ড. এমাজউদ্দীন আহমদ
দীর্ঘদিনের অধীনতা এবং অনিশ্চয়তার ঘন অন্ধকারে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ এই জনপদে জ্বলে উঠেছিল স্বাধীনতার ছোট্ট মাটির প্রদীপটি। দীর্ঘ ৯ মাসের জমাটবাঁধা অন্ধকারে এই প্রদীপটিই এই জনপদের সাত কোটি মানুষের মনে জ্বালিয়ে রেখেছিল আশার ক্ষীণ আলো। এই প্রদীপের ক্ষীণ আলো ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরে দিবালোকের মতো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। ২৬ মার্চে সূচিত স্বাধীনতা সংগ্রামের ক্ষীণ ধারাটি ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধে জাতীয় জীবনের বিস্তীর্ণ উপত্যকার হাজারো প্রান্তে অসংখ্য রক্তস্রোতের সৃষ্টি করে, চ‚ড়ান্ত পর্যায়ে তার সম্মিলিত প্রবাহ ১৬ ডিসেম্বরে সমাজ জীবনের দু’ক‚ল ছাপিয়ে যে মহাপ্লাবনের সৃষ্টি করে তার ফলেই সৃষ্টি হয় স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীনতার স্বর্ণদ্বীপ বাংলাদেশের। ২৬ মার্চকে তাই এই জাতি স্মরণ করে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর দুর্জয় প্রত্যয় রূপে। এ দেশে রয়েছে রোগ-শোক-ব্যাধি-অপুষ্টি। এ দেশে রয়েছে অনগ্রসরতা, প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে রয়েছে অশিক্ষা ও অদক্ষতা। কিন্তু ২৬ মার্চের সেই প্রদীপের আলোয় হারিয়ে গেছে পরাধীনতার গøানি। নিশ্চিহ্ন হয়েছে আতœনিবেদনের দাসসুলভ মানসিকতা। এই তো আমাদের ইতিহাস। এটি আমাদের গৌরবময় ঐতিহ্য।
২৬ মার্চে যার সূচনা, ১৬ ডিসেম্বরে তারই পরিপূর্ণতা। দু’টিই কিন্তু রক্তাক্ত দিন। রক্তসিক্ত ২৬ মার্চ সবাইকে ডাক দিয়েছে যুদ্ধক্ষেত্রে। নিজেদের যুদ্ধ নিজেরা করে শক্ত হাতে বিজয় ছিনিয়ে আনার দৃঢ় সংকল্পসহ। এ জন্য ২৬ মার্চকে বলা যেতে পারে রক্তদানের আকুতির প্রতীক। আতœশক্তি উদ্বোধনের নিশানা। আর ১৬ ডিসেম্বর হলো এক জীবন-মরণ সংগ্রামের শেষ অধ্যায়। গৌরবদীপ্ত বিজয়ের স্পর্শধন্য এক রেড লেটার দিবস। আমাদের জাতীয় ইতিহাসে দুটিই উজ্জ্বলতম দিন।
২৫ মার্চের রাতকে এই জাতি চিহ্নিত করেছে ইতিহাসের সবচেয়ে তমসাচ্ছন্ন রাত হিসেবে। কাল রাত রূপে। এটি কাল রাত বল হয় দুটি কারণে। এক. এই রাতে এই জনপদের নিরস্ত্র ও নিরীহ সাধারণ মানুষের ওপর পাকিস্তানের প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনীর নৃশংসতম হত্যাযজ্ঞ হয়। চাপিয়ে দেয়া হয় জনগণের ওপর শতাব্দীর সবচেয়ে অসম যুদ্ধ। এক হিসেবে বলা হয়েছে, সেই কাল রাতে শুধু ঢাকা নগরীতেই প্রায় পঞ্চাশ হাজার নর-নারীর প্রাণহানি ঘটে এবং তাও এমন একসময় যখন কর্মক্লান্ত সাধারণ মানুষ ঘুমে অচেতন, মধ্য রাতে। দুই. জাতীয় ইতিহাসের এই দুর্যোগময় মুহূর্তে জাতীয় নেতৃত্ব জনগণকে কোনো দিকনির্দেশনা দিতে ব্যর্থ। এর আগে তিন সপ্তাহব্যাপী আন্দোলনে গণমনে পাকিস্তানবিরোধী উন্মাদনা চরমে ওঠে। বলদর্পী ইয়াহিয়া খানের ১ মার্চে জাতীয় পরিষদ অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণার ফলে সবার অলক্ষ্যে ছয় দফা দাবি স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষে এক-দফা দাবিতে রূপান্তরিত হয়েছে। পাকিস্তানের ঘাতক বাহিনী যে প্রেতিশোধ গ্রহণে উন্মত্ত হয়ে উঠবে তা জাতীয় নেতৃত্বের অনুধাবনে আসেনি। ফলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রহরে প্রথম শিকার হলেন হাজার হাজার সাধারণ মানুষ। নির্মমভাবে নিহন হন তারা। কোনো কিছু বোঝার আগে। কোনোরূপ সাবধানতা অবলম্বনের আগেই। এই মৃত্যু যে কত করুণ, কত নির্মম তা এই জনপদের মানুষরাই জেনেছেন।
সেই মৃত্যু কিন্তু বৃথা যায়নি। তাদের রক্তে বাংলার মাটি শুধু যে উর্বর হলো তাই নয়, তাদের এক এক ফোঁটা রক্ত রক্তবীজের মতো সৃষ্টি করে এক একজন অজেয় সৈনিক। শত্রæকবলিত বাংলাদেশ হানাদার মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত তারা লড়ে গেছেন জীবন বাজি রেখে। এ জন্যই তো একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সোনালি ফসল যে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ তার জন্মও স্বাতন্ত্র্যমন্ডিত। প্রতিবেশী ভারত বা পাকিস্তানের জন্ম যেভাবে হয়েছে, তা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশের সৃষ্টি হলো। কোনো ধরনের দেন-দরবার বা গোলটেবিল বৈঠকের সিদ্ধান্তের ফল বাংলাদেশ নয়। নয় কোনো ক‚টকৌশলের ফল। নয় কোনো সাম্রাজ্যবাদী শক্তির দাক্ষিণ্য। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ জন্ম লাভ করল মুক্তিযুদ্ধের রক্তাক্ত প্রান্তরে। জনগণের সচেতন উদ্যোগের ফলে। সীমাহীন ত্যাগের বিনিময়ে। ঘন অন্ধকার কাটিয়ে উঠে উজ্জ্বল আলোয় উদ্ভাসিত হলো স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। এই উদ্যোগে নেতৃত্ব দিয়েছেন পূর্ব বাংলার জনগণ-ছাত্র-শিক্ষক, কৃষক-মজুর, অখ্যাত পল্লীর দূরন্ত তরুণ, নগরীর হাজারো বস্তির উদ্ধত যুবক, মহানগরীর যুবশক্তি, মিল-ফ্যাক্টরির কর্মী, বিভিন্ন পেশার প্রশিক্ষিত নাগরিক। জাতীয় জনসমাজ বলতে যা বোঝায় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন তারাই। অংশগ্রহণ করেন কোনো দলের সদস্য হিসেব নন। কোনো দলের আদর্শে অনুপ্রাণিত কর্মী হিসেবে কোনো দলের অঙ্গীকারবদ্ধ অনুসারী হিসেবে নয়। শিক্ষার্থীরা শিক্ষায়তন ছেড়ে, কৃষকদের একাংশ চাষাবাদ ছেড়ে, অনেক শ্রমিক মিল-ফ্যাক্টরি ছেড়ে, পেশাজীবীদের অনেকেই নিজ নিজ পেশা ছেড়ে মুক্তিযুদ্ধে শরিক হলেন। অনেকে স্ব-স্ব অবস্থানে থেকেই মুক্তিযোদ্ধাদের সমর্থন জানালেন। শিল্পী-সাহিত্যিকদের শিল্পকর্ম ও রচনাসম্ভার একই উদ্দেশ্যে উৎর্সগিকৃত হলো। দীর্ঘদিন পরে জাতীয় পর্যায়ে জনসাধারণের যে সার্বিক উদ্যোগ এবং আত্মত্যাগের মহোৎসব, তাই মূর্ত হয়ে ওঠে মুক্তিযুদ্ধে। বিজয় দিবস তারই বিকশিত রূপ। তারা যেন চিৎকার করে বলে উঠেছিল :
সরে দাঁড়াও। পিছু হটো। আমাদের যুদ্ধ আমাদেরই করতে দাও।
তোমরা আমাদের বিজয় ছিনিয়ে নেবে না।
আমরা মুক্ত হবোই। আমরা স্বাধীন হবো।
সৃষ্টিকর্তা এবং ন্যায়নীতি আমাদের প্রতীক এবং পতাকা।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের বৈশিষ্ট্যময় প্রকৃতি এটিই। এটি ছিল এ জনযুদ্ধ। সত্যি বটে, কিছুসংখ্যক বিপথগামী এই মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে। কিন্তু শক্তি বলতে যা বোঝায়, মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীদের তেমন শক্তি তখনও ছিল না। পরবর্তী পর্যায়ে সুসংহত হয়ে শক্তির পর্যায়ে কোনোদিন তারা আবির্ভূত হতে পারেনি। বরাবরই জনগণের তীব্র ঘৃণার কুয়াশায় তারা আচ্ছন্ন থেকেছে।
একটি প্রশ্ন বারবার মনে উদয় হয়েছে। এ প্রশ্ন শুধু আমার মনে নয়, হাজারো মনে উঁকি দিয়েছে। ২৫ মার্চের রাতে পাকিস্তানের শাসকরা পাকিস্তানের আর এক অংশ পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে এই পৈশাচিক আক্রমণ কেন শানাতে গেল ? ২৫ মার্চ পর্যন্ত পূর্ব-পাকিস্তান ছিল পাকিস্তানেরই অংশ। এখানকার জনগণ সেদিন পর্যন্ত পাকিস্তানেরই অধিবাসী ছিলেন। তা জেনেও কোন বিবেক, কোন বিবেচনায় পাকিস্তানের শাসকরা এই নৃশংস আক্রমণ শুরু করল? তাহলে কী পূর্ব-পাকিস্তানের সচেতন জনগণকে নিশ্চিহ্ন করে তারা শুধু চেয়েছিল পূর্ব-পাকিস্তানের মাটিকে ? পাকিস্তানের রক্তপিপাসু জেনারেল টিক্কা খানের ঔদ্ধত্যপূর্ণ দাবি ছিল- ‘আমাকে ৭২ ঘন্টা সময় দেয়া হোক, আমি সন্ত্রাসীদের (মুক্তিযোদ্ধাদের) নির্মূল করে পূর্ব-পাকিস্তান ফিরিয়ে দেব’ [“এরাব সব ংবাবহঃু ঃড়ি যড়ঁৎং’ ঃরসব ধহফ ও রিষষ মরাব নধপশ ঊধংঃ চধশরংঃধহ ভৎবব ড়ভ ধষষ ংযধফবং ড়ভ সরংপৎবধহঃং”.] হয়তো বা তাই। পূর্ব-পাকিস্তান থেকে যা নেয়ার তা তো নেয়া হয়ে গেছে। অহেতুক তাদের দাবি-দাওয়া শুনব কেন ? পূর্ব-পাকিস্তানের মাটিকে অক্ষত রাখতে পারলে কালে আবারও অনুগত, দাসসুলভ মানুষদের দিয়ে তা ভরিয়ে ফেলতে পারব। এমনি মনোভাব ছিল কী তাদের ? সম্ভবত তাই। এ সম্পর্কে সঠিক তথ্য গত তিন দশকেও আমরা পাইনি। তবে ১৯৯৮ সালে প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধে আত্মসমর্পণকারী জেনারেল এ কে নিয়াজীর লেখা ঞযব ইবঃৎধুধষ ড়ভ ঊধংঃ চধশরংঃধহ গ্রন্থটিতে এমনই ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। তার বর্ণনা মতে, ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব-পাকিস্তানের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানে পূর্ব-পাকিস্তানকে ধ্বংস করার এক ধরনের ষড়যন্ত্র শুরু হয়।
তখন থেকেই জুলফিকার আলী ভুট্টো সেই ষড়যন্ত্রের মূল হোতা হিসেবে মাঠে নামেন। ১৯৭০ সালের শেষলগ্নে অর্থনীতি ডিভিশনের উপদেষ্টা এমএম আহমদ এবং পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান কামরুল ইসলামকে ভুট্টো নির্দেশ দিয়েছিলেন এমন একটি প্রতিবেদন তৈরি করতে যা প্রমাণ করবে যে, পূর্ব-পাকিস্তান ছাড়াই পাকিস্তান শুধু টিকে থাকবে না, শতগুণ বেশি সমৃদ্ধ হয়ে উঠবে। এই প্রতিবেদনকে সামনে রেখেই ভুট্টো তার চালগুলো ঠিক করেছিলেন। জানা যায়, ১ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া যে ঘোষণা দিয়েছিলেন তা ছিল এই ষড়যন্ত্রেরই একটি সূত্র। এই ঘোষণা সত্তে¡ও পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যান্য প্রদেশ থেকে নির্বাচিত পরিষদ সদস্যদের কেউ ঢাকায় এসে কোনো গোলমাল সৃষ্টি করতে না পারে তাই মেজর জেনারেল ওমরের ওপর দায়িত্ব দেয়া হয় পশ্চিম পাকিস্তানের কোনো রাজনৈতিক নেতা যেন ঢাকায় না আসতে পারেন। ১৯৭১ সালের ২৮ ফেব্রæয়ারি ভুট্টো নিজেই ঘোষণা করেন জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করা না হলে সমগ্র পশ্চিম পাকিস্তানে গণ-আন্দোলন গড়ে তোলা হবে এবং তার দলের কোনো নির্বাচিত সদস্য ঢাকায় এলে তাকে নির্মূল করা হবে। তিনি তখনই শেখ মুজিবকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন-‘ইধার হাম : উধার তুম’। অন্য কথায়, পূর্ব নিয়াজী আরও বলেন, পাকিস্তানকে দ্বিখÐিত করার পরিকল্পনা সম্পূর্ণ হয় ভুট্টোর নিজস্ব শহর লারকানায়, ২৯ ফেব্রæয়ারি ১৯৭১। লারকানার এই পরিকল্পনা ‘এম এম আহমদ পরিকল্পনা’ নামেই পরিচিত। পূর্ব-পাকিস্তানে কোনো সরকার গঠন না করেই তা পরিত্যাগ করো। [“খবধাব ঊধংঃ চধশরংঃধহ রিঃযড়ঁঃ ধহু ংঁপপবংংড়ৎ এড়াবৎহসবহঃ”]। পূর্ব-পাকিস্তান ত্যাগ করার পূর্বে তাদের প্রতি নির্দেশ ছিল, এখানকার অর্থনৈতিক ভিত্তিকে বিধ্বস্ত করে আসবে এবং নেতৃত্বদানকারী কেউ যেন জীবন্ত না থাকে।
জেনারেল ইয়াহিয়া খান এবং ভ‚ট্টোর ১১, ১৯ এবং ২৯ ফেব্রæয়ারির গোপন আলোচনায় এই পরিকল্পনাকে কার্যকর করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। এ জন্য রাজনৈতিক মীমাংসার জন্য তারা আগ্রহী হননি। উদ্যোগী হননি মুজিব-ভুট্টো পর্যায়ে সার্থক আলোচনা অনুষ্ঠানে। ১৪ মার্চ ভুট্টো নিজেই সুপারিশ করেছিলেন পাকিস্তানের দুই অঞ্চলে দু’জন প্রধানমন্ত্রী নিয়োগের। অন্য কথায়, পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক এবং জেনারেলরা যে পূর্ব-পাকিস্তানকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেবে, গণহত্যার মাধ্যমে মধ্যযুগীয় নৃশংসতা ঘটাবে এবং সম্ভব হলে পশ্চিম পাকিস্তানের ক্যাপটিভ এলাকায় (ঈধঢ়ঃরাব ৎবমরড়হ) রূপান্তরিত করবে, তার সব কৌশল করে নির্ধারণ করে রেখেছিল ২৫ মার্চের আগেই। পাকিস্তানের বৈশ্বিক সম্পর্ক, বিশেষ করে তদানীন্তন বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সুসম্পর্ক এবং পূব-পাকিস্তানের কাছাকাছি অবস্থিত চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, পাকিস্তানের শাসক ও জেনারেলদের উৎসাহিত করে ভীষণভাবে। পাকিস্তান এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের শীর্ষ নেতাদের কাছ থেকে কিছুটা আশ্বাসও পেয়েছিল। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে চীনের ভ‚মিকা এরই স্বাক্ষর। পূর্ব-পাকিস্তানে পাকিস্তানের শাসক ও জেনারেলদের দুর্দমনীয় নির্যাতন, নিপীড়ন ও নৃশংসতার মাত্রা যতই নির্মম হোক না কেন, প্রতিবেশী ভারত যে এ ক্ষেত্রে কোনোরূপ হস্তক্ষেপ করবে না- এ সম্পের্কেও পাকিস্তান ছিল নিশ্চিত। তাই জেরারেল টিক্কা খানের নির্দেশে ঢাকায় ২৫ এবং ২৬ মার্চের রাতে যে হত্যাকাÐ শুরু হয় তা যেমন ছিল নৃশংস, তেমনি ছিল কাপুরুষোচিত। নিয়াজীর কথায়, ‘শান্তিপূর্ণ রাত পরিণত হলো আত্মচিৎকার, করুণ ক্রন্দন এবং জ্বালাও-পোড়াও এর নির্মম কাল… এই সামরিক অভিযান নির্মমতা ও হৃদয়হীনতার নিরিখে চেঙ্গিস খান ও হালাকু খানের বোখারা ও বাগদাদের হত্যাকাÐ অথবা ব্রিটিশ জেনারেল-কর্তৃক জালিয়ানওয়ালাবাগের নরহত্যার চেয়েও ছিল আরও বেশি ভয়ঙ্কর। আরও বেশি বিভীষিকাময়” [“চবধপবভঁষ হরমযঃ ধিং ঃঁৎহবফ রহঃড় ধ ঃরসব ড়ভ ধিরষরহম, পৎুরহম ধহফ নঁৎহরহম… ঞযব সরষরঃধৎু ধপঃরড়হ ধিং ধ ফরংঢ়ষধু ড়ভ ংঃধৎশ পৎঁবষঃু, সড়ৎব সবৎৎপরষবংং ঃযধহ ঃযব সধংংধপৎবং ড়ভ ইঁশযধৎধ ধহফ ইধমযফধফ নু ঈযবহমরু শযধহ ধহফ ঐধষধশঁ শযধহ, ড়ৎ ধঃ ঔধষরধহধিষধনধময নু ঃযব ইৎরঃরংয এবহবৎধষ উুবৎ”]।
২৫ মার্চের রাতেই ইয়াহিয়া খান ঢাকা থেকে সরে পড়েন। ঢাকা ত্যাগের প্রাক্কালে তিনি টিক্কা খানকে বলেনে, ‘তাদের বিরুদ্ধে যথোচিত ব্যবস্থা গ্রহণ করো’ (ঝড়ৎঃ ঃযবস ড়ঁঃ)। যা নির্দেশিত হয়েছিল তা কেমনভাবে সম্পন্ন হয়েছে তা দেখার জন্য ভুট্টো আরও কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষা করেন এবং নিজের কানেই শুনতে পান সাধারণ মানুষের আকাশবিদারী করুণ ক্রন্দন রোল, দাহ্য দ্রব্যের আওয়াজ, গতিশীল ট্যাঙ্কের কর্কশ গোঙ্গানি, মেশিনগানের মর্মভেদী ভীতিকর শব্দ। ‘পরদিন ভোরে ভুট্টো ঢাকা ত্যাগের প্রাক্কালে টিক্কা খান, ফরমান আলী এবং আরবাবকে তাদের পিঠ চাপড়ে অভিনন্দন জানান এবং বলেন, যা প্রয়োজনীয় ঠিক তাই করা হয়েছে’ [‘ওহ ঃযব সড়ৎহরহম ইযঁঃঃড় ঢ়ধঃঃবফ ঞরশশধ, ঋড়ৎসধহ অষর ধহফ অৎনধন ড়হ ঃযব নধপশ, পড়হমৎধঃঁষধঃবফ ঃযবস ভড়ৎ ফড়রহম বীধপঃষু যিধঃ ধিং হববফবফ’। পাকিস্তানে পোঁছে ভুট্টো বলেছিলেন: আল্লাহর নিকট হাজার শোকর। পাকিস্তান বেঁচে গেছে? (‘ঞযধহশ এড়ফ, চধশরংঃধহ রং ংধাবফ’)। পাকিস্তান কিন্তু বেঁচে থাকেনি। আল্লাহ এমন নির্মমতাকে কোনো সময় ক্ষমা করেন না। ২৫ মার্চ পূব-পাকিস্তানে যে মধ্যযুগীয় নারকীয়তার সূচনা হয় এ দেশের মানুষ সহ্য করেছেন। নীরবে নয়, দু’হাতে যা ছিল তা ব্যবহারের সংকল্প নিয়ে। মরেছেন লাখে লাখে, কিন্তু মেরেছেনও হাজারে হাজারে, নিরস্ত্র হয়েও। আর্তনাদ করেছেন, সঙ্গে সঙ্গে চীৎকার করে প্রতিবাদ করেছেন, যা বিশ্বের সর্বস্থানে সৃষ্টি করেছিল প্রতিক্রিয়া, তীব্র প্রতিক্রিয়া। শেষ পর্যন্ত নিয়াজী ও ফরমান আলীদের আত্মসমর্পণ করে জীবন বাঁচাতে হয়েছে। ২৫ মার্চে শুরু হয় পাকিস্তানের পৈশাচিক আক্রমণ। বাংলাদেশে কিন্তু শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। রাজনৈতিক দাসত্ব শৃঙ্খল ভাঙার যুদ্ধ। শুরু হয় অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের যুদ্ধ। শুরু হয় সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য সংরক্ষণের জীবন-মরণ সংগ্রাম। শুরু হয় জগণের যুদ্ধ। তারা চিৎকার করে বলেছেন :
আমরা জানতাম কেন আমরা যুদ্ধ করি ?
সন্তান-সন্ততিদের জন্যে প্রশান্তি, ভাই-এর মুক্তি।
একটি সদয় পৃথিবী, একটি পরিচ্ছন্ন প্রজন্ম।
আজকের এইদিনে এসব হিসাব-নিকাশ মিলছে কি? এ দেশের মানুষ যা চেয়েছিলেন তা কী তাদের হাতের নাগালে এসেছে?