ঐতিহাসিক ৭ই নভেম্বর

এ্যাড. রুহুল কবির রিজভী আহমেদ

বাংলাদেশের ইতিহাসের পাঠপর্বে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিকাশ এবং দেশবিরোধী চক্রান্তের বিরুদ্ধে দেশপ্রেমের জ্বলন্ত প্রমাণ রচনা হচ্ছে ঐতিহাসিক বিপ্লব ও সংহতি দিবস। ইতিহাসের এই দিনে সেনাবাহিনীর সাথে সাধারণ মানুষের যৌথ দেশপ্রেমবোধের ইতিহাস রচিত হয়েছিলো। ৭ ই নভেম্বর,  জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস। এই দিনটিতে মুক্তির মশাল জ্বলে উঠেছিলো ব্যারাক থেকে সাধারণের অন্তরে। স্বাধীনতার ঘোষক মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করে আনার পর ঢাকার রাজপথে মুক্তির আনন্দে উদ্বেলিত হাজার হাজার জনতার ঢল নেমেছিলো।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা উত্তর ইতিহাসে  বিপ্লব ও সংহতি দিবস দেশগঠনের ঐতিহাসিক সূচনাপর্ব যার মধ্য দিয়ে সার্বভৌমত্ব  বিরোধী গভীর সঙ্কট থেকে জাতি রক্ষা পেয়েছে। সেই ধারাবাহিকতায় দেশপ্রেম অটুট থাকুক সকলের অন্তরে; এগিয়ে যাক বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বহমান থাকুক ইতিহাসের বাংলাদেশ জুড়ে; বাংলাদেশ জিন্দাবাদ।

ইতিহাসের সত্যতা: ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের ঘটনা এবং ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে জাতীয় চার নেতা হত্যাকাণ্ডের ঘটনার ধারাবাহিকতায় ওই দিনই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উপপ্রধান ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ তার অনুসারী সেনাসদস্যদের নিয়ে এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে বন্দী করেন। আত্মস্বীকৃত পদোন্নতি নিয়ে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ, মেজর জেনারেলের ব্যাজ ধারণ এবং সেনাপ্রধানের পদ অবৈধ পন্থায় দখল করলেও নিরব বিদ্রোহ জেগেছিলো সৈনিকদের হৃদয়ে। ৬ নভেম্বর খালেদ মোশাররফ বঙ্গভবনের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ এবং তৎকালীন প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাক আহমদকে গ্রেফতার করেন। কথিত মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ মন্ত্রিসভা বাতিল ও জাতীয় সংসদ ভেঙে দেয়ার ঘোষণা দেন। একই দিনে তিনি প্রধান বিচারপতি আবু সা’দাত মোহাম্মদ সায়েমকে দেশের প্রেসিডেন্টের পদে এনে বসান। এভাবে চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, অনিশ্চয়তা ও একটা সংকটময় পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে কেটে যায় প্রায় চার দিন। পরবতীতে ৬ নভেম্বর গভীর রাতে সেনাবাহিনীর সাধারণ সিপাহিরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে দেশপ্রেমবোধ নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। সেই অভ্যুত্থানে সকলের সজীব সমর্থন দিয়ে সর্বস্তরের মানুষ রাজপথে নেমে আসেন।

সিপাহি-জনতার সেই বিপ্লবে  মুক্ত হন সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার  অভ্যুত্থান নস্যাত  করতে  গিয়ে প্রাণ হারান খালেদ মোশাররফ ও তার কিছু অনুসারী। ৭ নভেম্বর সর্বস্তরের সৈনিক ও জনতা সম্মিলিতভাবে নেমে আসে ঢাকার রাস্তায়, ছড়িয়ে পড়ে উচ্ছাসে আর ভালোবাসায়। বিশাল এক জনসংহতির নজির সৃষ্টি হয় দেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতি নির্মাণের প্রচেষ্টায়। তাইতো ৭ নভেম্বর হচ্ছে ‘জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস’।  ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর তদানীন্তন দৈনিক বাংলার রিপোর্টে বিপ্লব সম্পর্কে বলা হয়—‘সিপাহী ও জনতার মিলিত বিপ্লবে চার দিনের দুঃস্বপ্ন শেষ হয়েছে। মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বন্দিত্ব থেকে মুক্ত হয়েছেন যা ছিলো মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ নির্মাণের এক মহারথ। বৃহস্পতিবার রাত প্রায় ১টায় সশস্ত্র বাহিনীর প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, নৌবাহিনীর সিপাহী-জওয়ানরা বিপ্লবী অভ্যুত্থান ঘটিয়েছেন। ষড়যন্ত্রের ভেদ  ছিন্ন করে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে উদ্ধার করেছেন দেশপ্রেমিক  সিপাহীরা। ৭ নভেম্বর শুক্রবার ভোরে রেডিওতে ভেসে আসে ‘আমি মেজর জেনারেল জিয়া বলছি’। জেনারেল জিয়া জাতির উদ্দেশে ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে যথাস্থানে নিজ নিজ দায়িত্ব পালনের জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানান এবং শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষার প্রয়োজনে কাজ করে যাবার আহবান জানান। রাজধানী ঢাকা সেদিন মিছিলের নগরীতে পরিণত হয়েছিলো। পথে পথে সিপাহী-জনতা আলিঙ্গন করেছে একে অপরকে।  দেশপ্রেমিক সিপাহী-জনতার মিলন মেলায় ধ্বংস হয়ে যায় স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ববিরোধী সকল ষড়যন্ত্র। আনন্দে উদ্বেলিত সাধারণ  মানুষ নেমে আসেন রাজপথে। সাধারণ মানুষ ট্যাংকের সামনে রাখেন ফুলের মালা। এই আনন্দের স্রোত রাজধানী ছাড়িয়ে দেশের সব শহর-নগর থেকে প্রত্যন্ত গ্রামেও পৌঁছে যায়।’ ৭ নভেম্বর সম্পর্কে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সাংবাদিক অ্যান্থনি মাসকারেনহাস তার ‘বাংলাদেশ এ লিগ্যাসি অব ব্লাড’ বইতে লিখেন—‘১৯৭৫ সালের ৫ ও ৬ নভেম্বর ক্যান্টনমেন্টসহ সারা শহরে ছড়ানো হলো হাজার হাজার প্রচারপত্র। এই কাজগুলো করল বামপন্থী জাসদ। এ সময় রাজনৈতিক দল জাসদ ছিল নিষিদ্ধ। কিন্তু এরা কাজ করছিল বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা এবং বিপ্লবী গণবাহিনীর নামে। একটি ব্যাপারে ডান ও বাম উভয় রাজনৈতিক দলই একমত ছিল। আর তা হচ্ছে, খালেদ মোশাররফ একজন বিশ্বাসঘাতক, ভারতের দালাল এবং সে ঘৃণিত বাকশাল ও মুজিববাদ ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিলো।’

গণজাগরণের ডাক দিয়ে জাসদ ১২টি দাবি পেশ করে। এগুলোর মধ্যে ছিল—ব্যাটম্যান প্রথা বাতিল করতে হবে, অফিসারদের ব্যক্তিগত কাজে সৈন্যদের ব্যবহার করা চলবে না, পোশাক ও পদমর্যাদার ক্ষেত্রে জওয়ান ও অফিসারদের ব্যবধান দূর করতে হবে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে, সকল রাজবন্দিকে মুক্তি দিতে হবে। জাসদের দাবিগুলো সে সময়ে তাত্ক্ষণিকভাবে সৈনিকদের সমর্থন আদায়ে সক্ষম হয়েছিলো খানিকটা। জাসদের এই দাবিনামা এবং গণঅভ্যুত্থানের ডাক দেয়ার পেছনে যে ব্যক্তিটি কাজ করছিলেন—তিনি হলেন সাবেক আর্মি অফিসার লে. কর্নেল (অবসরপ্রাপ্ত) আবু তাহের। তিনিই প্রথম জওয়ানদের মধ্যে ‘ওরা এবং আমরা’ এই ধারণার সৃষ্টি করান এবং অফিসারদের বিরুদ্ধে জওয়ানদের ক্ষেপিয়ে তোলেন। কিন্তু তাদের ষড়যন্ত্র শেষ অবধি টিকেনি দেশপ্রেমিক সিপাহিদের  কর্মকাণ্ডের জন্য।

৭ নভেম্বরের ভোরের দিকে জওয়ানরা ব্যারাক থেকে বেরিয়ে পড়ল। তারা অস্ত্রাগার থেকে স্টেনগান-রাইফেলসহ অন্যান্য অস্ত্র সংগ্রহ করলেন এবং তারা ‘সিপাই-সিপাই ভাই ভাই, অফিসারদের রক্ত চাই’ এবং ‘সিপাই-সিপাই ভাই ভাই, সুবেদারদের ওপরে অফিসার নাই’ ইত্যাদি স্লোগান দিতে দিতে দ্রুত ক্যান্টনমেন্টে ছড়িয়ে পড়ল। সারা ঢাকা শহরে এই ‘সিপাহি বিপ্লব’ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল। রাত ১টার মধ্যেই সিপাহিরা পুরো ক্যান্টনমেন্ট দখল করে নিল। এদের কেউ কেউ ক্রমাগত ফাঁকা গুলি ছুড়তে লাগল। অন্যরা উত্তেজিত অবস্থায় স্লোগান দিতে দিতে অফিসারদের খুঁজতে লাগল। বেঙ্গল ল্যান্সারের হাবিলদার সারওয়ারের নেতৃত্বে একদল জওয়ান গেল জেনারেল জিয়ার বাসভবনে। চার দিন বন্দি থাকার পর মুক্তি পেলেন জেনারেল জিয়াউর রহমান। নৈশ পোশাক পরিহিত অবস্থাতেই জিয়াকে উল্লসিত জওয়ানরা কাঁধে করে নিয়ে গেল ২ ফিল্ড আর্টিলারির হেডকোয়ার্টারে। ঘটনার আকস্মিকতায় তখন বিহ্বল হয়ে পড়েছেন জিয়া। নাম না জানা অনেক জওয়ানের সঙ্গে আলিঙ্গন, করমর্দন এবং সংক্ষেপ মতবিনিময়ও করলেন। মুক্ত হয়ে জিয়া প্রথমেই ফোন করলেন জেনারেল খলিলকে। তাকে বললেন, ‘আমি মুক্ত। আমি ভালো আছি। আমার জন্য কোনো চিন্তা করবেন না।’ জিয়া তার মুক্তিদাতাদের কয়েকজন অফিসারকে তার কাছে নিয়ে আসতে বললেন। তারা হচ্ছেন জেনারেল মীর শওকত আলী, জেনারেল আবদুর রহমান এবং কর্নেল আমিনুল হক। সৈন্যরা যখন তাদের নিয়ে এলো, তখন তিনি তাদের প্রত্যেকের সঙ্গে কোলাকুলি করলেন। সৈন্যদের নিয়ন্ত্রণ করতে তিনি তাদের সহযোগিতা চাইলেন। জিয়াউর রহমান বললেন, ‘আমি রক্তপাত চাই না।’ রাত দেড়টার দিকে জওয়ানরা রেডিও স্টেশন দখল নিয়েছিলো। তারা রাতের কর্মীদের জানাল যে, জেনারেল জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে সিপাহি-জনতার বিপ্লব শুরু হয়ে গেছে। বিস্মিত রেডিওর কর্মকর্তারা প্রথমে বুঝে উঠতে পারলেন না তারা কী করবেন। যখন তারা টের পেলেন যে, জওয়ানরা তাদের ভয় দেখাচ্ছে না এবং খালেদ মোশাররফ পরাজয়বরণ করেছেন; তখন তারা সবাই উল্লসিত সৈন্যদের সঙ্গে যোগ দিলেন। সৈন্য এবং সাধারণ মানুষ ভর্তি কিছু ল্যান্সার ট্যাঙ্ক শহরের মাঝখানে এসে পৌঁছল। ক্যান্টনমেন্টে গোলাগুলির শব্দ শুনে প্রথমে লোকজন ভয় পেয়ে গিয়েছিল। কিন্তু রেডিওতে ক্রমাগত ‘সিপাহি বিপ্লবের’ ঘোষণা এবং জেনারেল জিয়ার ক্ষমতায় আসার খবর শুনে হাজার হাজার লোক স্রোতের মতো রাস্তায় নেমে এলো।

কষ্টে অর্জিত স্বাধীনতা আর বিপন্ন হলো না; এখন দুঃস্বপ্ন কেটে গেলো সর্বত্র জওয়ান এবং সাধারণ মানুষ খুশিতে একে অপরের সঙ্গে কোলাকুলি করল, রাস্তায় নামল।  ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের মতো অবস্থা সৃষ্টি হয়েছিলো এবং মনে হচ্ছিলো এদেশের মানুষ আবার জেগে উঠেছে। এটা ছিল একটি স্মরণীয় রাত। রেডিও বাংলাদেশে এক সংক্ষিপ্ত ভাষণে জেনারেল জিয়াউর রহমান ঘোষণা করেন, তিনি সাময়িকভাবে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেন। সেনাবাহিনীর অনুরোধে এবং দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে বাধ্য হয়েই তিনি এ দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। তিনি বলেন, সাধ্য অনুযায়ী তিনি তার কর্তব্য পালন করবেন। দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তিনি সবাইকে ঐক্যবদ্ধ এবং কঠোর পরিশ্রম করার আহ্বান জানান। তিনি অবিলম্বে সবাইকে কাজে যোগ দেয়ারও নির্দেশ দেন।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা উত্তর ইতিহাসে  বিপ্লব ও সংহতি দিবস দেশগঠনের ঐতিহাসিক সূচনাপর্ব যার মধ্য দিয়ে সার্বভৌমত্ব  বিরোধী গভীর সঙ্কট থেকে জাতি রক্ষা পেয়েছে। সেই ধারাবাহিকতায় দেশপ্রেম অটুট থাকুক সকলের অন্তরে; এগিয়ে যাক বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বহমান থাকুক ইতিহাসের বাংলাদেশ জুড়ে; বাংলাদেশ জিন্দাবাদ।

Recent Posts