ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান : বিএনপি’র ভূমিকা ও সম্ভাবনা

প্রফেসর ড. সাইফুল ইসলাম

পহেলা সেপ্টেম্বর ২০২৪ বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের ৪৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর উৎসব পালন সবসময়ই আনন্দ ও গৌরবের। রক্তাক্ত জুলাই-আগস্ট, ক্ষত-বিক্ষত বাংলাদেশ; শতশত শহীদ ছাত্র-জনতার সাহসী আত্মদান বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল ও আপামর জনসাধারণকে একইসাথে গভীরভাবে শোকার্ত এবং ফ্যাসিবাদ মুক্ত স্বাধীনতার অবিমিশ্র আনন্দের অনুভূতি দিচ্ছে। গণতান্ত্রিক বাংলাদেশকে ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র হিসেবে কায়েম করতে অজ¯্র ভয়াবহ-ভয়ংকর নির্মমতার মধ্যদিয়ে গণদুশমন শেখ হাসিনা বেছে নিয়েছিল অ্যানার্কিজম (নৈরাজ্যবাদ)। হুমকির সম্মুখিন হলো দেশের স্বাধীনতা-সার্বোভৌমত্ব। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল গড়ে তুলে বৃহত্তর আন্দোলন। ‘ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ বড়’ এই প্রাতিশ্বিক বিবেচনায় ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সকল সরকার বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে একত্রে সংগঠিত করে। একসময় ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে পরিণত হয় ভয়াবহ পতন হয়, রক্ত পিপাসু সাইকোপ্যাথ শেখ হাসিনার। পুরোজাতি স্বাধীন মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস নেয় অশ্রুভরা আনন্দে।
৭ নভেম্বর ১৯৭৫-এ সিপাহী জনতার বিপ্লব ঘটলে রাষ্ট্রের অনিবার্য প্রয়োজনে দেশের স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এগিয়ে আসেন। অসাধারণ দৃষ্টিভঙ্গি ও সাহসী পদক্ষেপে বাংলাদেশের ইতিহাসে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান হয়ে ওঠেন অনবদ্য ও অনন্য। তিনি বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে জাতিকে সামগ্রিক কর্মকা-ে অংশগ্রহণের দৃঢ় আহ্বান জানান।
জিয়া হয়ে ওঠেন বাংলার রাখাল রাজা। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান যে মুহূর্তে বাংলাদেশের মানুষের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা হয়ে উঠলেন ঠিক সেই সময়েই ঘটে ইতিহাসের জঘণ্যতম অধ্যায়Ñঘাতকের বুলেটে তিনি শাহাদৎ বরণ করলেন। রক্তাক্ত হলো বীর চট্টলার মাটিÑ রক্তক্ষরণ হলো টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া, রুপসা থেকে পাথুরিয়ার সকল মানুষের হৃদয়। শহীদ জিয়ার পরে স্বৈরাচার এরশাদ সরকার ষড়যন্ত্রের মধ্যদিয়ে রাষ্ট্র সিংহাসন দখল করেÑ খর্ব হয় মানুষের মৌলিক অধিকার। দীর্ঘ নয় বছর আন্দোলন-সংগ্রামে বহু শহীদের রক্ত ঝরলো; ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে পতন হলো স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের। ১৯৯১ সালে নিরপেক্ষ তত্বাবধায়ক সরকার কর্তৃক স্বচ্ছ নির্বাচনের মাধ্যমে বিপুল জয় নিয়ে সরকার গঠন করে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল।
বেগম খালেদা জিয়ার সততা, মাহাত্ম ও সঠিক দেশ পরিচালনা প্রকৃতপক্ষে তাঁকে শহীদ জিয়ার প্রতিচ্ছবি করে তোলে। দেশের প্রতি কমিটমেন্ট, গণতান্ত্রিক পদ্ধতি সমুন্নোত রাখার প্রশ্নে তিনি কখনো কোথাও আপোষ করেন নি। এক এগারোর ফখরুদ্দিন-মঈন সরকার ও পরবর্তীতে ফ্যাসিস্ট স্বৈরাচারি হাসিনার অত্যাচার-অনাচারের বিরুদ্ধে তিনি কখনো রাজপথ ছাড়েননি। তাঁর ন্যায়নীতি ও বাংলাদেশের মানুষের প্রতি অগাধ বিশ্বাস-ভালোবাসায় পেয়েছেন আপোষহীন নেত্রীর ‘অভিধা’। বানোয়াট, মিথ্যা-ভিত্তিহীন মামলায় নিরপরাধ দেশ-মাতাকে বছরের পর বছর জেলে রেখেও বাংলার আপামর জনসাধরণ হতে বিযুক্ত করতে পারেনি ভোটারবিহীন খুনি বর্বর হাসিনা সরকার।
ফ্যাসিস্ট আওয়ামীলীগের ভোটারবিহীন অবৈধ সরকারের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান গণ-আন্দোলন গণ-বিস্ফোরণের রূপ নিতে থাকে। দাম্ভিক শেখ হাসিনা প্রতিনিয়ত মিথ্যাচার ও ভয়াবহ ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে নিঃশেষ করতে চাইলো বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের নাম ও নিশানা। দেশনায়ক তারেক রহমান বাংলাদেশ থেকে প্রায় ছয় হাজার মাইল দূরে অবস্থান করেও সাহস, মেধা ও দৃঢ়-দীপ্ততায় দল পরিচালনার নেতৃত্ব প্রদান করেন; দলের কা-ারি হয়ে অভেদ্য প্রাচীরের মতো। তাঁর দক্ষ ও নির্ভরযোগ্য নেতৃত্বে গড়ে উঠে গণ-আন্দোলন। কোনো আপোষকামিতা তাঁকে বিন্দুমাত্র স্পর্শ করেনি। আন্দোলনকে বারবার ভুলুন্ঠিত করেছে স্বৈরাচারি হাসিনার অবৈধ সরকার। কিন্তু দেশনায়ক তারেক রহমানসহ দলের সিনিয়র-জুনিয়র নেতা-র্কমীরা অসীম দৃঢ়তায় জাতীয়তাবাদী দলকে এগিয়ে নিয়েছেন গণআন্দোলন থেকে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের দিকে। ছাত্র-ছাত্রীদের ন্যায্য অধিকার ও কোটাবিরোধী আন্দোলনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল শুরু থেকেই পূর্ণ সমর্থন ও সহযোগিতা করার ঘোষণা দেয়। কূটকৌশলের অংশ হিসেবে খুনি হাসিনার আজ্ঞাবহ কোর্ট পূর্বসিদ্ধান্ত বাতিল করলে তাৎক্ষণিকভাবেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বাংলাদেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা এই রায়ের প্রতিবাদে বিক্ষোভ করতে থাকে। ঠিক সেই মুহূর্তে ভোটারবিহীন ফ্যাসিস্ট হুবরিজ আরোপিত সরকার চরম তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ও ঔদ্ধত্য ভাষায় আন্দোলনকারি শিক্ষার্থীদেরকে রাজাকার বলে অভিহিত করে। একই সঙ্গে ফ্যাসিস্ট সরকারের সাধারণ সম্পাদক ছাত্র ‘আন্দোলন দমানোর জন্য তার ছাত্রলীগই যথেষ্ট’ বলে মন্তব্য করে। শিক্ষার্থীরা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে আরও বেশিÑশুরু হয় ইতিহাসের নতুনপর্ব। সারা বাংলাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ছাত্রলীগ বিতাড়িত হয়; বিতাড়িত হয় পুলিশ। এর প্রত্যেকটি ঘটনায় দেশনায়ক তারেক রহমান প্রতিক্ষণ বাংলাদেশের সর্বসাধারণকে ছাত্র-জনতার পাশে থেকে গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে অবৈধ সরকারের পতন নিশ্চিত করার নির্দেশনা দিতে থাকেন। মূলত তারেক রহমানের নেতৃত্বেই দেশের দলমত নির্বিশেষে সকল শ্রেণিপেশার মানুষ হাসিনার পতনের গণ-আন্দোলনে যোগ দেয়। এক অভূতপূর্ব গণ-অভ্যুত্থান সংগঠিত হয়Ñ২০২৪-এর ৫ আগস্টে পতন হয় ফ্যাসিস্ট হাসিনা; খুনি হাসিনা দেশ থেকে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেয়। ছাত্র-জনতা এবং সারা দেশের মানুষ হাসিনার চরম পতন শুনে আনন্দ-উল্লাসে ফেটে পড়েন। খুনি বিশ্বাসঘাতক শেখ হাসিনার পলায়ন ১৯৭১ সালে তার পিতার পাকিস্তানী বাহিনীর কাছে স্বেচ্ছায় ধরা দিয়ে এবং বাংলার নিরীহ নিরস্ত্র মানুষকে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সম্মুখে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়াকে স্মরণ করিয়ে দেয়।
বর্তমানে উড়পঃৎরহব ড়ভ হবপবংংরঃু বা বিপ্লবোত্তর একটি অন্তর্বর্তীকালিন সরকার দেশ পরিচালনা করছে। জাতীয়তাবাদী দল অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে স্বাগত জানিয়ে সহযোগিতা অব্যাহত রেখেছে। রাষ্ট্র দখলের ষড়যন্ত্র এখনো থেমে নেই। ফ্যাসিস্ট হাসিনার দোসররা কখনো জুডিসিয়াল ক্যু, কখনো আমলা নির্ভর ক্যু ইত্যাদি ষড়যন্ত্র বারবার রুখে দিচ্ছে বাংলাদেশের জনগণ। ইতিহাসের শিক্ষা হলো ‘ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয়না’। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল ইতিহাসের শিক্ষাকে গ্রহণ করেই জনগণের স্বপ্ন, আশা-আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নে অতন্ত্র প্রহরীর মতো ভূমিকা রাখবে। জাতীয়তাবাদী দলের ৪৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে আমাদের সকলের শপথ হোক ‘শত শহীদের রক্ত¯œাত এই বাংলাদেশে মৌলিক মানবাধিকার, ন্যায়বিচার, সাম্য ও ন্যায্যতার ভিত্তিতে র্ষ্ট্রা পুনর্গঠন এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও সর্বক্ষেত্রে দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়া’। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের গড়া বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের সকল পর্যায়ের নেতা-কর্মী সমর্থকদের বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের মধ্যদিয়েই তৈরী হবে এক বৃহত্তর সোনালী সম্ভাবনা। যার নেতৃত্ব দেবেন মা মাটি মানুষের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ও দেশনায়ক জনাব তারেক রহমান।

লেখক: সাবেক চেয়ারম্যান ও অধ্যাপক, থিয়েটার এন্ড পারফরমেন্স স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।