেকে যদি জনগণ সার্বিক মুক্তির সাধ পেত তাহলে আমাদের জনগণকে রাজপথে রক্ত ঝড়াতে হতো না। তাই বলতে হয় মুক্তির জন্য জনগণের সংগ্রাম দীর্ঘকালের। এ প্রাকৃত বাংলার জনগণ বহুকাল থেকেই এই সংগ্রাম করে আসছে। অনেক নেতা-নেতৃত্ব এ সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছে। সর্বক্ষেত্রে সবার ভূমিকাও সমান ছিল না বা আজো নেই। তবু সংগ্রাম চলছে। ‘৪৭ সালে প্রচার করা হয়েছিল পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা হলে জনগণের সার্বিক মুক্তি আসবে। কিন্তু তা হলো না কারণ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার এক বছর না যেতেই মুক্তির আন্দোলনের প্রয়োজন দেখা দিল। জনগণ ভেবেছিল ‘৫২ এর ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এটা শেষ হবে, তা হয় নি। প্রকারান্তে রাষ্ট্র বিচ্ছিন্নতার কথা প্রকাশ পায়। ১৯৫৭ সালে এ দেশের রাজনীতির প্রতিষ্ঠান মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী সর্বপ্রথম প্রকাশ্যে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার কথা ঘোষণা করেন ? কিন্তু না সেদিন অনেকেই মাওলানা সাহেবকে কমিউনিস্ট বলেছিলেন। হ্যাঁ, কমিউনিস্ট বলেই ক্ষান্ত হন নি তারা তার বক্তব্যের প্রতিবাদ করেছেন। এমন কি তার গড়া দল আওয়ামীলীগ নেতারাও তার পাশে দাড়ায় নি। স্বাধীনতার প্রশ্নে ‘৭০ এর নির্বাচনের বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। এখানে পাকিস্তানের অখ-তা বজায় রেখে মুক্তির সংগ্রাম ছিল মূখ্য। কিন্তু নির্বাচনের পর বাস্তবতা ছিল অন্যরকম। পাকিস্তানীদের রণনীতির রণ কৌশল বাস্তবায়নে সময়ক্ষেপণ ছিল বাস্তবতার মূল লক্ষ্য। তাই মুজিব-ইয়াহিয়া-ভূট্টোর বৈঠক ছিল সময়ক্ষেপণ ছাড়া আর কিছু না। তাই ২৫ শে মার্চ রাতে পাকিস্তানীরা নিরস্ত্র-নিরীহ জনগণের উপর যে যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছিল তা ছিল ইতিহাসের নজীরবিহীন ঘটনা। ২৫ শে মার্চ রাতে তৎকালীন জনগণের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে নিরীহ নিরস্ত্র জনগণের উপর ঝাপিয়ে পড়ার ঘটনা তথা এই ঘটনার মধ্য দিয়ে পাকিস্তানীদের বর্বরতার নিষ্ঠুর চেতনার আত্মপ্রকাশ ঘটে। এমন পরিস্থিতি মোকাবেলায় দিক নির্দেশনাহীন জাতি-২৫ শে মার্চ রাত হতেই রাজারবাগ পুলিশ লাইন, পিলখানা, ইপিআর, বাঙালী সৈনিক যে যেখানে ছিল-সেখান থেকেই তারা সক্রিয় মোকাবেলা করে। নিরস্ত্র জনগণ যার যার সার্মথ্য নিয়ে পাকিস্তানীদের গতিপথ রোধ করে। তারা রাস্তায় রাস্তায় ব্যাড়িকেড দিয়ে জনগণের জান-মাল রক্ষায় ব্যতিব্যস্ত হয়ে পরে। অপরদিকে বন্দর নগরী চট্টগ্রাম পুরো মার্চ মাস হতেই অশান্ত হয়ে ওঠে। বিশেষ করে ‘৭১ এর ফেব্রুয়ারী মাসের শেষ দিকে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক অবস্থা যখন বিস্ফোরণমুখর হয়ে উঠছিল ঠিক তখন একদিন মেজর জিয়া খবর পেলেন তৃতীয় কমান্ড ব্যাটালিয়নের পাকিস্তানী সৈনিকরা চট্টগ্রাম শহরেরর বিভিন্ন এলাকায় ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে বিহারীদের বাড়ীতে বসবাস করতে শুরু করেছেন। তিনি আরো জানতে পারেন পাকিস্তানী সৈনিক কমান্ডোরা বিপুল পরিমান অস্ত্র-শস্ত্র আর গোলাবারুদ বিহারীদের বাড়ীতে মজুদ করেছে। তাছাড়া তারা রাতের অন্ধকারে বিহারী তরুণ ছেলেদের গোপনে ট্রেনিং দিচ্ছে। এমনি অবস্থায় জিয়াউর রহমান বুঝেছিলেন দেশে ভয়ানক একটা কিছু ঘটতে যাচ্ছে। ১লা মার্চ এনসিওরা গিয়ে জিয়াকে জানিয়েছিলেন প্রতিদিন সন্ধ্যায় বিংশতম বালুচ রেজিমেন্টের জওয়ানরা বেসামরিক পোশাকে রাতের অন্ধকারে কোথায় যেন চলে যায়। জিয়া সংবাদ নিয়ে আরো জানতে পারেন পাকিস্তানী সৈনিকরা বিহারীদের সাথে মিশে গিয়ে তারা রাতের অন্ধকারে বাঙালী ছেলেদের ধরে ধরে মেরে ফেলছে। তখন প্রতিদিন ছুরিকাহত বাঙালী ছেলেদের হাসপাতালে ভর্তি হতে দেখা যায়। এমনি অবস্থায় কমান্ডিং অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেল জানজুয়া মেজর জিয়াউর রহমানের গতি-বিধির উপর লক্ষ্য রাখার জন্য লোক লাগায়। তারা জিয়ার গতি-বিধি লক্ষ্য করেন। এখানে উল্লেখ থাকে দেশের ভিতরে এমন ভয়াবহ পরিস্থিতিতে ও জনগণের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ও ভূট্টোর সাথে বৈঠকের পর বৈঠক করে যাচ্ছেন। সে যাই হোক এমনি পরিস্থিতিতে মেজর জিয়াউর রহমান পাকিস্তানী জওয়ানদের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করার জন্য বাঙালী সৈনিকদের মধ্যে ঐক্য গড়ে তোলার কাজে আত্ম-নিয়োগ করেন। তিঁনি প্রতিদিন বাঙ্গালী সৈনিকদের সাথে গোপনে বৈঠক করে সকলের সাথে পরামর্শ করে জানতে চান পশ্চিম পাকিস্তানীরা যদি তাদের নিরস্ত্র করে তবে তারা কি করবেন। এক পর্যায়ে ক্যাপ্টেন শমসের মবিন ও মেজর খালেকুজ্জামানের কথা বৈঠকে উঠে আসে। জওয়ানদের মধ্যে মেজর শওকত বলেন, ক্যাপ্টেন শমসের ও মেজর খালেকুজ্জামান যদি স্বাধীনতার জন্য অস্ত্র তুলে নেয় তাহলে তারাও দেশের স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিতে কুণ্ঠাবোধ করবেন না। এ সময় ক্যাপ্টেন অলি মাঝে মাঝেই প্রতিদিনের খোঁজ-খবর আদান-প্রদান করতেন। সময় যত দ্রুত গতিতে এগিয়ে যায় জেসিও এবং এনসিওরাও দলে দলে বিভক্ত হয়ে জিয়ার কাছে বিভিন্ন স্থানে জিয়ার সাথে দেখা করেন। জিয়া নিরবে তাদের কথা শুনতেন। ৪ঠা মার্চ জিয়া ক্যাপ্টেন অলি আহম্মেদকে ডেকে নেন এবং বৈঠককের পরবর্তী করণীয় সর্ম্পকে আলোচনা করেন। তিনি বলেন, সশস্ত্র সংগ্রামের সময় শুরু হয়েছে। তাদেরকে সবসময় প্রস্তুত থাকতে হবে এবং সকলকে প্রস্তুত করতে হবে। তিনি আরো বলেন, সবাই যেন এ ব্যাপারে সব সময় সর্তক থাকে। ১৯৭১ সালে ১৭ মার্চ চট্টগ্রাম স্টেডিয়ামে লেফটেন্যান্ট কর্নেল এম আর চৌধুরী, মেজর জিয়া, ক্যাপ্টেন অলি আহম্মেদ ও মেজর আমিন চৌধুরী এক গোপন বৈঠক করেন। তারা লেঃ কর্নেল চৌধুরীকে অনুরোধ করেন এর নেতৃত্ব দিতে। দু’দিন পর ইপিআর এর ক্যাপ্টেন রফিক জিয়ার বাসায় যান এবং ইপিআর বাহিনীকে সঙ্গে নেওয়ার প্রস্তাব দেন। এর মধ্যে দিয়ে ক্যাপ্টেন রফিক তার বাহিনী জিয়ার কর্তব্য কর্মের পরিকল্পনাভূক্ত করেন। এভাবেই চলে এলো ২৫ মার্চের সেই কালো রাত্রি। জাহাজ সোয়াত থেকে অস্ত্র গোলাবারুদ নামানোর জন্য জিয়াকে নৌ-বাহিনীর ট্রাকে করে পাঠানো হলো চট্টগ্রাম বন্দরে। জিয়া বন্দরের দিকে অগ্রসর হলো। বন্দরে জিয়াকে রিসিভ করার জন্য প্রতিক্ষায় ছিল জেনারেল আনসারী। পথে আগ্রাবাদে তাদের থামতে হলো, কারণ পথে ছিল ব্যাড়িকেড। এই সময় সেখানে মেজর খালেকুজ্জামান ক্যাপ্টেন অলির কিছু বার্তা নিয়ে উপস্থিত হলো। জিয়া তখন হাটছিলেন-মেজর খালেকুজ্জামান জিয়াকে একটু দুরে নিয়ে কানে কানে বললেন,‘পাকিস্তানীরা ক্যান্টনমেন্ট ও শহরের মধ্যে সামরিক তৎপরতা শুরু করেছে-এতে বহু বাঙালীকে ওরা হত্যা করেছে। এ কথা শুনে জিয়া তাৎক্ষনিক সিদ্ধান্ত নিলেন এবং বললেন, ‘বিদ্রোহ করলাম’। তুমি ষোল শহরে যাও এবং পাকিস্তানী সেনা অফিসারদেরকে গ্রেফতার করতে বলো। আমি আসছি। জিয়া ট্রাক ঘুড়িয়ে নিল এবং ষোল শহর বাজারে এসে জিয়া গাড়ী থেকে লাফিয়ে নেমে রাইফেল তুলে নিল। পাকিস্তানী অফিসারদের স্যারেন্ডার করতে বললে তারা অস্ত্র ফেলে দিয়ে স্যারেন্ডার করলো। এরপর জিয়া কমান্ডিং অফিসারের জিপ নিয়ে তার বাসায় গেল এবং বাসায় গিয়ে কলিং বেলে টিপ দিতেই কমান্ডিং অফিসার জানজুয়া দরজা খুলেদিল। জিয়া ক্ষিপ্রগতিতে ঘরে ঢুকে কমান্ডিং অফিসারের কলার ধরে বলল-তুমি আমাকে বন্দরে পাঠিয়ে মারতে চেয়েছিলে, এরপর জিয়া কমান্ডিং অফিসার জানজুয়াকে গ্রেফতার করলো। এরপর মেসে এসে কর্নেল শওকতকে ডাকলেন। তাকে জানালেন তারা বিদ্রোহ করেছে। শওকত জিয়ার হাতে হাত মিলালো। তারা ব্যাটালিয়নে ফিরে গেল এবং সকল পাকিস্তানী অফিসারদেরকে গ্রেফতার করে একটি ঘরে তালা বন্ধ করে রাখলো।
পরে জিয়া অফিসে গেলেন এবং লেফটেন্যান্ট কর্নেল এম আর চৌধুরী ও মেজর রফিকের সাথে যোগাযোগ করতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু তাদের সাথে যোগাযোগ হলো না। তারপর রিং করলেন বেসামরিক বিভাগের টেলিফোন অপারেটরকে। তাকে অনুরোধ জানালেন ডেপুটি কমিশনার ডি আই জি ও আওয়ামীলীগ নেতাদের জানাতে যে, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অষ্টম ব্যাটালিয়ন বিদ্রোহ করেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করবে তারা। টেলিফোন অপারেটর সানন্দে জিয়ার অনুরোধ রক্ষা করতে রাজি হলেন। এরপর জিয়া ব্যাটালিয়নের অফিসার জেওসিও জওয়ানদের ডাকলেন এবং তাদের উদ্দেশ্যে সংক্ষিপ্ত ভাষণ দিলেন এবং স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে জওয়ানদের আহবান জানালেন। জওয়ানরা সর্বসম্মতিক্রমে জিয়ার নির্দেশ মেনে নিল। পরে জিয়া তাদের একটি সামরিক পরিকল্পনা দিলেন। তখন রাত ২টা বেজে ১৫ মিনিট। জিয়া পরিকল্পনা মাফিক কয়েকটি ট্রাকে করে ব্যাটালিয়ন ছেড়ে কালুরঘাটের দিকে অগ্রসর হলেন, পথে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের একজন কর্মকর্তা বেলাল আহমেদ জিয়ার গতিপথ রোধ করে তাকে বেতার কেন্দ্রটির নিয়ন্ত্রণভার নেওয়ার অনুরোধ জানালেন। ২৬ শে মার্চ ১৯৭১ দিনটি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে সকল বাঙালীর হৃদয়ে। বেলাল জিয়াকে জাতির উদ্দেশ্যে একটা ভাষণ দিতে বললে জিয়া তাতে রাজি হয়ে যান। এরপর নিজেই কাগজ কলম নিয়ে চিন্তা করে কিছু লিখলেন আবার কাটলেন। এমনি করে কয়েকবার কাটাছিড়া করে বেলালকে বললেন, হ্যাঁ বক্তব্য রেডি। বেলাল তাৎক্ষনিক জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ রাখার জন্য জিয়াকে অনুরোধ করলেন। জিয়া নিজে নিজেকে প্রস্তুত করে জাতির উদ্দেশ্যে বললেন-
“উবধৎ ভবষষড়ি ভৎববফড়স ভরমযঃবৎ’ং-
ও, গধলড়ৎ তরধঁৎ জধযসধহ, চৎড়ারংরড়হধষ চৎবংরফবহঃ ধহফ পড়সসধহফবৎ-রহ-পযরবভ ড়ভ ষরনবৎধঃরড়হ অৎসু ফড় যবৎবনু ঢ়ৎড়পষধরস রহফবঢ়বহফবহপব ড়ভ ইধহমষধফবংয ধহফ ধঢ়ঢ়বধষ ভড়ৎ লড়রহরহম ড়ঁৎ ষরনবৎধঃরড়হ ংঃৎঁমমষব. ইধহমষধফবংয রং রহফবঢ়বহফবহঃ. ডব যধাব ধিমবফ ধিৎ ভড়ৎ ঃযব ষরনবৎধঃরড়হ ড়ভ নধহমষধফবংয. ঊাবৎুনড়ফু রং ৎবয়ঁবংঃবফ ঃড় ঢ়ধৎঃরপরঢ়ধঃব রহ ঃযব ষরনবৎধঃরড়হ ধিৎ রিঃয যিধঃবাবৎ বি যধাব. ডব রিষষ যধাব ঃড় ভরমযঃ ধহফ ষরনবৎধঃব ঃযব পড়ঁহঃৎু ভৎড়স ঃযব ড়পপঁঢ়ধঃরড়হ ড়ভ ঢ়ধশরংঃধহ অৎসু.
ওহংযধষষধয, ারপঃড়ৎু রং ড়ঁৎং.
এটাই ছিল স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রথম ঘোষণা। এরপর এই ঘোষণা খ-ন করে আওয়ামীলীগ নেতারা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীনতার ঘোষণার কথা বললে, জিয়া তাতেও রাজি হন-যা ১৯৭১ সালে ২৭ মার্চ ও ২৮ মার্চ প্রচারিত হয়।
১৪ এপ্রিল ১৯৭১ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার গঠন হওয়ার পূর্ব মুহুর্ত পর্যন্ত জিয়ার নেতৃত্বে দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ পরিচালিত হয়, ইহাই ঐতিহাসিক সত্য।
মূলত ২৬ মার্চ থেকে এই প্রাকৃত মধ্য বাংলা আজকের এই বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিপ্লবের শুরু হয়। তাই বলতে হয় স্বাধীনতা ও মুক্তি এক কথা নয়। মুক্তির অর্থ ব্যাপক, কারণ ১৯৪৭ সালে ৭০০০ মাইলের ব্যবধানে পশ্চিম পাকিস্তানীদের সাথে ধর্মীয় মূল্যবোধে পশ্চিম পাকিস্তানীদের সাথে ঐক্য গড়ে তোলে ব্রিটিশ স¤্রাজ্য থেকে এ দেশ স্বাধীন হলেও মুক্তি পায় নি। তাই এ দেশের জনগণের সার্বিক মুক্তির প্রশ্নে ১৯৭১ সালে ২৬ শে মার্চ যে যুদ্ধ শুরু হয়েছিল তা ছিল এ প্রাকৃত মধ্যবাংলার জনগণের সার্বিক মুক্তির প্রশ্নে স্বাধীনতার বিপ্লব অধ্যায়। স্বাধীনতা যুদ্ধ অর্থাৎ ‘৭১ এর যুদ্ধ ছিল ভূ-খ-ের স্বাধীনতা- যা রাজনৈতিক বিষয়। তাই ১৯৭১ সালে ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনগণের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণে যে মুক্তির বিষয়টি উল্লেখ হয়েছিল তা হলো রাজনৈতিকভাবে পাকিস্তানের স্বার্থ সংরক্ষণ করে স্বায়ত্তশাসনের মধ্য দিয়ে জনগনের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করা অন্যথায় ভ-ূখ-ের স্বাধীনতা অর্জনের পর পরবর্তী অধ্যায়ের কথা। কিন্তু সে দিন শেখ মুজিবুর রহমান তার ১৯ মিনিটের ভাষণের কোথাও স্বাধীনতার বিপ্লবের আহবান জানাননি। মূলত তার বক্তব্যে ‘৭০ সালের নির্বাচনকালীন সময়ে আওয়ামীলীগের পক্ষ থেকে প্রকাশিত ও প্রচারিত ইশতেহারের কথাই পুনঃব্যক্ত করেছিলেন মাত্র। তবে তিনি জনগণকে যে কোন পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রস্তুত থাকতে বলেছিলেন।
যাই হোক ‘৭১ এর যুদ্ধ কি ‘মুক্তির যুদ্ধ ছিল, না-কি স্বাধীনতার, না উভয়ের তা বিশ্লেষণের বিষয়।
বিশ্লেষণে পাওয়া যায় মুক্তি ও সংস্কৃতি হাত ধরাধরি করে চলে বলেই এর অতীত আছে আর অতীত আছে বলেই বর্তমান পেরিয়ে ভবিষ্যতের পানে এগিয়ে যেতে যে স্তরগুলো অতিক্রম করতে হয় তা হলো স্বাধীনতার জন্য। স্বাধীনতার আন্দোলন স্তর যেমন ‘৫২ থেকে ৬২ সাল, তেমনি স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম স্তর হলো ‘৬২ থেকে ৬৯ সাল। ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়েই পাকিস্তানীদের বিদায় জানানো হয়েছিল। ‘৭০ এর নির্বাচন পরবর্তী সময় ‘৭১ এর ২৫ শে মার্চ রাত ১২ টা পর্যন্ত হলো গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সংগ্রামের শুন্য নিয়ম। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে স্বাধীনতার চার দশক পর মুক্তি ও স্বাধীনতা যে এক কথা নয় তা পার্থক্য করা হয় নি।
স্বাধীনতা উত্তর জনগণের সার্বিক মুক্তির জন্য প্রয়োজন স্বাধীনতা যুদ্ধের স্তর আসতে যে কয়টি স্তর অতিক্রম করতে হয়েছিল ঠিক অনুরূপ মুক্তির জন্য সদ্য স্বাধীন দেশে মুক্তির আন্দোলন, সংগ্রাম ও মুক্তির বিপ্লব। যা সর্বজন মতামতের ভিত্তিতে শুরু হওয়ার কথা। কিন্তু স্বাধীনতা উত্তর দলীয় সরকারের রাজনৈতিক সংস্কৃতির কারণে তা বাধাগ্রস্থ হয়। এ বিষয়ে স্বাধীনতা উত্তর বামপন্থি নেতা অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমেদ সর্বদলীয় মতামতের ভিত্তিতে সরকার পরিচালনার কথা উল্লেখ করলেও আওয়ামীলীগের দলীয় সরকার তা গ্রহণ করে নি।
স্বাধীনতা পরবর্তীতে আওয়ামী দলীয় সরকারের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক কোন্দলে তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পদ থেকে খন্দকার মোশতাককে বাদ দিলে এবং তার স্থলে আঃ সামাদ আজাদকে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দ্বায়িত্ব দিলে রাজনৈতিক সংস্কৃতির পাতা উল্টো পথে হাটে। দেশ সম্ভাব্য গৃহযুদ্ধের দিকে যেতে থাকলে ১০ই জানুয়ারী ১৯৭২ সালে শেখ মুজিবুর রহমান দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। এ যাত্রায় দেশ সম্ভাব্য গৃহযুদ্ধের হাত থেকে রক্ষা পেলেও মোশতাক তা কোনদিন ভুলেননি।
বলতে দ্বিধা নেই জনগণের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান দেশে প্রত্যাবর্তনের পর সর্বস্তরের জনগণ তার কাছে অনেক কিছুই আশা করেছিল। ভেবেছিল এবার হয়তো সার্বিক মুক্তি আসবে কিন্তু না দেশ আরো ভয়াবহ অবস্থায় নিপতিত হয়। নব্য স্বাধীন দেশে যখন চোরাচালান, মারমিট, লুটতরাজ, হত্যা, গুম, নারীধর্ষণ, হ্যাইজাক, চুরি-ডাকাতি, ক্ষুধা-দারিদ্র্য মানুষকে অতিষ্ট করে তোলে। লজ্জা নিবারণে মা-বাবা যখন মেয়েকে কাপড় দিতে পারে না। ক্ষুধার যন্ত্রণায় যখন মানুষকে ডাস্টবিনের ময়লা টুকিয়ে টুকিয়ে খেতে হয়, যখন মানুষের লাশ কাপড়ের অভাবে ভেলায় ভাসিয়ে দিতে হয়। বাবা তার মেয়েকে অন্যের হাতে তুলে দেয়। এটাই মুজিব শাসনের চরম বিপর্যয়। তখন থেকেই জনগণের সার্বিক মুক্তির বিষয়টি পাশ ফিরে কাঁদে।
স্বাধীনতা উত্তর ১৯৭২-৭৫ সালের ভয়াবহ চিত্র মনে পড়লে মানুষের মনে অজোয় ভীতির সঞ্চার করে আওয়ামীলীগ সরকারের ভিতরে ঘুমটি মেরে থাকা লুটেরারা দলের লুট-তরাজ দেশময় এক ভয়াবহ অবস্থা বিরাজ করে। তাছাড়া রয়েছে অভ্যন্তরীণ দলীয় কোন্দল। সিরাজ সিকদার ও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রী আর্দশ বাস্তবায়নে সৃষ্ট গণবাহিনীর তা-ব। এহেন দুরাবস্থা ঠেকাতে রক্ষীবাহিনীর অত্যাচার-নির্যাতনে বে-পরোয়া ক্ষমতা দিয়ে আইন শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে আনতে রক্ষিবাহিনী সৃষ্টি করে শেখ মুজিব সরকার হাজার হাজার সাধারণ মানুষসহ বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মীদের নির্বিচারে হত্যা করে। এতে করে দেশময় এক অরাজক অবস্থার সৃষ্টি হয়। শেখ মুজিব ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে একদল বাকশাল সৃষ্টি করে।
এমনি এক অরাজক অবস্থায় নেতা মুজিব ১৯৭৪ সালের ২৮ শে ডিসেম্বর দেশময় জরুরী অবস্থা জারি করেন। দেশময় দুর্ভিক্ষ ঠেকাতে সরকার ৪৩০০ ইউনিয়নের ৫৭০০ লঙ্গরখানা খুলেও সেখানে পর্যাপ্ত কোন খাদ্য দিতে পারেন নি। এর মধ্যে চোরাকারবারী, মজুতদারী নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার তখন দেশময় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষাবস্থা চলছিল। এরই মধ্যে মানুষ ক্ষুধা-দারিদ্র্যতার কারণে না খেতে পেয়ে মৃত্যুর প্রহর গুনে তাতে করে আইন শৃঙ্খলার চরম অবনতি ঘটে।
কোন ঘটনাই বিচ্ছিন্ন কোন ঘটনা নয়। প্রত্যেকটি ঘটনার পেছনে রয়েছে কোন না কোন একটি ঘটনা যা নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। এমন কোন ঘটনা যা বাদ দিয়ে ইতিহাস রচনা হয় না। এমন কোন ঘটনার সুত্র ধরেই জনগণের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ‘১৯৭৫ সালের ২৫ শে জানুয়ারী সরকার পরিচালনায় পার্লামেন্টারী পদ্ধতি হতে পরিবর্তন এনে প্রেসিডেন্সিয়াল পদ্ধতির সরকার গঠন করেন।
দেশের দুর্ভিক্ষতা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় রক্ষীবাহিনী সৃষ্টি করে। সেই বিশেষ রক্ষিবাহিনীর কর্মকা-ের কারণে দেশে যে অবস্থা সৃষ্টি হয়-সেই অবস্থার কথা যাতে দেশ-বিদেশে প্রচার না হতে পারে এর জন্য জন নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ইত্তেফাক, বাংলার বাণী, দৈনিক বাংলা ও অবজারভার পত্রিকা রেখে সকল পত্রিকার ডিক্লারশিপ বাতিল করে দেন।
এমনি ভয়াবহ অবস্থায় শেখ মুজিব ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করতে দেশের সকল রাজনৈতিক দলের কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। শুধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে ৭ জুন ১৯৭৫ সালে ‘বাকশাল’ অর্থাৎ ‘বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক লীগ’ নামে নতুন দল গঠন করে সকলকে এই দলের সদস্য হওয়ার নির্দেশ দেন। এমনি অবস্থায় তিনি প্রশাসনকে দলীয়করণের লক্ষে ৬১ জেলায় ৬১ জন গর্ভনরের পদ সৃষ্টি করে ৬১ জেলায় ৬১ জন গভর্ণর নিয়োগ দেন এবং ২১ জুলাই শেখ মুজিবুর রহমান জেলা গর্ভনরদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন এবং ১লা সেপ্টেম্বর ১৯৭৫ সাল থেকে জেলা গর্ভনরদের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সময় নির্ধারণ করেদেন।
সমকালীন সময়ে মুজিব শাসনের রাজনীতির সংস্কৃতি এমন পর্যায়ে যায যে, বামপন্থি সিরাজ সিকদারের চোরাগোপ্তা হামলা, লুণ্ঠন ও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রী গণবাহিনী খুঁজতে রক্ষীবাহিনী লেলিয়ে দেওয়ার নিরীহ জনগণের উপর অত্যাচার, নির্যাতন, গুম, খুনের কারণ ঘটে। রক্ষীবাহিনী ও বামপন্থি নকশাল বাহিনীর ভয়ে মানুষ গ্রাম ছেড়ে নানা জায়গায় স্থান করে নেওয়া ছিল নিত্য দিনের ঘটনা। এহেন অত্যাচার নির্যাতন শহ্য করতে না পেরে ও সেই সাথে মানুষ ক্ষুধা-দারিদ্য্রের যন্ত্রণায় ছোট-বড় সব শহরে গমন করে। এক মুঠো অন্ন যোগাতে মানুষ হন্নে হয়ে ঘুরে বেড়ায়। এরই মাঝে শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকা শহর পরিচ্ছন্নতার নামে ছিন্নমূল মানুষের জন্য ঢাকার অদুরে ৫টি ক্যাম্প তৈরি করে ২,৫০,০০০ লোককে স্থান দেয়। কিন্তু সেখানে না ছিল খাওয়া-দাওয়া, না ছিল পানি বা আলো-বাতাসের ব্যবস্থা। রাত হলে ক্ষুধা-দারিদ্র্যতা নিয়ে অন্ধকারে এপাশ-ওপাশ করে কাটাতে হতো প্রতিটি প্রহর। এমনি অবর্ণনীয় অবস্থা ঠেকাতে মুজিব সরকার চোরাকারবারী, মজুতদার ঠেকাতে রাস্তায় সেনা বাহিনী তলব করে। কিন্তু সবখানে যারাই ধরা পরে তারাই আওয়ামীলীগের রুই-কাতলা। স্বাধীনতা উত্তর এই প্রথম সেনাবাহিনী দেশের ভয়াবহ অবস্থা প্রত্যক্ষ করে। অপরদিকে শেখ মুজিব নিজের ক্ষমতা আরো সুদৃঢ় করতে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করে দেশময় জরুরী অবস্থা ঘোষণা ও সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ঘোষণা করে এবং ‘কৃষক-শ্রমিক আওয়ামীলীগ’ অর্থাৎ সংক্ষেপে ‘বাকশাল’ নামক একটি সংগঠন তৈরি করেন- যার সদস্য হবেন এদেশের আপামর জনগণ। এছাড়া সংবাদপত্র যাতে বাধ সাধতে না পারে সেই জন্য দেশের ৪টি সংবাদপত্র রেখে সকল পত্রিকার ডিক্লারেশন বাতিল করেন।
পরবর্তীতে ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ গভীর রাতে সেনাবাহিনীর একদল বিপদগামী সদস্য দ্বারা শেখ মুজিব ও তার পরিবার কতোক সদস্য নিহত হন। তার ভ্রাতা, বোন জামাই, শেখ ফজলুল হক মনিসহ সকলকে নির্মমভাবে হত্যা করে (ইন্না লিল্লাহি ওয়া……..রাজিউন)। এমন হৃদয় বিদারক পরিস্থিতিতে শেখ মুজিবুর রহমানের এক কালের সহচর খন্দকার মোশতাক আহম্মেদ সরকারের দ্বায়িত্বভার গ্রহণ করে নিজেকে রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত করেন। আওয়ামীলীগের মন্ত্রিসভার সদস্যদের নিয়ে মন্ত্রিপরিষদ গঠন, একই পার্লামেন্ট চালু করে মোশতাক এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।
তাতে করে জনগণের ধারণার পরিবর্তন আসে। কারণ মোশতাক ক্ষমতা গ্রহণ করার পর জনগণ আরো মনে করে তিনি স¤্রাজ্যবাদের প্রতিনিধিত্ব করছেন। তাছাড়া মোশতাক সংবিধানের ৪ টি মূলনীতি ও মৌলিক বিষয়গুলো বাদ না দিয়ে আওয়ামীলীগের সংসদীয় কমিটি ও মন্ত্রিপরিষদের প্রায় সকল সদস্যদের নিয়ে এগুতে গিয়ে রাজনীতিকে জটিল করে তোলেন। তার উপর দেশ পরিচালনায় বঙ্গভবনে অবস্থানরত ৪ মেজরের কূট-কৌশলের কাছে রাজনীতি জিম্মি হয়ে পরে। তাতে করে সেনাবাহিনীর চেইন অব কমান্ড একদম ভেঙ্গে যায় এবং সেনাবাহিনীর মধ্যে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের জন্ম নেয়।
খন্দকার মোশতাক এই বিশ্বাস-অবিশ্বাসের মধ্য দিয়ে চলতে গিয়ে মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই কট্টর আওয়ামীলীগ পন্থি সেনা অফিসার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খালেদ মোশাররফ কর্তৃক ৩ রা নভেম্বর এক সেনা অভ্যুত্থানের সম্মুখীন হন। পরবর্তীতে জেনারেল খালেদ মোশাররফ নিজেকে সেনা প্রধান হিসেবে ঘোষণা করেন এবং জেনারেল জিয়াকে পদত্যাগে বাধ্য করে তাকে গৃহবন্দি করেন। অতঃপর খালেদ মোশাররফ খন্দকার মোশতাককে রাষ্ট্রপতির পদে থেকে কাজ করার অনুরোধ করলে মোশতাক তা প্রত্যাখান করেন। অতঃপর স্বাধীনতার সমকালীন সময়ের মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক সেনা প্রধান জেনারেল ওসমানীর মধ্যস্থতায় বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমকে রাষ্ট্রপতির দ্বায়িত্ব অর্পণ করেন। কিন্তু জেলখানায় ৪ নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহম্মেদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামরুজ্জামান বঙ্গভবনে অবস্থানকারী একদল সেনা সদস্য দ্বারা নিহত হলে খালেদ মোশাররফ দিক নির্দেশনাহীন হয়ে পড়েন। তাছাড়া ৪ঠা নভেম্বর কতোক বামপন্থি রাজনৈতিক দলের কতোক সদস্যসহ খালেদ মোশাররফ এর মা ও ভাই আধিপত্যবাদীদের সহযোগিতা চেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলা থেকে মিছিল বের করে শাহবাগের দিকে অগ্রসর হলে জনগণ তা বুঝতে পারে। এরই মধ্যে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রীরা বসে না থেকে তারা কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে সেনা বাহিনীর মধ্যে লিফলেট বিতরণ করেন। অর্থাৎ খালেদ মোশাররফের মা ও ভাইয়ের নেতৃত্বে ভারতীয় আাধিপত্যবাদী শক্তিকে সহযোহিতা করার আহবান জানানোর কারণে সেনাবাহিনী ও জনগণের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। এরই মধ্যে ক্যান্টনমেন্টে চেইন অব কমান্ড ভেঙ্গে পরে। সাধারণ সৈনিকরা খালেদ মোশাররফের ক্যু-কে সন্দেহের চোখে দেখে এবং তারা ঐক্যবদ্ধ হয়। ৬ নভেম্বর দিবাগত রাত অর্থাৎ তারা ৭ নভেম্বর প্রথম প্রহরে ক্যান্টনমেন্ট হতে ট্যাঙ্ক-কামান নিয়ে বেরিয়ে পরে এবং একদল সৈনিক তাদের প্রাণের নেতা জেনারেল জিয়াকে গৃহবন্দি হতে মুক্ত করে। এই পাল্টা ক্যু-তে জেনারেল খালেদ মোশাররফ নিহত হন। এই হলো স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। এ অবস্থায় জনগণের দীর্ঘদিনের ইচ্ছা-আকাঙ্খার ফসল মুক্তি নামের বিষয়টি দুরে-বহুদুরে চলে যায়।
ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয় না এটাই হলো আমাদের রাজনীতিবিদদের বড় রাজনৈতিক ইতিহাস। মুক্তি ও স্বাধীনতা অধ্যায়ের গুরত্বতা বিবেচনায় ৭ নভেম্বরের করুণ ইতিহাসই প্রমাণ করে জনগণের সার্বিক মুক্তির প্রকৃত ইতিহাস। রাজনৈতিক সংস্কৃতির দাবানলে পদপৃষ্ট হয়ে ভরসাহীন হয়ে পরে আছে।
জেনারেল জিয়া গৃহবন্দি হতে মুক্ত হয়ে দ্বায়িত্ব নিয়ে জনগণের কাছে দেশের উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দেন।
কর্নেল তাহের গ্রুপ ৮ নভেম্বর সকালে দেশময় অরাজকতা সৃষ্টি করতে চায়। তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী জেনারেল জিয়া ভক্ত ১২ জন সেনা অফিসারকে তারা হত্যা করে। অনেক সেনা অফিসারের কাজ কেড়ে নেয় ও অফিসার কোয়ার্টারে লুটপাট চালায়। এমনকি তারা জাসদ পন্থি গণবাহিনী লোকদের সেনানিবাসে নিয়ে আসে। তারা জিয়া পন্থি অফিসারদেরও গ্রেফতারের নির্দেশ দেয়। কর্নেল তাহেরের এমন নির্দেশে তাহের পন্থিদের মাঝেও মতবিরোধ সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে মেজর জলিল তাহেরের এহেন কর্মকা-ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন। কর্নেল তাহের ২৩ শে নভেম্বর সারাদেশে সর্বাত্মক অভ্যুত্থানেরও পরিকল্পনা করে। কিন্তু এ সংবাদ প্রকাশ হলে কর্নেল তাহের ও তার অনুসারীদের গ্রেফতার করা হয়। সেই সাথে বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ইতিহাসে আরো একটি ঝঞ্চাবহুল দিন পার করতে হয় জিয়াকে।
৮ নভেম্বর প্রেসিডেন্ট আবু সাদাত মোঃ সায়েম এক ঘোষণা বলে তার সরকার একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ ও অন্তর্বতীকালীন সরকার বলে ঘোষণা করেন। সেই সাথে তিনি ১৯৭৭ সালে ফেবব্রুয়ারী মাসে দেশে সাধারণ নির্বাচন করার ঘোষণা প্রদান করেন।
১৯৭৬ সালের ২৮ জুলাই রাজনৈতিক দল-বিধি পলিটিক্যাল পার্টিজ রেগুলেশন পিপিআর প্রণয়ন করে এর আওতায় রাজনৈতিক দলগুলোও রাজনৈতিক তৎপরতা চালানোরও অনুমতি প্রদান করেন। ১৯৭৬ সালের ২৯ নভেম্বর জেনারেল জিয়াউর রহমান প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দ্বায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম স্বাস্থ্যগত কারণে পদত্যাগ করলে জেনারেল জিয়াউর রহমান প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন।
প্রেসিডেন্ট জিয়া ক্ষমতা গ্রহণ করার পরই তিনি জনগণের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক অধিকার ফিরিয়ে আনতে প্রথম ২২ এপ্রিল জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে নিজে ও তার প্রশাসনকে কাজে লাগানোর তিনি প্রতিশ্রুতি দেন।
জনগণের ক্ষমতা জনগণের দ্বার গোড়ায় নিতে তিনি একই বছর জানুয়ারী মাসে দেশের ৪৩৫২ টি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন ও নির্বাচিত মেম্বার, চেয়ারম্যানদের ক্ষমতা বৃদ্ধি ও তাদের জন্য সম্মানী ভাতা ১০০ টাকার পরিবর্তে ৩০০ টাকায় উন্নতি করেন। ১৯৭৭ সালের ৩০ শে এপ্রিল জিয়াউর রহমান তার নীতি-আদর্শ বাস্তবায়ন ও জনগণের সার্বিক মুক্তির লক্ষে ব্যাপকভিত্তিক উন্নয়নে ১৯ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন।
প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান নিজের প্রতি জনগণের আস্থা আছে কি-না তার জন্য ১৯৭৭ সালে ৩০ মে প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকদের সরাসরি হ্যাঁ-না ভোটে ৯৮.৮৮% ভোট পেয়ে তার প্রতি জনগণের আস্থা যাচাই করে নেন। পরবর্তীতে তিনি ১৯৭৭ সালে আগস্ট মাসে ৭৭ টি পৌরসভা ও একটি পৌর কর্পোরেশন নির্বাচন সমাপ্ত করেন।

প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান এখানেই ক্ষান্ত না থেকে ১৯৭৮ সালের ২৮ শে এপ্রিল প্রেসিডেন্ট নির্বাচন পদ্ধতি অধ্যাদেশ ১৯৭৮ জারি করেন। সেই সাথে ৩ রা জুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পথকে সুগম করতে ২৪ শে এপ্রিল থেকে সকল রাজনৈতিক তৎপরতা থেকে বিধি-নিষেধ তুলে নেন। এ নির্বাচনে তিনি জাতীয়তাবাদী দল গঠনের পূর্বে জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টের প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করেন। তার প্রধান প্রতিদ¦ন্দ্বি ছিলেন স্বাধীনতা যুদ্ধের সর্বাধিনায়ক গণ-ঐক্যজোটের প্রার্থী জেনারেল এম এ জি ওসমানী। এভাবেই জিয়াউর রহমান জনগণের বহুদিনের ইচ্ছা-আকাঙ্খা, তাদের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক উন্নয়নে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। এই ভোটে প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ৫৩.৫৪% প্রদত্ত ভোটের মধ্যে ৭৬.৬৩ ভাগ ভোট পেয়ে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হিসেবে ১২ জুন ১৯৭৮ বঙ্গভবনে এক মনোরম অনুষ্ঠানে শপথ গ্রহণ করেন।
প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান জনগণের সরাসরি ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর ১৯৭৮ সালের ১লা সেপ্টেম্বর জাগদল বিলুপ্ত করে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল গঠন করেন। জেনারেল জিয়া গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে ১৯৭৮ সালে ২৪ শে এপ্রিল থেকে সকল রাজনৈতিক তৎপরতা থেকে আরোপিত বাধা নিষেধ তুলে নেয় এবং ১৭ নভেম্বর থেকে এক ঘোষণায় মুজিব সরকারের একদলীয় শাসন বিধি বাতিল করে বহুদলীয় গণতন্ত্রের পথ রচনা করেন।
প্রেসিডেন্ট জিয়া ১৯৭৮ সালের ২৭ শে জানুয়ারী জাতীয় সংসদের নির্বাচনের কথা ঘোষণা করেন। সে সময় বিরোধী রাজনৈতিক দল আওয়ামীলীগ, মুসলিমলীগ, জাতীয়লীগ, কমিউনিস্ট পার্টি নির্বিশেষে অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত নেয়। এরপর সকলের সাথে আলাপ-আলোচনা করার পর ১৯৭৯ সালের ১১ ফেব্রুয়ারী পরে ১৮ ফেব্রুয়ারী নির্বাচনের দিন ধার্য করা হয়।
ওই নির্বাচনে বিএনপি ২৯৮ জন, আওয়ামীলীগ (মালেক) ২৯৫ জন, আওয়ামীলীগ (মিজান) ২৯২ জন, মুসলিমলীগ ও ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগ ২৬০ জন, জাসদ ২৪০ জন, ন্যাপ (মোজাফফর) ৮৯ জন, গণফ্রন্ট ৪৬ জন, ন্যাপ (রহমান) ৩৭ জন, ন্যাপ (নাসের) ২৮ জন, সাম্যবাদী দল (তোয়াহা) ১৯ জন, ন্যাপ বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক আন্দোলন ১৮ জন ও জাতীয় দল ১৪ জনকে এমপি পদে মনোনয়ন দেন।
এই অবধি নির্বাচনে বিএনপি ধানের শীষে ২০৭ আসনে, আওয়ামীলীগ নৌকা মার্কায় ৩৯ আসনে জয়লাভ করেন। পরবর্তীতে ১৯৭৯ সালের ২রা এপ্রিল দ্বিতীয় জাতীয় সংসদের অধিবেশন বসে। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এভাবেই একদলীয় শাসন ব্যবস্থা থেকে দেশকে গণতন্ত্রের পথে এগিয়ে নিয়ে যান।
তিনি আধিপত্যবাদী শক্তির হাত থেকে দেশ রক্ষায় সামরিক বাহিনীকে শক্তিশালী করে গড়ে তুলতে নতুন ডিভিশন গঠন করেন। চোরা-চালান রোধ ও আইন শৃঙ্খলা রক্ষায় প্যারা মিলিটারী বাহিনী যেমন-পুলিশ, বিডিআর, আনসার ইত্যাদি বাহিনীকে শক্তিশালী করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন এবং এটাকে জনগণের সেবক হিসেবে গড়ে তুলতে চেষ্টা নেন। নারীর উন্নয়নে এই সকল বাহিনীতে নারী সদস্য অর্ন্তভূক্তি করেন। তিনি সীমান্তে চোরা-চালান বন্ধে ও দেশে অস্ত্র উদ্ধারে সশস্ত্রবাহিনীকে কাজে লাগান। জনগণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বাংলাদেশী রাজনৈতিক দর্শনের ভিত্তিতে জাতীয়তাবোধ সৃষ্টির মাধ্যমে বিভিন্ন প্রকার অর্থনৈতিক কর্মসূচি প্রণয়ন করেন।
গ্রাম উন্নয়নের মাধ্যমে বেকার ও যুব সমাজকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন প্রকার প্রকল্প গ্রহণ করেন। দেশকে শিল্পোন্নত দেশে পরিণত করতে দেশী শিল্পের প্রসার ঘটিয়ে বেকার যুবক-যুবতীদেরকে কাজে লাগাতে ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প প্রতিষ্ঠা ও পোশাক শিল্পের বিকাশ সাধন করেন। জনশক্তিকে কাজে লাগিয়ে বিদেশে শ্রম বাজার তৈরি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন জিয়ার সমাজ উন্নয়নের পথকে সুগম করে। বিশেষ করে দেশকে খাদ্যে সয়ংসম্পূর্ণ করতে খালকাটা কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেন। বিপর্যস্ত আইন-শৃঙ্খলা উন্নয়নে তথা চুরি-ডাকাতি, রাহাজানি বা রাজনৈতিক খুনাখুনি বন্ধ করতে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। সমাজ উন্নয়নে সকলের ঐক্য আবশ্যক। তাই তিঁনি জনগণকে উন্নয়নের কাজে সম্পৃক্ত করার লক্ষে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কারণে যে গণতন্ত্রের মৃত্যু ঘটেছিল সেই গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে অবাধ নির্বাচনের ব্যবস্থা করেন। তাতে করে আওয়ামীলীগসহ দেশের সকল নিষিদ্ধ রাজনৈতিক দল রাজনীতি করার অধিকার ফিরে পায়। তাতে করে মানুষের বাক-স্বাধীনতা তথা একদলীয় শাসন ব্যবস্থার ফলে যে সকল মানুষ কথা বলতে সাহস পেত না, তারা নির্দিধায় সমাজ উন্নয়নে নিজেদের কথা বলার অধিকার পায়। তাতে করে দেশে কর্মবিমুখ মানুষ উৎপাদনের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করতে পারে।
জনগণের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হিসেবে দ্বায়িত্ব পালনে তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। তিনি দুঃখী-দরিদ্র মানুষের পাশে দাড়াতে গ্রাম থেকে গ্রামে ঘুড়ে বেড়িয়েছেন। তার এই মানব দরদ শুধু দেশের জন্যই নয় সারা বিশ্বের সকল নিপীড়িত নির্যাতিত ও দারিদ্র্যক্লিষ্ট মানুষের দ্বার পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল। তিনি ওআইসিভুক্ত দেশগুলোর সমস্যা সমাধানে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন এবং দক্ষিণ এশীয় ফোরাম সার্ক গঠন করে ভ্রাতৃ-প্রতিম দেশগুলোর ঐক্য গড়ে তুলতে অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। তার অক্লান্ত পরিশ্রমে দেশ খাদ্যে সয়ংসম্পূর্ণ হয়ে বিদেশে চাল রপ্তানীর ব্যবস্থা করেন। দেশ এক ভয়াবহ দুরাবস্থা থেকে মুক্ত হয়ে অর্থনৈতিকভাবে নিজের পায়ে দাড়াতে শিখে। তাই দেশের আয় প্রবৃদ্ধি অর্থাৎ জিডিপি ৭.৫-এ দাড়ায়। তাই একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ব্রিটিশ-ভারতীয় ২০০ বছরের গোলামীর ইতিহাস ২৪ বছরের নিজ দেশের পরাধীনতার ইতিহাস, মুজিব শাসনের দুঃসময়ের সকল ইতিহাস মুছে দিয়ে জিয়াউর রহমান এ প্রাকৃত মধ্য বাংলা আজকের বাংলাদেশের মানুষের বহুকাঙ্খিত সার্বিক মুক্তির প্রশ্নে কিছুটা আলোর মুখ যখন দেখান তখনই ১৯৮০ সালের ৩০ শে মে সেই চট্টগ্রামের সার্কিট হাউজে জাতিক-আর্ন্তজাতিক ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে কতোক বিপথগামী সেনা কর্তৃক অকালে মৃত্যুবরণ করেন।
আর তখন থেকেই আবার জনগণ মুক্তির সুবিধাবঞ্চিত হতে থাকে। পরবর্তীতে আপসহীন নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া বারংবার আপ্রাণ চেষ্টা করেও দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রের কারণে জনগণের সেই কাঙ্খিত মুক্তির সাধ দিতে ব্যর্থ হন। দেশ এক গভীর ষড়যন্ত্রের মাঝে নিপতিত হয়ে এখন অন্ধকারাচ্ছন্ন জীবন-যাপন করছে। গণতন্ত্র এখন পুনঃরায় একদলীয় শাসন ব্যবস্থার অধীনে নিমজ্জিত। মানুষের বাক-স্বাধীনতা নেই, রাজপথে মানুষ কথা বলতে গিয়ে বিনা-বিচারে পুলিশের গুলি খেয়ে মৃত্যুবরণ করছে। গুম-খুন-হত্যা আজ নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার। ইয়াবা বা নেশাগ্রস্থ ঔষধের অবাধ চোরাচালানে দেশের যুব সমাজকে ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে। সমাজের এমন অবক্ষয় প্রতিদিন পত্রিকায় শোভা পাচ্ছে।
মানুষ যে সার্বিক মুক্তির জন্য স্বাধীনতা যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছিল। সেই স্বাধীনতার মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ভূ-লুণ্ঠিত হয়ে জনগণের সার্বিক মুক্তি তথা মানুষের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক উন্নয়নের পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। তাই আজ জিয়াউর রহমানের স্বপ্ন বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে মানুষের বহুকালের ইচ্ছা-আকাঙ্খা তথা জনগণের সার্বিক মুক্তির প্রশ্নে আজ যে লড়াই চলছে তা বাস্তবায়নে জনগণকে আরো ত্যাগ স্বীকার করতে হবে অর্থাৎ অগণতান্ত্রিক সরকারকে হঠাতে আন্দোলন-সংগ্রাম চালিয়ে যাওযার বিকল্প কোথায় ? বলতে দ্বিধা নেই যতোদিন পর্যন্ত এ অগণতান্ত্রিক সরকারের পতন না ঘটবে এবং প্রকৃত গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা না হবে ততোদিন পর্যন্ত জনগণের সার্বিক মুক্তি আসতে পারে না। তাই আজ সকলকে ঐক্যবদ্ধভাবে এই অগণতান্ত্রিক সরকারের পতন ঘটিয়ে জনগণের নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠা করার আন্দোলন চালিয়ে যেয়ে তা বাস্তবায়ন করা বাঞ্ছনীয় বলে গণ্য হবে। তাহলেই গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করবে এবং শহীদ প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের স্বপ্ন ‘জনগণের সার্বিক মুক্তি’ প্রতিষ্ঠালাভ করবে এবং এ দেশের স্বাধীনতার মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত হবে।

Recent Posts