স্বপ্ন পূরণের হাতছানি

ওয়াকিল আহমদ

সাতচল্লিশ বছর পূর্বে ৭ নভেম্বর, ১৯৭৫ শাহবাগের মোড়ে ‘সিপাহি-জনতা’র বিজয়মিছিলে সেরূপ আনন্দ-উল্লাস-উদ্দীপনা দেখেছিলাম। উভয় মিছিল নাচে- শ্লোগানে মুখরিত ছিল। উপলক্ষও ছিল অভিন্ন আওয়ামী লীগের একদলীয় অপশাসনের অধঃপতন। দেশের এক অরাজক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে সেদিন স্বাধীনতার ঘোষক ‘মেজর জেনারেল’ জিয়াউর রহমানকে রাষ্ট্রের হাল ধরতে হয়েছিল। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে গিয়ে শেখ মুজিব দেশের রাজনৈতিক অবস্থাকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেন। ইতোমধ্যে দুর্ভিক্ষ্য হানা দিয়ে গেছে। আর্থিক অবস্থা ‘তলাহীন ঝুড়ি’তে পরিণত হয়েছে। ৭ নভেম্বর ১৯৭৫ পরবর্তী সময়ে জিয়াউর রহমান নিজ হাতে কোদাল-ঝুড়ি নিয়ে খাল কাটা কর্মসূচিতে নেমে পড়েছেন। উদ্দেশ্য ‘সবুজ বিপ্লব’ আনবেন। খরা মৌসুমে কৃষক সেচের পানি পাবে, ফসল ফলাবে, দুবেলা পেট-ভরে ভাত খাবে। তিনি গ্রামের মানুষের টেকসই উন্নয়ন চেয়েছিলেন, কেননা ৮০% লোক গ্রামেই বাস করে। এ ধারায় পরবর্তীতে তিনি ১৯ দফা কর্মসূচি গ্রহণ করেন।
যে স্বাধিকার, বাকস্বাধীনতা, গণতন্ত্রের জন্য মুক্তিযুদ্ধ, তা সফল করতে হলে সেনাশাসন নয়, জনগণের ভোটে নির্বাচিত একটি গণতান্ত্রিক সরকার দরকার। দেশবাসী তাই প্রত্যাশা করে। একদলীয় নয়, বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। জিয়াউর রহমান দেখেছেন, একদলীয় শাসন কর্তৃত্ববাদ ও স্বৈরাচারের জন্ম দেয়। আর এটাও লক্ষ্য করেন যে, আওয়ামী লীগারদের মধ্যে একটা আত্মকেন্দ্রিক, পরমত-অসহিষ্ণু ও আগ্রাসী মনোভাব কাজ করে। তখন দেশে আওয়ামীলীগ ছাড়া দৃশ্যগ্রাহ্য রাজনৈতিক দল ছিল না। এর বিপরীতে একটা শক্তিশালী নতুন রাজনৈতিক দল সংগঠন আবশ্যক ছিল। বলতে গেলে তাঁর একক চেষ্টায় ও নেতৃত্বে ১ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৮ দল গঠিত হলো, নাম দিলেন ‘বাংলাদেশ জাতিয়তাবাদী দল’; ইংরেজিতে ‘বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি’, সংক্ষেপে ’বিএনপি’। নামটি অতি দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সব ধারা থেকে শিক্ষিত, অভিজ্ঞ ও মেধাবী এবং বেশির ভাগ তরুণ লোক বাছাই করে অতি দুরূহ কাজটি সম্পন্ন করেন। দলগঠনে তিনি ডান-বাম-মধ্যপন্থির ও ধর্ম-বর্ণ-গোত্রের ভেদবিচার করেননি। তাঁরা যে মতাদর্শের হোন না কেন, বিএনপির ব্যানারে এক আম্ব্রেলার তলায় মিলিত হয়ে অভিন্ন মতাদর্শের অধিকারী হন, যার শিকড় মাটির গভীরে প্রবেশ করে দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়ে। তখন থেকে বিএনপির অপ্রতিরোধ্য যাত্রা শুরু। দুর্ভাগ্য আমাদের, দুর্ভাগ্য জাতির, দু বছরের মাথায় ১৯৮১ সালের ৩০ মে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান কতক ষড়যন্ত্রকারী সামরিক সেনার হাতে নিহত হন। জিয়া’র অবর্তমানে নবীন এই দলের হাল ধরেন বেগম খালেদা জিয়া; ইস্পাত-কঠিন হাত তাঁর। হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে তাঁর প্রজ্ঞা, দৃঢ়তা ও অনমীয় মনোভাবের পরিচয় পেয়ে দেশবাসী তাঁকে ‘আপোসহীন দেশনেত্রী’ আখ্যায় ভূষিত করে। ১০ বছর পর ১৯৯১ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অন্তর্ভুক্তিমূলক জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়ী হলে বেগম খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হিসাবে রাষ্ট্রের শাসনভার গ্রহণ করেন।
২০০১ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে তিনি তৃতীয় বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন। এরপর দানবীয় মূর্তি নিয়ে ফখরুদ্দিন-মঈনুদ্দিনের আবির্ভাব। তাঁদের আশীর্বাদপুষ্ট ও নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনের মাধ্যমে শেখ হাসিনা ক্ষমতা দখল করেন এবং ‘টুয়েন্টি টুয়েন্টি ওয়ান’, ‘টুয়েন্টি ফরটি ওয়ান’ ইত্যাদি মিশন-ভিশন প্রচার করে পিতার একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে দেশ শাসন করতে থাকে। অন্যদিকে চলতে থাকে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে ও তাঁর প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল বিএনপিকে মুছে ফেলার নিরন্তর অপপ্রচার। এক সময় বলা হলো, জিয়াউর রহমান ‘মুক্তিযোদ্ধা’ ছিলেন না, তিনি যুদ্ধ করেননি। তারা চন্দ্রিমা উদ্যানে জিয়ার মাজার উচ্ছেদে মাতলেন। এর আগে তারা ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে রাতের অন্ধকারে ‘বেইলি ব্রিজ’ সরিয়ে ফেলেছিলো।
দ্বিতীয় চক্ষুঃশীল বেগম খালেদা জিয়া। প্রথম চোটে তাঁকে ক্যান্টনমেন্টের বাসা থেকে উৎখাত করা হলো। তিন বারের প্রধানমন্ত্রীর ঢাকায় নিজস্ব বাড়ি নেই, ভাড়াবাসায় আশ্রয় নেন তিনি। এরপর একে একে অর্থ আত্মসাতের মিথ্যা মামলা দিয়ে এবং আদালতকে প্রভাবিত করে তাঁকে জেলে পুরা হলো। তিনি জেলে কঠিন রোগে ভুগতে থাকেন; বারবার আবেদন করেও উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে পারেননি। সরকারের তৃতীয় টার্গেট জিয়া পরিবারের জেষ্ঠ সন্তান উঠতি তরুণ রাজনীতিবিদ তারেক জিয়া।
ফখরুদ্দিন-মঈনুদ্দিন রিমান্ডে নিয়ে তাকে অমানুষিক নির্যাতন করে। লন্ডনে উন্নত চিকিৎসা করতে গিয়ে মামলা ও জেলহাজতের শিকার হয়ে তিনি আর দেশে ফিরতে পারেননি। তাঁকে পলাতাক দেখিয়ে সরকার তাঁর বক্তব্য গণমাধ্যমে প্রচার ও প্রকাশে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এব্যাপারে উচ্চ আদালতে রিট করলে সেসময় আজ্ঞাবহ আদালত তাঁর বক্তব্য, বিবৃতি, অডিও-ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, ইউটিউব থেকে সরাতে কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন। শুধু তাই নয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে প্রায়ই বলা হতো, তারেক রহমানকে দেশে এনে তাঁর বিচার ও শাস্তি কায়েম করা হবে। তাঁকে এতো ভয় কেন! তিনি এখনো বিদেশে আছেন। দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে মা-ছেলের দেখাসাক্ষাৎ নেই। এর মধ্যে ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকো অকালে মৃত্যুবরণ করেন।
চতুর্থ লক্ষ্য ছিল রাজনৈতিক দল বিএনপি। বিগত বছরগুলিতে প্রমাণিত হয়েছে, আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে একমাত্র বিএনপি প্রতিযোগিতা, প্রতিদ্বন্দিতা করতে পারে। বিএনপিকে নেতৃত্বশূন্য ও কোনঠাসা করে ধ্বংস করতে নানা কৌশল ও ফন্দি অবলম্বন করে পতিত আওয়ামী সরকারের মন্ত্রীরা ‘রেটরিক’ ভাষায় বিএনপি-কে কটাক্ষ ও তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে প্রায়ই বলেছেন, বিএনপির রাজনীতি মাঠে নেই, আছে বিদেশি রাষ্ট্রদূত পাড়ায়, বলেছেন, বিএনপির রাজনীতি এখন ‘ফ্রিজে’, আরও একটু চড়া গলায় বললেন, বিএনপি এখন ‘লাইফ সাপোর্টে আইসিইউতে কোমায়’ আছে। এসব হামলা-মামলা, জেল-জুলুম, অত্যাচার-নির্যাতন, কটুবাক্য করার একটাই উদ্দেশ্য বিএনপিকে শুধু তুচ্ছ জ্ঞান করা নয়, নিশ্চিহ্ন করা। বিএনপি নিশ্চিহ্ন হয়নি। বরং তারাই দেখতে দেখতে তাসের ঘরের মতো মুহুর্তে ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে অত্যাচারী স্বৈরাচারীর পতন হয়েছে। পালাবদল শুরু হয়েছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূস অন্তবর্তীকালীন সরকারের হাল ধরেছেন। সমগ্র বিশ্বে তাঁর একটা উজ্জ্বল ‘ইমেজ’ আছে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মহল তাঁর নিকট থেকে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন প্রত্যাশা করে। এরূপ নির্বাচনের জন্যই ১৬ বছর ধরে বিএনপি সংগ্রাম করে আসছে। চলমান আন্দোলনে বিএনপির ভূমিকা কি ও কতখানি, দেশবাসী তাও প্রত্যক্ষ করেছে। তাই একটি বৃহৎ ও জনপ্রিয় দল হিসাবে বিএনপি নির্বাচনে জয়ী হওয়ার আশা করতেই পারে। মনে রাখতে হবে, রাজপথের আন্দোলন আর একটি রাষ্ট্র পরিচালনা এক জিনিস নয়। বিএনপিতে নবীন-প্রবীণের সমাবেশ-সম্মিলন শুরুতে ছিল, এখনও আছে। ৪৫ বছর আগে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান যে ৪টি রাষ্ট্রনীতি ও ১৯ দফা কর্মসূ্চি দিয়েছিলেন, সেসব নীতির ও কর্মসূচির সাথে সাম্প্রতিক কালের চাহিদা ও মূল্যবোধের সমন্বয় ঘটিয়ে সামনের দিকে এগুতে হবে। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ, বহুদলীয় গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার ও সর্বপ্রকার বৈষম্যহীন সামাজের কথা তো আছেই, তার সাথে যোগ হয়েছে ‘ভালোবাসা, শান্তি ও জ্ঞানভিত্তিক সমাজে’র কথা। আমাদের রাজনীতিতে মানবতার ও জ্ঞানচর্চার বড় অভাব। বাংলার পোড়-খাওয়া মানুষ একটা সুদিনের স্বপ্ন দেখতে চায় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলকে ঘিরেই।


লেখক: সাবেক উপাচার্য, জাতীয় বিশ^বিদ্যালয়।