প্রেসিডেন্ট জিয়ার জীবন থেকে দুটি শিক্ষা

শফিক রেহমান

ফেব্রæয়ারি ১৯৭৯-এর সাধারণ নির্বাচনে বিএনপির বিশাল জয়ের পর ১৫ এপ্রিল ১৯৭৯-তে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ড. আর এ গণিকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি দফতরের দায়িত্বে প্রতিমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন। ড. গণি ছিলেন একজন ইঞ্জিনিয়ার। তিনি স¤প্রতি পরলোক গমন করেছেন। ড. গণির এই নিযুক্তি গুরুত্বপূর্ণ কেন ছিল সেটা বুঝতে হলে পেছনে ফিরে যেতে হবে। ওই সময়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে দুটি মৌলিক কিন্তু সুদূর প্রভাবশালী দুটি মঙ্গলজনক উপাদান জিয়া সংযুক্ত করেছিলেন।
এক. তিনি দেশের বিরাজমান সব বিভেদ ও বিভক্তির পরিবর্তে দেশকে ঐক্যবদ্ধ করতে চেয়েছিলেন। এ জন্য তিনি নিজে মুক্তিযোদ্ধা হয়েও তার মন্ত্রিসভায় ও প্রশাসনে মুক্তিযুদ্ধে যারা অংশ নেননি বা নিতে পারেননি অথবা যারা এক সময়ে পাকিস্তানে বিশ্বাসী ছিলেনÑ তাদের সবাইকে সঙ্গে নিয়েছিলেন একটি শান্তিময় বাংলাদেশ গড়া এবং দেশে দ্রæত অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে। তার সে লক্ষ্য অর্জিত হয়েছিল। প্রেসিডেন্ট জিয়া চাননি হিংসা, প্রতিশোধ, প্রতিহিংসার রাজনীতিতে জর্জরিত বাংলাদেশ। তিনি চেয়েছিলেন, অহিংসা, শান্তি ও উন্নয়নমুখী বাংলাদেশ।
তার সে নীতির বিপরীতে আমরা এখন দেখছি মামলা জর্জরিত বাংলাদেশ। মামলার ক্ষিধায় সদা কাতর আওয়ামী লীগের নির্যাতনে ঘরছাড়া বাড়িছাড়া নেতাকর্মীদের বাংলাদেশ। পাশাপাশি শেখ হাসিনা নকল করতে চাচ্ছেন জিয়ার উন্নয়নমুখিতাকে। সরকার এখন গণতন্ত্রকে বাদ দিয়ে উন্নয়নের ¯েøাগান দিচ্ছে। এখানেই জিয়ার সঙ্গে হাসিনার তফাৎ। জিয়া গণতন্ত্র ও উন্নয়ন- দুটোই একসঙ্গে চেয়েছিলেন। কিন্তু শেখ হাসিনা গণতন্ত্র বাদ দিয়ে কার্যত একদলীয় শাসনের দিকে যাচ্ছেন। এখনকার উন্নয়ন যে মুখ থুবড়ে পড়েছে সেটা মগবাজার ও সোনারগাঁও হোটেল সংলগ্ন দুটি ফ্লাইওভার বারবার ভেঙে ফেলায় প্রমাণিত হচ্ছে। আবাসনশিল্পে ৩০,০০০ ফ্ল্যাট বিক্রি হচ্ছে না। শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বেড়ে চলেছে।
জিয়া শত্রæকে ক্ষমা করেছিলেন, বিরোধীদের নির্ভয় দিয়েছিলেন। পলিটিক্স অব ইউনিটি বা ঐক্যের রাজনীতি ছাড়া প্রতিবেশী বিশাল দেশের পাশে বাংলাদেশের পক্ষে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে টিকে থাকা যে অসম্ভব, সেটা প্রেসিডেন্ট জিয়া ঠিকই বুঝেছিলেন। তার সেই শান্তি ও একতার রাজনীতি ম্যাডাম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি এখনো অনুসরণ করছে। দুঃখ কষ্টে ভরা এই বাংলাদেশে আরো ভেদাভেদ ও বিভক্তি যে উচিত নয়- সেটা আজ সবাইকে বুঝতে হবে। সুতরাং, একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে সাধারণ নির্বাচনের দাবিতে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হবার আহŸান জানাতে হবে বিএনপিকে।
দুই. প্রেসিডেন্ট জিয়া দ্বিতীয় যে মঙ্গলজনক উপাদান এনেছিলেন, সেটি হলো তার মন্ত্রিসভা থেকে শুরু করে প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে তিনি জ্ঞানী ও গুণীজনদের নিয়োগ দিয়েছিলেন, যারা সরাসরি কোনো দলীয় রাজনীতি করতেন না বা সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য ছিলেন না। প্রেসিডেন্ট জিয়া বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন গুণীজনকে তার কাছে টেনে এনেছিলেন। যেমন, লেখক আবুল ফজল, ইকনমিস্ট ড. মির্জা নুরুল হুদা, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার, চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট জামালউদ্দিন আহমেদ, চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট সাইফুর রহমান, চিকিৎসক ডা. এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী, ডা. এম এ মতিন, পানি বিশেষজ্ঞ বি এম আব্বাস এটি, শিক্ষাবিদ শামস-উল হক, শিক্ষাবিদ ড. আমিনা রহমান, কৃষিবিদ ড. ফসিহউদ্দিন মাহতাব, ইঞ্জিনিয়ার ড. আর এ গণি প্রমুখ। এছাড়া আরো অনেক প্রতিভাবান ব্যক্তিকে তিনি তার উপদেষ্টা পরিষদ অথবা মন্ত্রিসভায় স্থান দিয়েছিলেন। ফলে তার প্রশাসন ছিল সৎ ও দক্ষ, সরকার হয়েছিল কর্মক্ষম ও জনপ্রিয় এবং নবগঠিত পার্টি বিএনপির ভিত্তি হয়েছিল দৃঢ় ও স্থায়ী।
প্রেসিডেন্ট জিয়ার জীবন থেকে আজকের বিএনপিকে সেই শিক্ষা নিতে হবে। দেশে একতার রাজনীতি পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে দেশে এবং বিদেশে বিএনপির নেতৃত্বে জ্ঞানী ও গুণীজনের সমাবেশ ঘটাতেই হবে। বেগম খালেদা জিয়ার চারপাশে এবং লন্ডনে নির্বাসিত মি. তারেক রহমানের চারপাশে এই ধরনের জ্ঞানী ও গুণীজনের ভিড় সৃষ্টি করতে হবে।
তাহলেই প্রেসিডেন্ট জিয়ার প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা জানানো সম্ভব। এই প্রসঙ্গে ধন্যবাদ জানাতে চাই আমেরিকার শিকাগো শহর কর্তৃপক্ষকে এবং সেখানকার অধিবাসী বিএনপির সংগঠক শাহ মোজাম্মেলকে- যারা তাদের শহরে প্রেসিডেন্ট জিয়ার নামে একটি সড়ক করেছেন। বাংলাদেশের টিভি কুণ্ঠিত ছিল, টিভি ছিল ভীত। তাই আমেরিকার এই সুঘটনাটি বাংলাদেশে বহুল প্রচার পায়নি।
হৃদয়ে লেখা আছে
বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে সৎ, বিবেকবান ভদ্রলোকরা হারিয়ে যাচ্ছেন, বিদায় নিচ্ছেন অথবা মারা যাচ্ছেন। আওয়ামী লীগে এই ধরনের আদর্শ ও সত্যবাদী মানুষ এখন আর নেই বললেই চলে। বিএনপিতেও সেই অশুভ ধারা দেখা দিচ্ছে। এ বিষয়ে বর্তমান বিএনপির ভদ্র নেতাদের এখনই সচেতন হতে হবে। ভদ্রলোকদের পার্টিতে টেনে আনতে হবে।
প্রেসিডেন্ট জিয়ার অনুসৃত ক্ষমা, মহানুভবতা ও সহঅবস্থানের নীতিতে বিএনপিকে শত নির্যাতন, অত্যাচার আর অপবাদ সত্তে¡ও লক্ষ্য অর্জনে অটল থাকতে হবে।
সবাই জানেন, বর্তমানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে প্রেসিডেন্ট জিয়াকে পাকিস্তানের গুপ্তচর বলে হলিউডি গল্প প্রচারিত হচ্ছে। জিয়া উদ্যান থেকে তার সমাধিস্থল তুলে ফেলার দুরভিসন্ধি চলছে। কেউ কেউ নোবেল প্রাইজ না পেয়ে এখন হয়তো হলিউডের অস্কার প্রাইজ চাইছেন। জিয়ার বিষয়ে কল্পিত কাহিনী প্রধানমন্ত্রী ও তার সহকর্মীরা হয়তো মুভিতে রূপান্তরিত করতে চান। তাতে লাভ হবে না। বরং ৫ জানুয়ারি ২০১৪-র নির্বাচন কিভাবে হয়েছিল এবং প্রতিবেশী দেশের সমর্থনে কিভাবে আবার ক্ষমতাসীন হয়ে, জাতির ঘাড়ের ওপর আওয়ামী লীগ চেপে বসে আছে, সেই বিষয়ে মুভি করলে অস্কার পাওয়া যেতে পারে। কারণ এটি সত্য কাহিনী। ক্ষমতা দখলের অসাধারণ অবৈধ কাহিনী।
অশালীন, অভদ্র ও অসংযত নেতারা মনে করতে পারেন মান্না দের সেই গান…যদি হৃদয়ে লেখ নাম, সে নাম রয়েই যাবে।’ প্রেসিডেন্ট জিয়ার নাম বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ে লেখা আছে। সে নাম রয়েই যাবে।
কিন্তু বাংলাদেশের এই অবৈধ সরকারকে বিদায় দিতে হলে প্রয়াত প্রেসিডেন্ট জিয়ার জীবন থেকে উল্লিখিত দুটি শিক্ষা তার অনুসারীদের দ্রæত নিতে হবে।

Recent Posts