স্বাধীনতার ঘোষণা : ইতিহাসের সাক্ষী

ড. কর্নেল (অব.) অলি আহমদ, বীর বিক্রম, এমপি

১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের প্রথম সার্বজনীন প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকারের ভিত্তিতে সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল আওয়ামী লীগের প্রত্যাশার চেয়েও ভালো হয়। তারা পূর্ব পাকিস্তানের ১৬২টি আসনের মধ্যে ২টি ছাড়া বাকি ১৬০টি আসনে জয়লাভ করে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। শেখ মুজিব নির্বাচনের ফলাফলকে কার্যত সংসদীয় গণতন্ত্রে ক্ষমতার রদবদল হিসেবে ব্যাখা করেন। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান শাসনতন্ত্র প্রণয়নের জন্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্ববান করেন যা ক্ষমতা হস্তান্তরকে সহজতর করবে। সবকিছু যখন শান্তিপূর্ণভাবে অগ্রসর হচ্ছিল এবং স্বাভাবিক দেখা যাচ্ছিল, তখন অধিবেশনে যোগ দিতে জুলফিকার আলী ভুট্টোর অনিচ্ছার কথা উল্লেখ করে ১৯৭১ সালের ১ মার্চ ইয়াহিয়া খানের অধিবেশন স্থগিতের ঘোষণা ছিল উস্কানিমূলক। এই ঘোষণা পূর্ব পাকিস্তানে স্বতঃফূর্ত বিক্ষোভের আগুন ছড়িয়ে দেয়। পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতি সচেতন মানুষ; বিশেষ করে ছাত্র, শ্রমিক, শিক্ষিত সমাজ এবং পেশাজীবীদের কাছে ছয় দফা আন্দোলন এক দফা আন্দোলনে রূপ নেয়। এই এক দফা হলো পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা। শেখ মুজিবর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণার জন্য তার নিজ দল আওয়ামী লীগ এবং পূর্ব পাকিস্তানের অন্য রাজনৈতিক নেতাদের পক্ষ থেকে প্রচন্ড চাপের সম্মখীন হন। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঢাকায় প্রায় ১০ লাখ লোকের এক বিশাল জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমান জাতীয় নেতা হিসেবে ভাষণ দেন; তিনি তাদের প্রত্যাশার কথা তুলে ধরেন, কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি। তিনি বলেন, ‘এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম’ এবং যতদূর সম্ভব কঠোর ভাষায় নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের পক্ষে যুক্তি দেখান। আওয়ামী লীগ অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেয়, যার সাহায্যে শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের ওপর তার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ কায়েম করেন।

পূর্ব পাকিস্তানের পুরো প্রশাসন, এমনকি কেন্দ্রীয় সরকারি সংস্থায় ও সশস্ত্র বাহিনীর সিভিল শাখায় কর্মরত বাঙালি কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও শেখ মুজিবুর রহমানের অসহযোগ আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেন। ক্ষমতায় শেখ মুজিবের কার্যত জোর অধিকারের মুখোমুখি হয়ে সম্ভবত উদ্ভূত সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের জন্য ১৫ মার্চ ইয়াহিয়া খান ঢাকায় আসেন। ভুট্টোসহ পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যালঘু নেতারাও তার সঙ্গে ছিলেন। জুলফিকার আলী ভুট্টোর দল পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) পশ্চিম পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। পশ্চিম পাকিস্তানি নেতাদের সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতাদের দীর্ঘ নয় দিন আলোচনা চলে, কিন্তুু কোনো সমাধান হয়নি। ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ আওয়ামী লীগের নেতারা একটি খসড়া ঘোষণা উপস্থাপন করেন, যাতে ছয় দফার ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের কথা বিধৃত হয়। ২৫ মার্চ পর্যন্তও আওয়ামী লীগের নেতারা পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের ঘোষণা শোনার অপেক্ষায় ছিলেন।

কিন্তুু প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান আলোচনার আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি না ঘটিয়ে উদ্ভত সমস্যার সামরিক সমাধানের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। সুতরাং ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পর পাকিস্তানের রাজনৈতিক ব্যবস্থার ঐক্য এবং উপযোগবাদী শক্তি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়। সরকারের এই দমননীতি সমস্যাকে শুধু একশ’ গুণ বাড়িয়ে দেয়নি, বরং নিশ্চিতভাবে পাকিস্তানকে ধ্বংসের পথে টেনে নিয়ে যায়। এ পর্যায়ে বিদ্যমান ব্যবস্থা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের কাছে বৈধতা হারায় এবং শাসক শ্রেণী বিভক্ত হয়ে পড়ে। বাঙালি নেতারা আর পাকিস্তানের একতা রক্ষায় আগ্রহী ছিলেন না। পাকিস্তানের শাসক শ্রেণীও বাঙালিদের প্রাধান্য দিয়ে একতা রক্ষায় অনিচ্ছুক ছিল। এ অবস্থায় বাঙালি সেনা অফিসাররা বিদ্যমান ব্যবস্থা ভেঙে একটি স্বাধীন- সার্বভৌম বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য কার্যকর ভ‚মিকায় অবতীর্ণ হন।

১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ আকস্মিক কোনো ঘটনা নয়। এটি ছিল একটি সুদীর্ঘ আন্দোলনের চ‚ড়ান্ত পর্যায়। যা ৫০ দশকের প্রারম্ভে শুরু হয় এবং ১৯৭১ সালের মার্চে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন হিসেবে জাতির মনোযোগ আকর্ষণের মাধ্যমে চুড়ান্ত আকার ধারণ করে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে বাঙালিদের প্রতিনিধিত্ব ছিল নগণ্য। তাদের অধিকাংশই ছিল নিম্ন পদমর্যাদায়। পদমর্যাদায় ছোট হওয়া সত্তেও এসব সেনা অফিসার মুক্তিযুদ্ধের সঙ্কটময় মুহূর্তে ঐতিহাসিক ভ‚মিকা পালনের মাধ্যমে জাতির ভাগ্য গঠনে সহযোগিতা করেছেন। এদের একজন বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। অন্যরা এ ঐতিহাসিক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। তাদের প্রত্যেকে একটি অভিন্ন উদ্দেশ্য নিয়ে চ‚ড়ান্ত বিজয় অর্জনের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত পারস্পরিক সহযোগিতায় যুদ্ধকে সমন্বিত করে সম্মিলিতভাবে কাজ করে গেছেন।

মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের জন্য রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গে সেনাবাহিনী কীভাবে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করেছে, ইতিহাসে এর অনেক উদাহরণ রয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক নেতারা যুদ্ধের সূচনা করেন এবং প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনী তাদের নির্দেশনা ও তত্তবধানে যুদ্ধ পরিচালনা করেন (নী এবং বেক ১৯৭৩ : ৩-২৫; কারনো ১৯৮৩ : ৫-১৫)। কিন্তুু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর সদস্যরাই সঙ্কটময় মুহূর্তে যুদ্ধের উদ্যোগ গ্রহণ করে এবং ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে প্রবাসী সরকার গঠনের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যায়। তখন পর্যন্ত সেনাবাহিনীই ছিল স্বাধীনতার প্রতীক। বস্তুত তারাই বাংলাদেশের পতাকা উড্ডীয়মান রেখেছিল।

বাঙালি সেনা অফিসাররা, বিশেষভাবে চট্টগ্রাম সেনানিবাসের অফিসাররা কেন এবং কীভাবে ১৯৭১ সালের ২৫-২৬ মার্চের কালো রাতে বিদ্রোহ শুরু করেছিলেন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন ইত্যাদি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যেহেতু আমি নিজেই ঘটনাবলীর সঙ্গে জড়িত ছিলাম, তাই আমার নিজের ভ‚মিকা এখানে বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছি। সঙ্কটময় মুহূর্তে মেজর জিয়া যে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন, তা শুধু আমাদের নিজেদের অস্তিত্বের জন্য নয় বরং পুরো বাঙালি জাতির অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িত ছিল। তাই আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণের উদ্দীপনা স্বীয় নিরাপত্তার সহজাত প্রবৃত্তি ছাড়িয়ে জাতীয় মুক্তির মহৎ উদ্দেশ্যে বিস্তার লাভ করেছিল।

ঘটনার সময় চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, যশোর, সৈয়দপুর এবং ঢাকা সেনানিবাসে প্রায় ৫০ জন সুদক্ষ বাঙালি অফিসার এবং বিভিন্ন পদবীর প্রায় ৫০০০ বাঙালি সৈনিক ছিল। এছাড়া ছিল জাতীয় সীমান্ত এলাকা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলের (ইপিআর) ১৫ হাজার সৈনিক। ঢাকা থেকে দূরে হলেও চট্টগ্রাম সেনানিবাসের কিছু বাড়তি সুবিধা ছিল। কিভাবে পাকিস্তানি সমরবিদরা চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে প্রচুর অস্ত্র ও গোলাবারুদ এনে তাদের শক্তি বৃদ্ধি করে অবস্থান সুদৃঢ় করতে চান, চট্টগ্রাম সেনানিবাসের অফিসাররা তা খুব কাছ থেকে দেখার যথেষ্ট সুযোগ পান। কুমিল্লা সেনানিবাস চট্টগ্রাম সেনানিবাসের কাছাকাছি অবস্থানের কারণে রাজনৈতিক নেতারা এবং সেনা অফিসারদের মধ্যে সহজ যোগাযোগের সুযোগ সৃষ্টি হয়। চট্টগ্রামে একটি রেডিও ষ্টেশনও ছিল।

১৯৭০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আমি চট্টগ্রাম সেনানিবাসে বদলি হই এবং চট্টগ্রামের ষোলশহরে ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের নবগঠিত ৮ম ব্যাটালিয়নে কোয়ার্টার মাষ্টারের দায়িত্ব পাই। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ সূচনার ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে যেসব ঘটনা উদ্বুদ্ধ করে, সেসব ঘটনা সুচারুরূপে পর্যবেক্ষণের গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান ছিল রেজিমেন্টের কোয়ার্টার মাষ্টারের অফিস।

৮ম ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কোয়ার্টার মাষ্টার হিসেবে আমি নিয়োগ পাওয়ার অব্যবহিত পর মেজর জিয়াউর রহমান বদলি হয়ে এসে সহ-অধিনায়ক পদে যোগ দেন। আমি দেখলাম মেজর জিয়া একজন সুদর্শন, রণপারদর্শী দক্ষ অফিসার। তিনি বলতেন কম, শুনতেন বেশি এবং দ্রত কাজ করতেন। আমাদের অফিস ছিল পাশাপাশি, পরস্পর সংলগ্ন। শুধু ৫ ইঞ্চি একটি পাতলা দেয়াল দিয়ে পৃথক করা ছিল। তখন আমি ও মেজর জিয়ার মধ্যে পরস্পর পরিচয় ছিল না। কোয়ার্টার মাষ্টার হিসেবে আমি সুবিধাজনক অবস্থানে ছিলাম। সব অফিসার ও কর্মচারীর নিজ প্রয়োজনে আমার কাছে আসতে হতো। তাদের খাদ্য, রেশন, পোশাক ও অন্যান্য উপকরণ আমার দায়িত্বে ছিল। সঙ্গত কারণে আমি সবার সঙ্গে প্রায়ই মতবিনিময়ের সুযোগ পাই। অফিসার ও সৈনিকদের সঙ্গে আমার সুসম্পর্ক এবং যোগাযোগ সহ-অধিনায়ক মেজর জিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তিনি আমার প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন এবং আমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলেন। বিশেষভাবে যখন তিনি দেখলেন, তার মতো আমিও বিদ্যমান পরিস্থিতি সম্পর্কে অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করছি।

১৯৭১ সালের ফেব্রয়ারি মাসে মেজর জিয়া বেশ কয়েকবার তার অফিসে আমাকে ডেকে পাঠান। রাজনৈতিক অঙ্গনে কী ঘটছে সে বিষয়ে তিনি জানতে চাইতেন। তিনি বাঙালি সেনা সদস্যদের চিন্তা-চেতনা ও দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়ে জিজ্ঞাসা করতেন। আমি তখনও তার সাথে খোলাখুলি কথা বলার ব্যাপারে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতাম না। বরং অত্যন্ত সতর্কভাবে অগ্রসর হতাম। তবে মেজর জিয়া খোলাখুলিভাবে আমার সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করতেন, যদিও আমি খুবই সতর্ক ছিলাম। তিনি দেশের চলমান রাজনৈতিক অবস্থার দ্রত পরিবর্তনের এবং প্রয়োজনবোধে অভিযানের জন্য প্রস্তুত থাকবে এ ধরনের একটি নিবেদিতপ্রাণ দল গঠন করার বিষয়েও সজাগ ছিলেন।

১৯৭১ সালের ফেব্রয়ারি মাসের তৃতীয় সপ্তাহের এক সন্ধ্যায় মেজর জিয়া আমাকে জরুরি ভিত্তিতে তার বাসায় ডেকে পাঠান। সেদিন আমি কোনো দ্বিধা-দ্ব›দ্ব ছাড়া মেজর জিয়াকে বাঙালি সেনা অফিসার ও সৈনিকদের সম্পর্কে অবগত করি। বাঙালি জাতির স্বার্থরক্ষায় প্রত্যক্ষভাবে কাজ করার জন্য মেজর জিয়াকে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মনে হলো। আমি এ ব্যাপারে তাকে সমর্থনের নিশ্চয়তা দিই। আমরা এরূপ প্রত্যক্ষ অভিযানের সমস্য ও সম্ভাবনার বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করি। লে. কর্নেল এম আর চৌধুরীর সঙ্গে আমার সম্পর্কের বিষয়টি কেবল আমি প্রকাশ করিনি। কিছু সময়ের জন্য আমি এ বিষয়টি গোপন রাখি এবং মেজর জিয়াকে আরও ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ ও বোঝার চেষ্টা করি।

অতি অল্প সময়ের মধ্যে আমি মেজর জিয়ার সম্পূর্ণ আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হই। আমরা পরস্পর অতি ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠি। মেজর জিয়া এবং আমি নিয়মিত মতবিনিময় ও পরিকল্পনা করতে থাকি। ২০তম বেলুচ রেজিমেন্টের অবস্থান ছিল চট্টগ্রাম সেনানিবাসে। বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন নিয়ন্ত্রণ ও দমন ছিল বেলুচ রেজিমেন্টের অতিরিক্ত দায়িত্ব। ক্যাপ্টেন ইকবাল হোসাইন ছিলেন বেলুচ রেজিমেন্টের কোয়ার্টার মাষ্টার। একই ধরনের দায়িত্বে নিয়োজিত থাকার কারণে আমি ও ক্যাপ্টেন ইকবাল হোসাইনের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। তাছাড়া আমরা পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে একত্রে অধ্যয়ন করি। তিনি ছিলেন আমার কোর্সমেট। মার্চের প্রথম সপ্তাহে ক্যাপ্টেন ইকবাল হোসাইন আলাপ-আলোচনার এক পর্যায়ে আমাকে বলেন, অধিক সংখ্যক পাঞ্জাবি অফিসার, সৈনিক, অস্ত্র এবং গোলাবারুদ দ্রত পূর্ব পাকিস্তানে আসবে।

অবিলম্বে আমি লে. কর্নেল চৌধুরী এবং মেজর জিয়ার কাছে পৃথকভাবে এ খবর পৌঁছে দিই। আমরা নিশ্চিত ছিলাম, পশ্চিম পাকিস্তানিরা বাঙালিদের ওপর সশস্ত্র হামলা চালানোর পরিকল্পনা করছে। ৮ম ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে পশ্চিম পাকিস্তানের খারিয়ান সেনানিবাসে স্থানান্তর করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিল। তাই আমাদের জন্য অস্ত্র এবং গোলাবারুদ সরবরাহ করা হয়নি। এই রেজিমেন্টে প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে মাত্র ১২টি এলএমজি (হালকা মেশিনগান) এবং ৩০০ থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল ছিল। অস্ত্রগুলোও ভালো ছিল না। তাছাড়া পুরো রেজিমেন্টের জন্য মাত্র ৫টি গাড়ি ছিল।

মার্চের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে মেজর জিয়া এবং আমি ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নিয়ে একাধিক বৈঠক করি। ১৯৭১ সালের ২ মার্চ দ্বিতীয় কমান্ডো ব্যাটালিয়নের কিছু পাঞ্জাবি সৈন্য এবং ২০তম বেলুচ রেজিমেন্ট চট্টগ্রামের পাহাড়তলীর অবাঙালি অধ্যুষিত এলাকায় কয়েকজন বাঙালিকে হত্যা করে। মেজর জিয়া ও আমি উভয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ি। সারা সেনানিবাস ও আশপাশের এলাকাতেও উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। বিকালে আমি বান্দরবান জেলা থেকে ফেরার পর হাবিলদার আবদুল আজিজ অফিসার্স মেসে আমার কক্ষে প্রবেশ করেন। দরজা বন্ধ করে দিয়ে তিনি আমার কাছে বাঙালি হত্যার খবর দিয়ে নির্দেশের অপেক্ষায় থাকেন। আমি তাকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে বলি এবং ঝাঁপিয়ে পড়ার সঠিক সময় তাকে জানানোর প্রত্যয় ব্যক্ত করি।

স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে সুখান্ত সিং তার বইয়ে লিখেন যে, ‘ইতোমধ্যে ২৬ মার্চ চট্টগ্রাম বেতার থেকে একজন বাঙালি অফিসার, মেজর জিয়ার কন্ঠস্বর ভেসে আসে। তিনি অস্থায়ী সরকার গঠনের ঘোষণা দেন। বস্তুত স্বাধীনতা যুদ্ধের সমর্থকরা এ ঘোষণাকে স্বাগত জানান। কিন্তুু শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের ভাগ্য তথনও অজ্ঞাত থেকে যায়’ (সিং, ১৯৮০ :৯)। প্রথম ঘোষণায় মেজর জিয়া নিজেকে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে বর্ণনা করে অন্তর্বর্তীকালীন বাংলাদেশ সরকার গঠনের ঘোষণা দেন। আমি সতর্কতার সঙ্গে সেই খসড়া ঘোষণা পড়েছিলাম। ভেবেছিলাম, ঘোষণার প্রথম লাইনে যদি জিয়াকে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে ঘোষণা করা হয়, তাহলে মুজিবের অনুসারীরা অসহযোগিতা করতে পারেন। তাছাড়া, আমাদের কোনো রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ ছিল না। আমরা শুধু সমগ্র জাতিকে পাকিস্তানি সামরিক জান্তাদের সীমাহীন হত্যাযজ্ঞ থেকে বাঁচাতে এবং রাজনৈতিক নেতাদের ব্যর্থতা ও শূন্যতা পূরণ করতে চেয়েছিলাম। এ দৃষ্টিভঙ্গি শুধু মেজর জিয়া ও আমার নয়, বরং স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সব অফিসারেরই ছিল। স্বাধীনতা ঘোষণার মাধ্যমে জাতিকে একতাবদ্ধ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে স্বাধীনতা যুদ্ধ সম্পর্কে অবহিত করাই ছিল মেজর জিয়াউর রহমানের একমাত্র উদ্দেশ্য। শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করার কোনো উদ্দেশ্য তার ছিল না। এ চিন্তা মাথায় রেখে পরে খসড়ার প্রথম বাক্যটি সংশোধন করেন। বাকি অংশ অপরিবর্তিত থাকে। সংশোধিত বাক্যটি ছিল নিম্নরূপ :
‘…আমি মেজর জিয়া, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি।…’
ইতিহাসের আমি একজন সাক্ষী, ওই সময় মেজর জিয়াউর রহমানের পাশেই উপবিষ্ট ছিলাম। মিথ্যাবাদীরা ধ্বংস হোক এবং সত্য প্রতিষ্ঠা হোক।

Recent Posts