স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের নায়ক জিয়া

রেজাবুদ্দৌলা চৌধুরী

শহীদ জিয়াউর রহমান একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে এবং পরবর্তীকালে পচাত্তরের আগস্ট-উত্তর পরিস্থিতিতে রাষ্ট্র পরিচালনায় নিজেকে সফল প্রমাণিত করে গেছেন-সশস্ত্র স্বাধীনতা যুদ্ধে নিজেকে একজন বীর-সেনা নায়ক এবং পরবর্তীকালে ১৯৭৫ নভেম্বর-১৯৮১ মে সময়কালে দেশ-প্রশাসন চালনায় সক্ষমতার এক অতুলনীয় নজীর সৃষ্টি করেছেন।

মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রারম্ভিকালে সেই একাত্তরের মার্চে মেজর জিয়াউর রহমান ছিলেন চট্টগ্রামের ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারের সেকেÐ-ইন-কমাÐ। তার কমাÐার ছিলেন বাঙ্গালী অফিসার লে. কর্নেল এম.আর.চৌধুরী। চট্টগ্রামের সেনানিবাসের প্রধান কমাÐার বাঙ্গালী বিগ্রেডিয়ার এম. আর. মজুমদার বাঙ্গালী সেনাদের চাপের মুখে পাকিস্তানী (অবাঙ্গালী) সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার পরিস্থিতিতে পৌঁছে গেলে পাকিস্তানী সামরিক জান্তার নির্দেশে ২২ মার্চ (১৯৭১) কয়েকজন সিনিয়র অবাঙ্গালী সামরিক অফিসার ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট চট্টগ্রামে গিয়ে ‘স্পেশাল মিশন’-র অংশ হিসেবে তাকে এরিয়া কমাÐের পদ থেকে সরিয়ে নিয়ে সুকৌশলে হেলিকপ্টারে চড়িয়ে ধরে নিয়ে যায় ঢাকায়-ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে তাকে প্রথমদিকে ‘প্রায় গৃহবন্দী দশায়’ রাখা হয়েছিল। চট্টগ্রামের বাঙ্গালী এনসিও ও জেসিও-রা ওই দিন বিদ্রোহ করার জন্য ব্রিগেডিয়ার মজুমদারকে চাপ দিয়ে যাচ্ছিলো একটানা (তারা অবাঙ্গালী সব ক’জন অফিসারকে গ্রেফতার করতে চেয়েছিলেন বরং সাথে সাথে চট্টগ্রামের ক্যান্টনমেন্টে বাঙ্গালী সেনাদের আধিপত্য কায়েম করতে চেয়েছিলেন), কিন্তু বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ না থাকায় মজুমদার সাহেব তাতে রাজী হননি।

তখনো অওয়ামীলীগ প্রধান, বাঙ্গালীর নির্বাচিত সংখ্যা গরিষ্ঠ-পাকিস্তানী (জাতীয় সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনের বিজয়ী নেতা) নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৌশলগত কারনেই বাঙ্গালী সামরিক- অফিসার ও সেনাদেরকে যার যার অবস্থানে ‘চেইন-ইন-কমাÐ’ মেনে চলার এবং সময়মত পরবর্তী সিদ্ধান্ত পেয়ে কাজ করার অপেক্ষায় থাকার নির্দেশনা দিয়েছিলেন। উল্লেখ্য তখন বিভিন্ন সেনানিবাসের অনেকগুলো বাঙ্গালী সামরিক অফিসার গ্রæপ বঙ্গবন্ধু ও তার সহযোগী নেতাদের সাথে বঙ্গবন্ধুর বাড়ীতে ও অন্যাত্র সাক্ষাত করে পাক-সেনাদের যুদ্ধ প্রস্তুতির পরিকল্পনার হুমকির কথা বিস্তারিত জানিয়ে ‘সময়-থাকতে’ বিদ্রোহ করার অনুমতি চেয়েছিলেন। তাদেরকে নিস্ক্রিয় থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল-যাতে পাকিস্তানী সামরিক জান্তা বাঙ্গালীদেরকে কোনরকম ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ বলে অজুহাত সৃষ্টির সৃযোগ না পায়। বাঙ্গালীর প্রধান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর আশঙ্কা ছিল-পাকিস্তানী সামরিক জান্তা বাঙ্গালীদেরকে ‘বিচ্ছন্নতাবাদী’ ও ‘পাকিস্তান-ধ্বংসকারী’ বলে অভিযোগ করে জাতিসংঘ ও আর্ন্তজাতিক বিশ্বের অন্য সব ক্ষেত্রে পূর্ব বাংলার মুক্তিকামী জনতার বিপক্ষে জনমত সৃষ্টি করে ফায়দা লুটতে পারার সুযোগ খুঁজছিল। সেই রকম পরিস্থিতিতে মেজর জিয়াউর রহমান বাঙ্গালীর তথা পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নির্বাচিত নেতা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা অনুসরণ করে সদা-সর্তক অপেক্ষামান ছিলেন, তিনি সর্তক ছিলেন-যখুনি সময় আসবে মুক্তিযুদ্ধে বাঙ্গালী রাজনৈতিক কর্মীদের সাথে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে-সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে।

মেজর জিয়াউর রহমান সামান্যতম সময়ের জন্যও হটকারিতা করার মতো সাধারণ সামরিক অফিসারদের ন্যায় আবেগপ্রবণ ছিলেন না। শেষ পর্যন্ত পাক সেনাদের (অবাঙ্গালী) ২৫ মার্চ মধ্য-রাতে ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ নামক দানব-তাÐব শুরুর সঙ্গে সঙ্গে মেজর জিয়াউর রহমান তার সঙ্গী বাঙ্গালী অফিসারদের সাথে নিয়ে বিদ্রোহ করে বসলেন। তার কমাÐার লে. কর্নেল এম. আর. মজুমদার সময় মতো বিদ্রোহ করার সুযোগ নিতে পারলেন না, ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারের হাজার খানেক বাঙ্গালী সেনাসহ (আরও কয়েকজন বাঙ্গালী অফিসারও ছিলেন) পাক বর্বর সেনাদের গণহত্যার শিকারে পরিণত হলেন। সেকেÐ-ইন-কমাÐ মেজর জিয়া তখন যুদ্ধ শুরু করে দিলেন অবাঙ্গালী পাক সেনাদের বিরুদ্ধে। তার উপস্থিত বুদ্ধি, সময়মতো সিদ্ধান্ত নেওয়ার কৌশলী-দক্ষ ভূমিকা তাকে এক অসাধারণ সময় নায়কে পরিণত করলো।
জিয়াউর রহমান যথাসময়ে মানে ২৫ মার্চ মধ্যরাতে বাঙ্গালী জাতির ওপরে পাক সেনাদের ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ নামক বর্বর হামলা শুরুর সাথে সাথে
মুক্তিযুদ্ধ (সশস্ত্র প্রতিরোধ) আরম্ভ করলেন-বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা যথাযথভাবে পালনের সুযোগটি যথাসময়ে নিলেন, এতটুকু সময়ক্ষেপন করে ভুল তিনি করলেন না। আবার বাঙ্গালী জাতির প্রধান নেতার নির্দেশও তিনি লঙ্ঘন করে আগে-ভাগে পাক সেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে হঠকারিতা করলেন না। এখানেই তার সফল সেনা নায়কের কৃতিত্ব। যথাসময়ে যথা কাজ। এখানে উল্লেখ্য যে, জিয়া সাহেবের উর্ধতন কমাÐার লে. কর্নেল এম. আর. চৌধুরী কিন্তু তার অধীনস্ত দ্বিতীয় কমাÐার ( মেজর জিয়া) এর মতো দূরদর্শী এবং দক্ষ না হওয়ায় যথাসময়ে যথা দায়িত্ব পালন করতে পারলেন না, দখলদার সেনাদের হাতে নিজেও প্রাণ হারালেন এবং হাজারখানেক বাঙ্গালী সেনা ও অফিসারদের প্রাণ গেল তার ভুলের মাশুল দিতে গিয়ে।

চট্টগ্রামে তখন বাঙ্গালী বিদ্রোহীরা মুক্তিযুদ্ধে সংগঠিত হওয়ার তুমুল প্রচেষ্টার ভেতরে তারা মেজর জিয়াকে পেয়ে প্রবলভাবে সাহসী হয়ে উঠলেন।তারাই মেজর জিয়াকে স্বাধীনতা ঘোষণা চট্টগ্রাম বেতার মাধ্যমে প্রচারের অনুরোধ জানান। সেটা ২৬ মার্চ সকাল থেকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র নামে অনুষ্ঠান সম্প্রচার করে যাচ্ছিল।) তিনি ২৬ মার্চ সন্ধ্যায় প্রথমে নিজের নামে এবং পরে ২৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ( প্রেসিডেন্ট/রাষ্ট্রপতি) নামে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২৫ মার্চ মধ্য-রাতে পাক সেনাদের দ্বারা আটক হওয়ার পরের কয়েকদিনের ঐ সময়টাতে আওয়ামীলীগ শীর্ষ নেতৃত্ব অসংগঠিত ছিল। তারা বাংলাদেশের সীমানার বাহিরে (বা প্রান্তে) মুক্তাঞ্চল (মুজিবনগর/স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাজধানী/ কেন্দ্রীয় কর্মস্থল।) অবস্থানে গিয়ে সংগঠিত হবার চেষ্টায় রত তখন। তখন চট্টগ্রামের স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে মেজর জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণা পুরো জাতিকে প্রচÐ সাহস জোগায়-সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের পানে ধাবিত করে দ্রæততার সাথে।

মেজর জিয়ার নেতৃত্ব চট্টগ্রামে অবস্থানরত বাঙ্গালী সেনারা পাক সামরিকবাহিনীর দখলদারদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধে লিপ্ত হন, তার বেশ কয়েকজন বাঙ্গালী মেজর ও ক্যাপ্টেন এবং লেফটেন্যান্ট ও সেকেÐ লেফটেন্যান্ট কর্মরত ছিলেন, তারা প্রায় সবাই মেজর জিয়ার নেতৃত্বে দখলদার পাক সেনাদের বিরুদ্ধে প্রবল সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে। অনেকগুলো সফল প্রতিরোধ-অপারেশন শেষে মেজর জিয়া তার মুক্তিযোদ্ধাদের (বাঙ্গালী সেনা ও ই পি আর সদস্য, পুলিশ, আনসার ইত্যাদি সব সশস্ত্র বাঙ্গালী) কৌশলগত পশ্চাদাপসারন করিয়ে পাবর্ত্য চট্টগ্রামের রামগড় দিয়ে ভারতীয় সীমানার মধ্যে নিয়ে যান। যাওয়ার আগে অনেক প্রতিরোধ-যুদ্ধ করতে করতে যান তারা। বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি করে (তার অনুপস্থিতিতে) সৈয়দ নজরুল ইসলাম-তাজউদ্দিন আহমেদ (ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী) নেতৃত্বাধীন স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠনের পরে অচিরেই কর্নেল এম এ জি ওসমানীর নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী গঠিত হলে তিনি মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমাÐার হন এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহের মধ্যেই। প্রবল সাহসী হয়ে তিনি একটানা যুদ্ধ পরিচালনা করে যাচ্ছিলেন। তার সেই সাহসিকতা, চমৎকার যুদ্ধ কৌশল প্রয়োগ, পাক সেনাদেরকে ঘায়েল করে মারাত্মকভাবে প্রচুর হতাহত দখলদার সেনারা। দখলদার সেনাদের কাছে জিয়া নামটি তখন এক আতংক হয়ে দাড়ায়। এখনকার অবার্চীন রাজনীতিকদের কেউ কেউ উল্টাপাল্টা মন্তব্য করেন না-বুঝে, না-জেনে। বলাই নিস্প্রয়োজন, আমাদের বাঙ্গালী যোদ্ধদের অনেকে বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে শাহাদত বরণ করেন সেইসব প্রতিরোধ যুদ্ধে। তবে মেজর জিয়ার নেতৃত্ব সেই সব প্রতিরোধ মুক্তিযোদ্ধাদের সাফল্য ছিল যথেষ্ট উল্লেখযোগ্য নিঃসন্দেহে ঐতিহাসিক নজীর সৃষ্টিকারী।

একাত্তরের মধ্যভাগে তখনকার আওয়ামীলীগের এক শ্রেণির হীনমনা নেতার স্বার্থপরতার জন্য তখনকার স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসন ও মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার মধ্যে নানারকম জটিলতা সৃষ্টি হবার পথে মুক্তিযুদ্ধকালীন সশস্ত্র অপারেশন গুলো পরিচালনায় সংকট তৈরি হচ্ছিল, নানাভাবে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হচ্ছিল। সেই পরিস্থিতিতে জিয়াউর রহমান মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক কর্নেল ওসমানী ও অন্যসব সিনিয়র অফিসার ও সেক্টর কমাÐারদের সভায় সামরিক অপারেশন পরিচালনায় বিশেষ ধরনের মুক্তিযুদ্ধ-সামরিক কমাÐ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। সেটার লক্ষ্য ছিল দখলদার পাক সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের (বাংলাদেশ সেনা বাহিনী ও অন্যসব মুক্তিযোদ্ধা) অপারেশনগুলো আরো সমন্বিত করা, দ্রæততর এবং অধিকতর সফল করে তোলা। আর একটা উদ্দেশ্য ছিল-যদি স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের ভিতরে কোনরকম অনাকাঙ্খিত বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়, সেই পরিস্থিতিতেও দখলদারদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা কোনভাবে ব্যাহত না হয়। কেউ কেউ মেজর জিয়াউর রহমানের সেই উদ্যোগ সর্ম্পকে ‘বাজে’ মন্তব্য করেছেন; আসল সত্য হচ্ছে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের একটা অংশের উদ্যোগে এবং বঙ্গবন্ধু অনুসারী ছাত্র-যুব নেতাদের একটা অংশের বিভ্রান্তিকর তৎপরতায় বিএলএফ ( মুজিববাহিনী) গঠনের উদ্যোগ মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে দারুণ ক্ষোভের সৃষ্টি করেছিল এবং ভারত সরকারের একটা অংশের নানারকম অপতৎপরতা বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর (সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য ও ফ্রিডম ফাইটার ‘এফ এফ’ এইসব মিলিয়ে যে সম্মিলিত বাহিনী) বা সামগ্রিক মুক্তিবাহিনী সশস্ত্র যুদ্ধ পরিচালনায় বাধা সৃষ্টি করেছিল। সেক্টর কমাÐার ও পরে জেড ফোর্স কমাÐার (ব্রিগেড কমাÐার) লে. কর্নেল জিয়াউর রহমান এই ব্যাপারে সবক’জন কমাÐারের মধ্যে বেশী সচেতন ছিলেন এবং বেশী সোচ্চারও ছিলেন। তখনকার প্রথম সারির কমাÐার সবাই (শফিউল্লাহ, খালেদ মোশাররফসহ) জিয়াউর রহামনের উদ্যোগের সমর্থক ছিলেন। এমনকি ভারতীয় সামরিক বাহিনীর জেনারেল জিয়াউর রহমানের তার যুদ্ধ পরিচালনা কৌশলের যথেষ্ট প্রশংসা করে গেছেন একটানা। সামরিক-অফিসার হিসেবে জিয়াউর রহমান আমাদের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার যে ভূমিকা রেখেছিলেন তা ছিল একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার সর্Ÿোচ্চ মাপের কাজ। দু:খজনক যে কিছু আওয়ামীলীগ রাজনীতির সমর্থক ( বা জ্ঞানপাপী) অবার্চীনের মতো স্বার্থান্ধতার কারনে মুক্তিযুদ্ধে জিয়াউর রহমান এর অবদানকে খাটো করার ব্যর্থ চেষ্টা চালান। এই হীনমন্যতা দুর হওয়া দরকার মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস রচনা এবং বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক মূল্যায়নের জন্যই। জাতি হিসেবে সেটা আমাদের অবশ্য কর্তব্য।

স্বাধীন বাংলাদেশে জিয়াউর রহমান জেনারেল ওসমানীর পরে সবচেয়ে সিনিয়র সামরিক অফিসার ছিলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর (মুক্তিবাহিনীর), তবুও তাকে সেনা প্রধান করা হল না, দ্বিতীয় সিনিয়র অফিসার শফিউল্লাহকে করা হলো সেনা প্রধান। (শফিউল্লাহ সাহেব নিজেও বিষয়টি স্বীকার করেছেন- জিয়াউর রহমানের আগে তার নিজের সেনাপ্রধান হওয়ার আগ্রহ ছিল না, বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর নিজের পছন্দ হয়েছিল, অন্য কারো কিছু করার ছিলনা’)। জিয়াউর রহমানকে সেনা বাহিনীর ডেপুটি চীফ করা হয়েছিল। সামরিক বাহিনীর শৃঙ্খলার স্বার্থে জিয়া সাহেব প্রধান মন্ত্রীর সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছিলেন এবং যথারীতি নিজ দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছিলেন। পচাত্তরের অগস্টের সেনা অভ্যুত্থান (বা সামরিক বাহিনীর বিভ্রান্ত কিছু সদস্যদের অপতৎপরতায়) সপরিবারে বঙ্গবন্ধু নিহত হলেন এবং বাকশাল সরকারের পতন ঘটল। জিয়াউর রহমান কোনভাবেই সেই সামরিক অপকর্মে জড়িত ছিলেন না। সেই সময়কার সামরিক বাহিনীর সামগ্রিক তৎপরতার বিবরণ থেকে এটা প্রমাণিত সত্য। সব ডকুমেন্ট নিরপেক্ষভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখলে এবং রাজনৈতিক কোন বিভ্রান্তি না থাকলে, সৎ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করা হলে এই সত্য ধরা পড়বে।

আগস্ট/পচাত্তর পরবর্তী সময়ে (পচাত্তর নভেম্বর) যে ভাবে ক্ষমতার আরেক দফা পরিবর্তন হলো এবং সেনা প্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলেন সেটা সাত-নভেম্বর এর সিপাহী জনতার অভ্যুত্থান থেকে উৎসারিত, জেনারেল জিয়াউর রহমান নিজে একটি চক্রান্ত করে ক্ষমতা দখল করেন নি। ইতিহাস সে সাক্ষ্য দেয়। সেই সময়কার সামরিক বাহিনীর ভিতরকার বিশৃঙ্খলা জিয়াউর রহমানের সৃষ্ট নয়, সেটি ছিল একটি রাজনৈতিক দল ও কিছু সামরিক অফিসার এর চক্রান্তের অনিবার্য পরিণতি (হয়ত পিছনে আরো অনেক কিছু ছিল, চক্রান্তকারী ছিল আরও)। জেনারেল জিয়াউর রহমান তার উপরে অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালনের চেষ্টা করেছেন। তিনি সেই সময় যদি পদত্যাগ করে সেনা বাহিনী থেকে চলে যেতেন, ভয়াবহ বিশৃঙ্খলায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এবং সেই সুত্রে সমগ্র সামরিক বাহিনী খÐ-বিখÐ হতো এবং অচিরেই পুরো রাষ্ট্রটি অকার্যকর হবার পথে চলে যেতে পারত। পাশের শক্তিশালী প্রতিবেশী রাষ্ট্রটি আধিপত্যবাদ কায়েমের সুযোগটি পেয়ে যে, হয়তো তা সে হাতছাড়া করত না-তার দেশেরে নিরাপত্তা অজুহাত তুলে। জিয়াউর রহমান প্রকৃত দেশপ্রেমিক সেনা কর্মকর্তা হিসেবে তার দায়িত্ব পালনের অঙ্গীকার রক্ষা করেছেন মাত্র-তা না করলে ইতিহাসে তিনি কাপুরুষ প্রমাণিত হতেন, এই দেশ আর স্বাধীন-সার্বভৌম-বাংলাদেশ না হয়ে ‘সিকিম’ হতে পারত।

১৯৭৬ সালের বাংলাদেশের এবং এই উপ-মহাদেশের ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে জিয়া সাহেব বুঝতে সক্ষম হয়েছিলেন- পূর্বতন রাজনৈতিক নেতৃত্ব আমাদের এই দেশটি প্রশাসনে এই রকম বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য তৈরি করে রেখে গেছে যে, এটিকে উদ্ধার করতে হলে তার রাজনৈতিক নেতৃত্ব পরিচালনা অপরিহার্য। তাই তিনি গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরির দিকে ধাপে ধাপে এগুতে লাগলেন। তিনি বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিলেন। এর আগে তো বাকশাল সিস্টেমে একদলীয় ব্যবস্থায় সব দল একীভূত হয়েছিল-বাকশাল এর ভিতরে। তিনি নতুন করে রেজিস্ট্রেশন দিলেন সব রাজনৈতিক দল-কে, আওয়ামীলীগ তার দেয়া রেজিস্ট্রেশন নিয়েই রাজনীতি শুরু করে। তিনি পুরো জাতিকে কর্মস্পৃহায় সমৃদ্ধ হবার রাস্তা দেখালেন, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অসাধারণ উন্নতি ঘটালেন। তিনি জাতির সামনে জাতীয় পর্যায়ের কর্মউদ্দীপনার এক নজীর সৃষ্টি করলেন- বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির ভেতরকার আলস্যপ্রিয় লোকগুলোকে কর্ম উদ্যমে উদ্দীপিত করলেন। তার খালকাটা কর্মসূচি এক অসাধারণ উদ্দীপনাময় কর্মকাÐ। পরে তিনি শিক্ষা সংস্কার, সংস্কৃতি সংস্কারে উদ্যোগ নিলেন। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের রাজনীতির উদগাতা হলেন তিনি। তিনি প্রমাণ করে ছাড়লেন-বাংলাদেশ হবে নিজস্ব সংস্কৃতির এক রাষ্ট্রব্যবস্থা যা একেবারেই সতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে মÐিত। এপার বাংলা ওপার বাংলা শ্লোগানের বিরোধিতা করলেন তিনি-তিনি গাইলেন “ প্রথম বাংলাদেশ আমার শেষ বাংলাদেশ, জীবন বাংলাদেশ আমার, মরণ বাংলাদেশ”। এই গান অমর হয়ে আছে এর ভেতরকার বাণীর জন্য। আজকের বাংলাদেশের যে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি তার ভিত রচনা করে দিয়ে গেছেন জিয়াউর রহমান।

জিয়াউর রহমান রাষ্ট্র ক্ষমতায় থেকে ভারত থেকে বাংলদেশ বিরোধী চক্রান্তকারী রাজনৈতিক কর্মীদেরকে ফেরত আনার ব্যবস্থা করলেন, ভারতের সাথে কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে তাদেরকে সেই দেশ থেকে বের করে দেয়ার ব্যবস্থা করলেন। চিত্ত সূতার ও অন্যদের চক্রান্ত প্রতিহত করলেন। মওলানা ভাসানীকে অনুরোধ করে ফারাক্কা মার্চ করালেন, যার পিছনে জিয়াউর রহমানের বিশাল অবদান রয়েছে। তিনি মধ্য প্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোর সাথে কূটনৈতিক সর্ম্পক উন্নয়ন করলেন। জিয়াউর রহমান ইরাক-ইরান যুদ্ধ বন্ধে কার্যকর উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তার আমলেই জনশক্তি রপ্তানী ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায় তার দূরদর্শী কর্মকাÐে। চীনের সাথে তিনি কূটনৈতিক সর্ম্পক দৃঢ়তর করেন, যাতে প্রতিবেশী রাষ্ট্রটির আধিপত্যবাদী মানসিকতা সামাল দেয়ার চেষ্টা সফল হয়েছিল। জিয়াউর রহমানের তৎপরতার ফলেই এই দেশে তৈরি পোশাক রপ্তানী খাতে প্রচুর সংখ্যক শিল্প কারখানা প্রতিষ্ঠিত হয়। এক কথায় জিয়া সাহেব প্রকৃত স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র এবং সমৃদ্ধ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টায় যা করে গেছেন তা নজিরবিহীন এক সফল রাষ্ট্রনায়কের কর্ম, এটা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না।

যেসব অর্বাচীন রাজনৈতিক কর্মী বা নেতা (তথাকথিত) জিয়াউর রহমানের বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের রাজনীতির অবদানকে খাটো করার অপচেষ্টা চালান তাদের কাছে সবিনয় নিবেদন, জিয়াউর রহমানের বিকল্প তখনকার দিনে ( ১৯৭৫ নভেম্বর থেকে ১৯৮১ মে সময়কাল অবধি) কি হতে পারতো তার ওপরে গবেষণা সমৃদ্ধ একটা বই লিখে দেখান, আমরা তার পাল্টা জবাব দেবো। (বিনীতভাবে চ্যালেঞ্জ রাখছি)।

লেখক: বিএনপি’র সাবেক তথ্য ও গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক এবং সাবেক সভাপতি-জাসাস।

Recent Posts