জাতীয়তাবাদী চেতনার উৎস “প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান”


বীর মুক্তিযোদ্ধা এম এ মালেক

প্রাকৃত জীব মানব প্রকৃতির চেতনায় কিছু বিশেষ ব্যক্তির জন্ম ও মৃত্যু আসাধারণ গুরুত্ব পায় তখনই, যখন সেই বিশেষ ব্যক্তির অতীত জীবনের কর্মকাÐে প্রকৃতপক্ষে সামাজিক মানুষের সার্বিক মুক্তির কথা বলে। প্রেসিডেন্ট শহীদ জিয়াউর রহমানের জন্ম-মৃত্যুর কালজয়ী অধ্যায় সেই চেতনারই বহিঃপ্রকাশ।

বলতে দ্বিধা নেই প্রকৃতি তার নিজের প্রয়োজনেই স্থান, কাল ও পরিবেশের ভিন্নতায় প্রকৃতি প্রদত্ত নেতার জন্ম দেয়। সেই নেতাই দেশ জাতি তথা সার্বিক অর্থে জনগণের সার্বিক মুক্তির পথ রচনা করে। এটাই প্রকৃতির নিয়ম। প্রেসিডেন্ট শহীদ জিয়াউর রহমান তার অতীত কর্মের মধ্যে দিয়ে বেঁচে থাকবে যুগযুগ। অসাধারণ গুরুত্বতায় সাধারণ মানুষের কর্মের অনুপ্রেরণায় সময়ের দাবিতে অমর হয়ে। সতত প্রবচন- জন্ম হউক যথাতথা কর্ম হউক ভালো। দেশীয় এ প্রবচনটি সেই সত্যের কথাই বলে। প্রকৃত এই সত্যকে ধারণ করেই মানুষের জীবন ও জীবিকা, এই জীবন ও জীবিকা নির্ভর করে উৎপাদনের উপর, উৎপাদন নির্ভর করে মাটির ওপর, মাটির উৎপাদিত পণ্যই জীবিকার আধার। জীবিকার আধার নির্ভর করে কাজ আর কর্মের ওপর। জীবিকার প্রয়োজনে মানুষ যে কাজ আর কর্ম করে তাই সামাজিক বিষয়। সামাজিক মানুষের আচার-আচরণের বহিঃপ্রকাশ মানসিক সংস্কৃতি, মানুষের মানসিক সংস্কৃতির উৎস- মা, মাটি ও মানুষ। এজন্যই আমাদের সংস্কৃতিতে মা, মাটি ও মানুষ একটি পরিপূর্ণ বিষয় এবং তারই অন্তর্নিহিত তিন তিনটি উপাদানের স্বতত প্রবচন- একের ভিতর তিন। অর্থাৎ এই তিনের বৃত্তীয় চক্র (সাইক্লিক অর্ডার) এর মধ্যেই নিহীত জীবন ও জগতের সব কিছু। এজন্যই পৃথিবীতে মানুষের অবলম্বন হিসাবে মা, মাটি যথাক্রমে প্রতিভাত হয় নাগরিক ও জাতি এবং ঘর ও রাষ্ট্র। মায়ের পরিচয় থেকে আত্মপ্রকাশ ঘটে মানুষ ও মানুষের সমাজ যথাক্রমে মানব সভ্যতা, কৃষ্টি ও সংস্কৃতি। তাই হয়েতো ফ্রান্সের স¤্রাট নেপোলিয়ন বোনাপার্ট এর আত্মবোদন ‘তোমরা আমাকে একটি সু-শিক্ষিতা মা দাও, আমি তোমাদের একটি সু-শিক্ষিত জাতি উপহার দেব’।

পৃথিবীর সকল প্রজ্ঞাবান সমাজ সংস্কৃতির মুক্তি ও বিকাশের জন্য একমাত্র মা-কেই অবলম্বন হিসেবে দেখেছেন। কারণ মাতৃউদর থেকে ভূমিষ্ট হয়ে যে ভূমিতে মানুষের আশ্রয় সেই মাটিই হলো প্রতিটি মানুষের তথা প্রতিটি মানব জাতির জন্য প্রিয় মাতৃভূমি তথা স্ব-স্ব জন্মভূমি-স্বদেশ। সেই চেতনায় আমাদের মা ও মায়ের ভাষা বাংলা থেকে মাতৃভূমি আ-মরি বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশ। আর এর পরিচয়েই আমরা বাংলাদেশি।

অতএব, একটি দেশ ও জাতির প্রাণ ও জীবনী শক্তি বলেতে মা-মাটিকেই বুঝিয়ে থাকে। অথচ আমরা প্রতিদিন প্রতিনিয়ত আমাদের নিত্যদিনের কথাবার্তা ও কাজে কর্মে, চিন্তা-চেতনায় এবং সাহিত্য-সংস্কৃতিতে বা দর্শনে-রাজনীতিতে সেই মা ও মাটি থেকে দূরে, বহুদূরে সরে যাওয়ার অর্থ ’৭১-এর স্বাধীনতার ঘোষণা এবং তা থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধ ও যুদ্ধের চেতনার সাথে আত্মপ্রতারণার পরিচয়ে আত্মঘাতী রাজনৈতিক জাতিতে পরিণত হওয়া। এই বিচারে মানুষের কর্মের ফসল দুটি ধারায় প্রতিভাত হয় যথাক্রমে সাম্য ও মৈত্রী। এই সাম্য-মৈত্রী নির্ভর স্ব-স্ব ভূখÐের আবহাওয়া জলবায়ুর ভিন্নতার প্রাকৃত পরিবেশে অর্থাৎ ভিন্ন ভিন্ন প্রাকৃত পরিবেশে মাটির মর্মরে নিহিত আত্মবোদনের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। এমনতর প্রাকৃত ভিন্নতায় ভিন্ন ভিন্নভাবে জাতীয়তার পরিচয় প্রকাশ পায় এমন প্রাকৃত চেতনায় মা-মাটির অস্তিত্ব রক্ষায় প্রেসিডেন্ট শহীদ জিয়াউর রহমান এই যুগে একটি স্মরণীয় নাম। ’৭১ এ জিয়াউর রহমানের দ্বারা স্বাধীনতার ঘোষণা থেকে ৭ নভেম্বর ’৭৫-এর সিপাহি বিপ্লবোত্তর মাতৃভূমির মানুষকে সংগঠিত করে সেই কিংকর্তব্যবিমূঢ় জাতিকে উন্নয়নের ধারায় ফিরিয়ে এনে জাতিকে আন্তর্জাতিকভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত করে আত্মনির্ভরশীল জাতিতে পরিণত করেছিলেন এবং সাবেক পূর্ব পাকিস্তান এককালের প্রাকৃত মধ্য বাংলা বা আজকের বাংলাদেশি জাতির জাতীয়তার প্রশ্নে আলাদা সত্তার পরিচয়ে পরিচিত করার মাধ্যমে আত্মমর্যাদা সম্পন্ন জাতিতে আত্মপ্রকাশ ঘটানো শুধু তার রাজনৈতিক দূরদর্শিতার পরিচয়ই বহন করে না বরং তা ইতিহাসের পাতায় অসাধারণ গুরুত্ব পায় যা ইতিহাস হয়ে থাকবে। রাষ্ট্র পরিচালনায় দেশের পক্ষে অর্থনীতিতে পুনর্জীবন ফিরিয়ে এনে এবং দক্ষিণ এশিয়ান রাষ্ট্রসমূহের সাথে সৃষ্ট আঞ্চলিক ফোরাম সার্ক, আর্ন্তজাতিক বিশ্ব ফোরামে নবদিগন্তের সূচনা করে। ওআইসিভুক্ত দেশসহ সারা বিশ্বভাতৃত্ব বন্ধন সৃষ্টিতে তার রাজনৈতিক ভূমিকা জিয়াকে করেছিল আন্তর্জাতিকতাবাদী। এভাবেই প্রেসিডেন্ট শহীদ জিয়াউর রহমান মা থেকে মাতৃভূমি ও তার জনগণকে জাতিক ও আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। বাংলাদেশি জাতির জাতীয় পরিচয় মূল্যায়ন ও বহুদলী গণতন্ত্র বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ দর্শন ভিত্তি রাজনৈতিক দর্শন প্রবর্তন করে সঠিক সিদ্ধান্ত এনে দিয়ে জিয়া এই জাতির কাছে হয়েছিলেন মহান। সাংস্কৃতিক বিপ্লবের রূপরেখা প্রণয়ণে মাদ্রাসা শিক্ষায় আমূল পরিবর্তন এনে বাংলা, আরবির পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ভাষা ইংরেজি ও কারিগরী শিক্ষা প্রবর্তন করে তথা সামাজিক রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক এ দুটি মানবিক ধারার রাজনীতির সমন্বয়ে জনগণকে তাদের আত্মবিকাশের মধ্যে দিয়ে রাজনীতিতে নতুন ধারার সূচনা করে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের রূপরেখা প্রণয়ণ করেন। সাবেক প্রেসিডেন্ট শহীদ জিয়াউর রহমানের এমন চিন্তা-চেতনা তার রাজনৈতিক দূরদর্শী চিন্তা-চেতনারই বহিঃপ্রকাশ। প্রেসিডেন্ট শহীদ জিয়াউর রহমান বিশ্বাস করতেন রাষ্ট্র রাজনীতির প্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্র রাজনীতি বিলীন হয়ে যায় যদি রাজনৈতিক দল না থাকে এই জন্যই তিনি প্রতিষ্ঠা করেন জাতীয়তাবাদী দল। আর রাজনৈতিক দলের সম্পৃক্ততার জন্য গঠন করেন অঙ্গসংগঠন এবং পরিপূরকতার প্রশ্নে গঠন করেন জাসাস। কিন্তু ভূতত্ত¡ থেকে নেতৃত্ব এই দুইয়ের নিরবচ্ছিন্নতার ফসল-সৃষ্টি। সৃষ্টির মূলে মাটি তথা জন্ম দাত্রীর মায়ের সাথে তুলনীয়। এই জন্যই দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষায় মা, মাটির চেতনাই প্রতিভাত হয়। যা থেকে আত্মপ্রকাশ ঘটে একজন জাতীয়তাবাদী নেতার। প্রেসিডেন্ট শহীদ জিয়াউর রহমানের জন্ম-মৃত্যু বিষয়ক ঘটনা আলোচনার অবতারণের ক্ষেত্রে তার কর্মময় জীবনের উল্লেখযোগ্য দিকগুলো নিয়ে আলোচনা করার বিকল্প কোথায়?

প্রেসিডেন্ট শহীদ জিয়াউর রহমান ১৯৩৬ সালে ১৯ জানুয়ারি বগুড়া জেলার গাবতলী থানাধীন নশীপুর বাগবাড়ী গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন।

ইতিহাস থেকে জানা যায় প্রেসিডেন্ট শহীদ জিয়াউর রহমানের দাদির পূর্ব পুরুষগণ মোঘল আমলে সেই সুদূর ইরান থেকে এসে প্রথমে দিনাজপুর জেলার বালুর ঘাট (ঘোড়া ঘাট) আগমন করেন। পরবর্তীতে সেই পরিবারের আল্লাদী মÐলের একপুত্র রজব মাহমুদ প্রামাণিক এবং তার একমাত্র পুত্র আলা মাহমুদ পাইকার আবাসস্থল পরিবর্তন করে নশীপুর বাগবাড়ী গ্রামে স্থানীয়ভাবে বসবাস শুরু করেন। পরবর্তীতে আলা মাহমুদ পাইকারের ৯ ছেলে ও ২ মেয়ে যথাক্রমে আলম মাহমুদ তালুকদার, কলম তালুদকার, কলিম মাহমুদ তালুকদার, করিম বক্স তালুকদার, মোফাহতুল্লাহ তালুকদার, আলমতুল্লাহ তালুকদার, ইশারতউল্লাহ তালুকতার, দৌলতুজ্জামান তালুকদার ও কন্যা নাশা ও পিঞ্জরাকে রেখে মৃত্যুবরণ করেন। প্রেসিডেন্ট শহীদ জিয়াউর রহমানের দাদা মৌলভী কামাল উদ্দিন মÐল আলা মাহমুদ তালুকদারের ৪র্থ ছেলে করিম বক্স তালুকদারের এক মাত্র কন্যা মেহেরুন্নেছাকে বিবাহ করে বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ হন এবং তখন থেকেই জিয়াউর রহমানের দাদা মৌলভী কামাল উদ্দিন মÐল পার্শ্ববর্তী মহিষাবান নামক গ্রামের আবাসস্থল পরিবর্তন করে এই নশীপুর বাগবাড়ী গ্রামে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। পরবর্তী আলোচনায় পিতা-পিতামহ এবং তার দাদি ও দাদার বংশগতিক আলোচনার প্রয়াসনেব যাতে করে একজন জাতীয়তাবাদী নেতার প্রকৃত পরিচয় মানবিক মূল্যবোধের বিভিন্ন দিকগুলো আলোকপাতে সহায়তা করে।

প্রেসিডেন্ট শহীদ জিয়াউর রহমানের দাদা ও দাদির বংশগতিক পরিচয়ের মধ্যে দিয়ে তথা পারিবারিক উপাধিগুলো বিশ্লেষণে পাওয়া যায়, এককালের দুটি পরিবার কালের গর্ভে হারিয়ে গিয়ে পুনরায় একই স্থানে এসে লীন হয়ে রয়েছে। যা একই নদীর ¯্রােতধারা কালের গর্ভে বিলীন হয়ে পুনরায় একই স্থানে মিলন ঘটে যা প্রেসিডেন্ট শহীদ জিয়ার দাদা ও দাদি উভয়ের পূর্ব পুরুষগণের পারিবারিক উপাধি ‘মÐল’ থেকে অনুমেয় হয়। এই উপাধিগুলো প্রমাণ করে এই পরিচয় যেন একই পরিবারের দুইটি অংশ এক কালে হারিয়ে যায় আবার নিয়তির বিধানের লেখা ‘সৃষ্টি সুখের উল্লাসে” পুনঃ একই স্থানে মিলিত হয়। প্রেসিডেন্টের দাদির বংশের তৃতীয়-চতুর্থ পুরুষের সাথে পারিবারিক উপাধির পার্থক্যটাও লক্ষণীয়। প্রথম পুরুষের পারিবারিকভাবে ব্যবহারিক উপাধি, “মÐল” পরিবর্তীতে হয়ে পরে “প্রমাণিক” এবং তারপর “পাইকার” এবং এরও বহু পরে “তালুকদার” উপাধিতে পরিবর্তীত হয়েছিল। প্রেসিডেন্ট শহীদ জিয়াউর রহমানের পূর্ব পুরুষদের পারিবারের সাথে বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ এবং নশীপুর বাগবাড়ী একই গ্রামের বাড়িতে বসবাসকারী আরও দুটি পরিবারের সাথে বংশগত উপাধি পরিবর্তীত হয়ে সরকার উপাধিতে পরিবর্তন লক্ষণীয়। তবে পরিবারিক উপাধি “মÐল” প্রমাণিক, পাইকার, তালুকদার, সরকার, তরফদার প্রতিটি উপাধি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।

ব্রিটিশ শাসনামলে ফিফথ এর রিপোর্ট গ্রাম প্রধানকে “মÐল” মুকাদ্দাম বিভিন্ন পরিভাষিক শব্দে উল্লেখ করা হয়েছে। ১৮ জুন ১৮৮৯ সালের মাউনিউটের ক্রমিক নং ২৪২-২৮৪ পৃঃ এ গ্রাম প্রধানের কর্তব্য ও দায়িত্ব বর্নণায় মÐল পরিভাষাটিকে ব্যবহার করছে। তৎকালে সরকারি রাজস্ব নির্ণয়, কৃষি নিয়ন্ত্রণ এবং রাজস্ব আদায়ের প্রয়োজনেই এই “মÐল” পতিদের সহায়তা ও সাহায্যের প্রয়োজন হতো এবং সকল সামাজিক গুরুত্বতার কারণে এক এক অঞ্চলের সবচাইতে জ্ঞানী গুণী ব্যক্তিদের “মÐল” বানানো হতো। প্রজাদের ভালো মতামতের ওপরই মÐলের প্রভাব প্রতিপত্তি নির্ভর ছিল সামাজিক নিয়ম। রাজশাহী ও তৎ বৃহৎ পরগণায় মÐলরাই ছিল জমির প্রকৃত মালিক এবং প্রশাসনিক ক্ষেত্রে ও তার বিরাট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার অধিকারী ছিলেন। মুসলিম পূর্ব যুগের লিপিতে ভৌগোলিক ও প্রশাসনিক ইউনিটের নামরূপে “মÐল” ব্যবহার দেখা যায়। তৎসময় “মÐল” প্রধান “মÐল” প্রতি নামে আখ্যায়িত ছিলেন। মুসলিম যুগ ও ব্রিটিশ যুগের প্রথম দিকে “মÐল” শোর কর্তৃক বর্ণিত ভূমিকা পালন করতেন ও সমতুল্য মর্যাদার অধিকারী ছিলেন বলে ইতিহাস বিদগণ মনে করেন। এই বংশের পরবর্তী উপাধি প্রমাণিক।

“প্রমাণিক” শব্দের আভিধানিক অর্থ প্রমাণসিদ্ধ, বিভক্ত ও সমাজ ব্যবস্থাপক ইত্যাদি। আমার আলোচ্য বংশ তালিকায় প্রেসিডেন্ট শহীদ জিয়াউর রহমানের দাদির পূর্ব পুরুষগণের নামের তালিকায় জনাব আল্লাদি মÐলের পুত্র জনাব রজব মাহমুদের নামে প্রমাণিক উপাধির ব্যবহার থেকে প্রতিয়মান হয় যে, মÐলের দায়িত্ব পালনে সম্ভবত তিনি বিশেষ বিজ্ঞতা প্রদর্শনে সক্ষম হয়েছিলেন এবং কর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ প্রমাণিক উপাধি লাভ করেন। পরবর্তীতে বংশগতিক উপাধি পরিবর্তীত হয়ে “পাইকার” উপাধি ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। স্থানীয় অনুসন্ধানে জানা যায় প্রেসিডেন্টের দাদীর বংশের তৃতীয় পুরুষ আলী মাহমুদ পাইকার রেশমের পাইকারী ব্যবসা করে প্রচুর খ্যাতি অর্জন করেছিরেন এবং পরবর্তীতে পাইকার উপাধিতে ভূষিত হন।

যুগের পরিবর্তনের সাথে সাথে মানুষের উৎপাদন ও উৎপাদনের উপায় উপকরণে পরিবর্তন লক্ষণীয়। তেমনি কর্মময় জীবনের পাশাপাশি বংশ গতির পরিচয়ে ও উপাধির পরিবর্তন দেখা যায়। প্রেসিডেন্ট শহীদ জিয়াউর রহমানের মাতৃ বংশের পূর্ব পুরুষ গণের সামাজিক উপাধি পরিবর্তনে ও সেই ধারাটি প্রতীয়মান হয়। “মÐল” থেকে “প্রমাণিক” তৎ থেকে “তালুকদার” তা থেকে পাইকার আবার তৎ থেকে “তালুকদার”। মানুষের জীবন ও জীবিকার সাথে সব কিছু যেন একই সুতোয় গাঁথা।

তালুকদার তথা “তালুক” শব্দের অর্থ দ্বারায় ভূ-সম্পত্তির মালিক বা ভূ-সম্পত্তির অধিকারী মুসলিম যুগে ও ব্রিটিশ যুগের প্রথম দিকের প্রচলিত ব্যবস্থা অনুযায়ী তালুকের মালিকগণ সরকার বা সরাসরি নিজেরা জমিদারগণের নিকট হইতে ভূ-সম্পত্তি বন্দোবস্ত করে তালুকের মালিক হতেন এবং বংশানুক্রমে তারা সেই তালুক ভোগ করতেন। তারা জমিদারগণের মতই সরকারি রাজস্ব প্রদান এবং সরকারি দ্বায়িত্ব পালন করে তালুক ভোগ করতেন এবং খাজনা আদায় করতেন।

আলোচ্য বংশগতিক পরিচয়ে উল্লিখিত আলী মাহমুদের পুত্রগণ হয়ত রেশমের পাইকারি ব্যবসা ও নীল চাষে ভালো অর্থ আয় করে প্রচুর ধন সম্পদের মালিক হয়েছিলেন। বিশেষ করে তৃতীয় ও চতুর্থ পুত্র কলিম মাহমুদ এবং করিম বক্স ব্যবসয়িক লব্ধ অর্থ দিয়ে দিঘাপাতিয়া জমিদারদের নিকট থেকে তালুক ক্রয় করে তালুকের মালিক হয়ে বংশগত উপাধি পরিবর্তন করে নিজেদের উপাধি “তালুকদার” রাখেন। সেই সময় ঐ অঞ্চলের জালুশুকা গ্রাম থেকে যমুনা নদী পর্যন্ত তাদের তালুক বিস্তৃত ছিল। ঐ বাড়ির বাহারুদ্দিন তালুকদার থেকে জানা যায় প্রথম মহাযুদ্ধের সময় কলীম মাহমুদ তালুকদার ৫,০০০/- টাকার ওয়ার বন্ড খরিদ করেন। এমনিভাবেই প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের দাদির পৈত্রিক বংশের পারিবারিক উপাধিগুলো পরিবর্তিত হয়ে কখনো মÐল, প্রমাণিক, পাইকার, তালুকদার উপাদিতে পরিবর্তন হয় এবং ঐ বাড়ির আরো একটি বংশ একই রক্ত। তারাও কখনো সরকার কখনো তরফদার এইভাবে পরিবর্তীত হয়। বিশেষভাবে উল্লেখ “তরফ” নামক প্রশাসনিক ইউনিটের রাজস্ব সংগ্রহ কর্তা বা অধিকারী তাদেরকে “তরফদার” বলা হত। আর এই “তরফ” ছিল পরগণা বা মহলের অংশ বিশেষ। প্রেসিডেন্ট শহীদ জিয়াউর রহমানের পূর্ব পুরুষের বাগানবাড়িস্থ বাড়ির মালিক এম আর তরফদার সাবেক প্রেসিডেন্ট শহীদ জিয়াউর রহমানের দ্বিতীয় চাচা জহিরুদ্দিনের কন্যা জহুরার স্বামী। সাবেক সংসদ সদস্য ওয়াজেদ হোসেন তরফদার ঐ বংশেরই সন্তান।

আলোচ্য লেখায় এটাই প্রমাণিত হয় মা-থেকে মাতৃভূমির পরিচয় থেকে কিভাবে একজন মানুষের মানসিক সংস্কৃতি গড়ে উঠে এবং সেই একটি মানুষ থেকেই আসে তার রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রকাশ অর্থাৎ মা থেকে মাতৃভূমি ও এই মাতৃভূমির টানে প্রেসিডেন্ট শহীদ জিয়াউর রহমান এক অনন্য অসাধারণ ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন জাতীয়তাবাদী নেতা যা তার কর্মের মধ্যে দিয়েই প্রমাণ করেছেন।

প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের পিতার বংশগত পরিচয়

শহীদ প্রেসিডেন্ট প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের দাদা মৌলভী কামাল উদ্দিন মÐল সিপাহি বিপ্লবের ৪/৫ বছর পূর্বে জন্ম গ্রহণ করেন। দুই বছর বয়সের সময় তার পিতা মারা যান এবং তিনি তার চাচাত ভাইয়ের কাছে অতি আদর যতেœ বড় হন। এই ভাইয়ের পরিচর্যাই তিনি রংপুর নরর্মান স্কুল থেকে ভারনাকুলার (সংস্কৃতি) পÐিতি পাস করেন। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে তিনি আলা মাহমুদ পাইকারের চতুর্থ পুত্র করিম বক্স তালুকদারের একমাত্র কন্যা মেহেরুন্নেসাকে বিবাহ করেন। তার মৃত্যুর দিন তারিখ সঠিকভাবে পাওয়া যায় নি। তিনি সাত পুত্র ধন মামৃদ, জহীরুদ্দিন, মাজহাবুদ্দিন, মুয়াজ্জাম হোসেন, মনজুর রহমান, এম, মুমতাজুর রহমান, মাহফুজুর রহমান ও দুই কন্যা ফাতিমা খাতুন ও রহীমা খাতুনকে রেখে ইহজগত ত্যাগ করেন। সাবেক প্রেসিডেন্ট শহীদ জিয়াউর রহমানের বড় চাচা ধন মাহমুদ চামড়ার ব্যবসার করতেন এবং চামড়া প্রসেস করে কলিকাতায় পাঠাতেন। দ্বিতীয় চাচা জহিরুদ্দিন গ্রামের বাড়িতে জমি জমা দেখাশুনা করতেন। তৃতীয় চাচা মাজহাবুদ্দিন রংপুর নরমার্ন স্কুল পাস করা ভারনাকুলার পÐিত ছিলেন। চতুর্থ চাচা মোয়াজ্জেম হোসেন বি ই এম আই (ইন্ডিয়া) শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে জন স্বাস্থ্য প্রকৌশলী বিভাগে চাকরি করতেন এবং সেখানে তিনি নির্বাহী প্রকৌশলীর দায়িত্ব ছিলেন। তার চাচা মেজর এম মমতাজুর রহমান এমবিবিএস পাস করে তৎকালে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর মেডিকেল অফিসার হিসাবে একজন ভালো ডাক্তারের সুনাম ও খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। পরবর্তীতে তিনি পাকিস্তানের ম্যালেরিয়া নিবারণ প্রকল্পের পরিচালকের দ্বায়িত্বরত অবস্থায় অবসর গ্রহণ করেন। ৬ষ্ঠ চাচা মাহফুজুর রহমান বিএসসি ও এলএলবিপাস করে রেজিস্ট্র্রার চার্টার্ড একাউন্ট এবং একজন ইনকাম ট্যাক্স প্রাকটিশনার হিসাবে কর্মময় জীবন পরিচালনা করেন। ফুফু ফাতেমা খাতুন একজন সদালিপি সু-গৃহিণী ছিলেন এবং তার স্বামী কুচবিহার মহারাজার অধীনে এসডিও পদে অধিষ্টিত ছিলেন। ছোট ফুফু রহিমা খাতুনের স্বামী ছিলেন মো. শামসুদ্দি দরোগা তার সাহসিকতার বিশ্লেষণে ব্যাপক গুঞ্জন ছিল। তিনি নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ থানার দারোগা থাকাকালীন বীরত্ব ও সাহসিকতার সাথে বাঘ মারতে গিয়ে বাঘের থাবায় নিহত হন।

প্রেসিডেন্ট শহীদ জিয়াউর রহমান পিতার পাঁচ সন্তানের মধ্যে দ্বিতীয়, পিতা মনসুর রহমান (মৃত ১৯৬৬) বিএসসি পাস করে কলকাতা টেস্টিং ল্যাবরটরিজের একজন রসায়নবিদ ছিলেন। বড় ভাই রেজাউর রহমান ম্যারিন ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে চাকরিতে অবসর গ্রহণ করেন। তার নিকটতম ছোট ভাই মিজানুর রহমান এমএ ইকোনমিক্স, তিনি লন্ডনে বিসিসিইতে নিয়োজিত থাকাবস্থায় ১৯৯৮ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তৃতীয় ভাই এম খলিলুর রহমান ফার্মেসিতে এমএসসি পাস করে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করতেন। তার সবচাইতে ছোট ভাই আহমেদ কামাল বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের নির্বাহী কর্মকর্তা হিসাবে চাকরিতে অবসরে যান। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের পিতা মনসুর রহমান ভারত পাকিস্তান বিভক্তির পরে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের অধীন ক্যামিক্যাল করর্পোরেশানের সেন্ট্রাল ডেপুটি ডাইরেক্টরের দ্বায়িত্বে নিয়োজিত হন। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের পিতা মনসুর রহমান ছিলেন পিতার সাত ছেলের মধ্যে পঞ্চম। জাহানারা খাতুন রানী প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মা। মাতামহী রহীমা খাতুনের দ্বিতীয় কন্যা। তিনি অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত পরিবারের একজন আদর্শ গৃহিণীই ছিলেন না বরং তিনি ছিলেন সেই কালের একজন প্রতিভাবান সংগীতশিল্পী। করাচির বেতার কেন্দ্রের একজন নিয়মিত গায়িকা। নজরুল সংগীত ছিল তার একমাত্র সাধনা। তিনি নিজের প্রচেষ্টায় তদানিন্তন পশ্চিম পাকিস্তানের বেতার কেন্দ্রে প্রথম বাংলা অনুষ্ঠান চালু করেন। অতি অল্প সময়ে মাত্র ৩৮ বছর বয়সে ১৯৫৫ সালের ২৮ ডিসেম্বর তিনি পরলোক গমন করেন। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ছোটবেলা থেকে পিতা-মাতার সাথে দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়ান এবং সেভাবেই তার নিজের জীবন গড়ে উঠে। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে তার পিতা বিএসসি পাস করে একজন কেমিস্ট হিসাবে কলিকাতা টেস্টিং ল্যবোরেটিরিজে চাকরিতে যোগ দেন। ১৯৪৭ সালে ১৪ আগস্ট দেশ বিভাগের পর তিনি তদানিন্তন পশ্চিম পাকিস্তানে চাকরির কর্মস্থলে যোগদান করেন। সেখানেই প্রেসিডেন্ট শহীদ জিয়াউর রহমান হাইস্কুলে ভর্তি হন। তার পূর্বে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি দুই বছর বগুড়ার নিজস্ব গ্রামের স্কুলে লেখাপাড়া করেন। প্রকৃত লেখাপাড়া বা তার স্কুলজীবন শুরু হয় কলিকাতায় হেয়ার স্কুল থেকে। ১৯৫২ সালে করাচি একাডেমি স্কুল থেকে মেট্রিক পাস করে কারাচি ডি জে কলেজে ভর্তি হন এবং তিনি করাচির সাময়িক একাডেমিতে অফিসার ক্যাডেটরূপে সামরিক বাহিনীতে যোগ দেন এবং কর্মরত অবস্থায় মিলেটারি একাডেমি থেকেই গ্রাজুয়েশন ডিগ্রি লাভ করেন। ছোটবেলা থেকেই শহীদ জিয়াউর রহমান ছিলেন অত্যন্ত তীক্ষè দৃষ্টি সম্পন্ন ও দূরদর্শী চিন্তার এক ভাবগম্ভীর প্রকৃতির বিরল ব্যক্তিত্ব। যা তার কর্মময় জীবনের বিভিন্ন দিক বিশ্লেষণ থেকেই বুঝা যায়। সাবেক প্রেসিডেন্ট শহীদ জিয়াউর রহমান তার নিজের লেখায় একটি প্রসঙ্গে উল্লেখ করেন পাকিস্তানিদের আচার আচরণ তার কাছে ছোটবেলা থেকেই ভালো লাগতো না। এ মানুষিক ব্যক্তিত্বই কলেজ জীবনে ১৯৫২ সালে তদানিন্তন পাকিস্তান সামরিক বাহিনীতে যোগদানে উৎসাহিত হন। তার ছোটবেলার ইচ্ছা ছিল একজন ভালো ডাক্তার হওয়া তার সেই আশা পূরণ হয়নি। প্রেসিডেন্ট শহীদ জিয়াউর রহমান ১৯৫৩ সালে সামরিক একাডেমি থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ শেষে দক্ষতা ও কর্মদীপ্ত চেতনার পুরস্কারস্বরূপ ১৯৫৫ সালে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীতে সেকেন্ড লেপটেনেন্ট পদে কমিশন প্রাপ্ত হন এবং তিনি কমান্ডো ট্রেনিং লাভ করেন। সেই থেকেই বাংলাদেশকে একটি স্বাতন্ত্রিক দেশ হিসাবে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেন এবং এ দেশকে একটি স্বাতন্ত্রিক দেশ হিসাবে পাওয়ার পরিকল্পনা করতেন। ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় জাতিকে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করা এবং সেই যুদ্ধে নিজে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করা ছিল তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। প্রেসিডেন্ট শহীদ জিয়াউর রহমান তার চাকুরি জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন সময় পাকিস্তানিদের আচার-আচরণ মনোভাব তাকে বিষণœ করে তুলেছিল। তিনি পাকিস্তানিদের চিন্তা চেতনায় সব সময়ে সাবেক পুর্ব পাকিস্তান তথা আজকের বাংলাদেশিদের শোষণ শাসনে প্রতিচ্ছবি দেখতে পেতেন। এবং সব সময় পাকিস্তানিদের শোষনের কৌশল অবলোকন করতেন। প্রেসিডেন্ট শহীদ জিয়াউর রহমান চাকরি জীবনে সামরিক একাডেমির প্রশিক্ষণরত অবস্থায় প্রশিক্ষকদের মনোভাবও বুঝতে পেরেছিলেন। পাকিস্তানি সামরিক একাডেমির প্রশিক্ষকগণ কখনই বাংলা ভাষাভাষি অফিসারদের ভালো চোখে দেখতেন না। তারা বাঙালিদের ঘৃণা করতেন। তারা বাংলা ভাষার প্রতি বিতশ্রদ্ধ ছিল। যা তাদের মনোভাবে সকল সময়ই প্রকাশ পেত। পাকিস্তানিরা প্রথম থেকেই পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের সংবিধানে বাংলাভাষা কে রাষ্ট্রা ভাষার স্বীকৃতি দেওয়াটা কিছুতেই মেনে নিতে পারেন নি। তারা বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা প্রদান বা এ আইন পাস করা থেকে বিরত থাকেন। তারা শুধু উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসাবে সংবিধানে প্রতিস্থাপন করে পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের তাথা আজকের বাংলাদেশের জনগণের মাতৃভাষা বাংলাভাষাকে অস্বীকার করলে তৎ সময় সাবেক পূর্ব পাকিস্তান বা আজকের বাংলাদেশের জনগণ গর্জে উঠে। এবং ’৫২-এর ভাষা আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে রফিক, সালাম, জব্বর ও বরকত মৃত্যুবরণ করলে আন্দোলন আরো বেগবান হয়। তাতে পাকিস্তানিরা বাংলাভাষা সংবিধানে স্বীকৃতি দেয়। স্কুলছাত্র জীবনেই জিয়াউর রহমান পাকিস্তানিদের এই মনোভাব মেনে নিতে পারেন নি। তাই ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে এদেশের আপামোর জনগণকে ঐক্য বদ্ধ হওয়ার আহŸান জানিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। প্রেসিডেন্ট শহীদ জিয়াউর রহমান তার কর্মময় জীবনে উচ্চতর বিভিন্ন সামরিক প্রশিক্ষণ লাভ করে সামরিক বাহিনীতে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তিনি কর্মময় জীবনে মনে প্রাণে পাকিস্তানিদের ওপর আঘাত হানারও পরিকল্পনা করতেন। ১৯৬০ সালের আগস্ট মাসে তিনি বর্তমান বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। শহীদ জিয়া ১৯৬৩ সালে সামরিক গোয়েন্দা বিভাগ (ডিজি এফআই) এ কাজ করেন দক্ষতার সাথে। প্রেসিডেন্ট জিয়া তার লেখার এক জায়গায় উল্লেখ করেন “সামরিক গোয়েন্দা বিভাগের তদানিন্তন পরিচালক মেজর জেনারেল নওয়াজেশ আলী মালিক এক সময় আমার এলাকা পরিদর্শন করেন। তখন সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল একদিন। তখন তিনি পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক অবস্থা কিছুটা উন্নতর করবার সরকারি সিদ্ধান্ত সম্পর্কে দ্বিমত পোষণ করেছিলেন। তিনি এক পর্যায় আমার অভিমত জানতে চাইলে আমি বললাম এ অঞ্চলের অর্থনীতিতে যদি ব্যাপক অগ্রগতি সাধন করা না হয়, তাহলে দেশের প্রশাসন ব্যবস্থা চালু রাখা কঠিন হয়ে যাবে। এর জবাবে তিনি বললেন, এ অঞ্চল যদি উন্নত হয় তাহলে সে আলাদা হয়ে যাবে। পাকিস্তানের শীর্ষ স্থানীয় সরকারি উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের এই ছিল মনোভাব। এর অর্থ দাঁড়ায় বাংলাদেশকে অর্থনৈতিকভাবে দেউলিয়া করে রাখা ছিল তাদের দুরভিসন্ধি।

প্রেসিডেন্ট শহীদ জিয়াউর রহমান ১৯৬৫ সালে ভারত পাকিস্তান যুদ্ধে তদানিন্তন পশ্চিম পাকিস্তানের ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি ব্যাটেলিয়নের আলফা কম্পানি কমান্ডার হিসাবে দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। এই যুদ্ধে জিয়া সরাসরি “খেমকারান” রণাঙ্গনের বেদিয়ানে যুদ্ধরত থেকে বাঙালিদের সুনাম ছিনিয়ে এনেছিলেন এবং বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে ঐ যুদ্ধ বিজয়ী হয়েছিলেন। উল্লেখ্য, এটাই ছিল পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর একমাত্র কোম্পানি যার কমান্ডিং অফিসার থেকে একজন সুইপার পর্যন্ত ছিল বাঙালি। আজ ঐ কোম্পানিই বাংলাদেশের সেনাবাহিনী। খেমকারানের যুদ্ধে তিনি তার আলফা কোম্পানির জোয়ানদের নিয়ে ভারতের সপ্তদশ রাজপুত, ঊনবিংশ মারাঠা, লাইট ইনফ্যান্টরি, ষোড়শ পাঞ্জাবও সপ্তম লাইট ক্যাভাল বীর (সাজুয়া বহর) বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধে লড়ে পশ্চিম পাকিস্তানিরা পালায়নপর সৈন্যদের পেছনে ফেলে বীরদর্পে যুদ্ধ করে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর মধ্যে আমাদের জন্য সুনাম ও পুরস্কারস্বরূপ দ্বিতীয় সার্বিক বীরত্ব পদক নিয়ে এসেছিলেন। যা সেদিন দেশ-বিদেশের সকল পত্র পত্রিকার পাতায় লেখা হয়েছিল। ১৯৬৬ সালে সাবেক প্রেসিডেন্ট শহীদ জিয়াউর রহমান তদনিন্তন পাকিস্তান সামরিক একাডেমিতে প্রশিক্ষকের পদে যোগ দেন এবং দক্ষতা ও সুনামের সহিত দায়িত্ব পালন করেন। পাকিস্তানিরা ভাবতো বাঙালিরা ভালো সৈনিক নয়। খেমকারানের যুদ্ধে তাদের এই বদ্ধমূল ধারণা ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। পাকিস্তানি বাহিনীর সবার কাছে বাঙালিরা সবার কাছে তখন ঈর্ষার পাত্র বনে গিয়েছিল। সে যুদ্ধে এমন একটা ঘটনাও ঘটেনি যেখানে বাঙালি জওয়ানরা প্রানের ভয়ে পালিয়ে গেছে। ভারতের সঙ্গে সেই সংঘর্ষে বহু ক্ষেত্রে পাকিস্তানিরাই বরং লেজ গুটিয়ে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে বেঁচে ছিল। সে সময় পশ্চিম পাকিস্তানিদের সমন্বয়ে গঠিত পাকবাহিনীর এক প্রথম শ্রেণির সাঁজোয়া ডিভিশন নি¤œমানের ট্যাঙ্কের অধিকারী ভারতীয়দের হাতে নাস্তানাবুদ হয়ে পড়ে। এমনকি পাকিস্তানিরা তাতে বিচলিতও হয়ে পড়েছিল। বাঙালি সৈনিকদের দক্ষতা রননীতি রনকৌশল উপলদ্ধি করে পাকিস্তানিদের হৃদকম্পন জেগেছিল। এই যুদ্ধে পাকিস্তান বিমান বাহিনীর বাঙালি পাইলটরাও অর্জন করেছিল প্রচুর সুনাম। এসব কিছুই সেদিন চোখ খুলে দিয়েছিল বাঙালি জনগণের। তারাও আস্থাশীল হয়ে উঠেছিল তাদের বাঙালি সৈনিকদের বীরত্বের প্রতি। বাঙালি সৈনিকরা বীরত্ব ও দক্ষতার জন্য প্রশংশিত হয়েছিল। তখন বিশ্বের বিভিন্ন সংবাদপত্রে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের নাম উল্লেখ করা হয়েছিল। অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের নাম আজ বাংলাদেশেরও এক পরম প্রিয় সম্পদ খেমকানের যুদ্ধে ভারতীয় বাহিনী পর্যুদস্ত হওয়ার পরিণতিতে পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বাহিনী বাঙালিদের বিরুদ্ধে গ্রহণ করলো এক গোপন পরিকল্পনা। এই পরিকল্পনা অনুযায়ী তারা ঠিক করলো প্রতিরক্ষা বাহিনীতে বাঙালিদের আনুপাতিক হার কমাতে হবে। তারা তাদের এই গোপন পরিকল্পনা পুরোপুরিভাবে কার্যকরী করলো। কিন্তু এই গোপন তথ্য মেজর জিয়ার কাছে গোপন ছিল না। ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ আত্মবিশ্বাস জাগিয়েছিল তার ও বাঙালি সৈনিকদের মনে। বিমান বাহিনীর বাঙালি জওয়ানদের মনে আত্মবিশ্বাস সুদৃঢ় হয়েছিল। তখন মেজর জিয়া বুঝেছিল, বিশ্বের যেকোনো বাহিনীর সাথে তারা মোকাবিলায় সক্ষম। জানুয়ারি মাসে জিয়াউর রহমান নিযুক্ত হয়েছিল পাকিস্তান সামরিক একাডেমিতে প্রশিক্ষকের পদে। যুদ্ধক্ষেত্রে সৈনিকদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তিনি একদিন শিক্ষক হয়েছিলেন কিন্তু তার মনে ছিল তার যুদ্ধের স্মৃতি। সামরিক একাডেমিতে শুরু হলো তার শিক্ষক জীবন। পাকিস্তানিদের তিনি সমর বিদ্যায় পারদর্শী করে তোলার কাজে আত্মনিয়োগ করেছিলেন আর সেই বর্বররা এই বিদ্যাকে কাজে লাগিয়ে আমাদের দেশের নিরস্ত্র জনতার বিরুদ্ধে এক পাশবিক নির্যাতন ও বাঙালি নিরস্ত্র জনগণের ওপর যুদ্ধ ঘোষণা করে ছিল। সামরিক একাডেমিতে থাকাকালেও তিনি সম্মুখীন হয়েছিলেন নানাবিধ সমস্যায়। সেখানে তিনি দেখতে পান বাঙালি ক্যাডেটদের প্রতি পাকিস্তানিদের মনোভাব ও তাদের হিংসার প্রতিচ্ছবি। পাকিস্তানিদের মনোভাব ও আচরণ এমনছিল যে তারা বাঙালি ক্যাডেটদের সকল সময় কোণঠাসা করে রাখতো। তিনি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে যখন ছাত্র ছিলেন তখন যেমন দেখেছিলেন ঠিক তিনি যখন শিক্ষক হলেন তখনো তিনি পাকিস্তানিদের আচরণ তেমনি দেখতে পান, তখনো বাঙালি ক্যাডেটদের ভাগ্যে জুটতো শুধু অবহেলা, অবজ্ঞা আর ঘৃণা। আন্তঃসার্ভিস নির্বাচনী বোর্ডে গ্রহণ করা হতো নি¤œমানের কোর্সে বাঙালি ছেলেদের। ভালো ছেলেদেরও নেওয়া হতো না ক্যাডেটরূপে। রাজনৈতিক মতাদর্শ আর দরিদ্র পরিবারের নামে প্রত্যাখ্যান করা হতো তাদের। এসবকিছুই তাকে ব্যাথিত করতো। এই সামরিক একাডেমিতেই পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে তার মন বিদ্রোহী হয়ে উঠে। সামরিক একাডেমির গ্রন্থাগারে সংগৃহীত ছিল সব বিষয়ের ভালো ভালো বই। জিয়া জ্ঞানার্জনের জন্য এই সুযোগ গ্রহণ করলেন। তিনি ব্যাপক পড়াশুনা করলেন।

১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহ সম্পর্কে ব্রিটিশ ঐতিহাসিকগণ আন্দোলনকে আখ্যায়িত করেছিল বিদ্রোহ হিসাবে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সেই আন্দোলন ছিল ভারত বিভক্তির যা বিদ্রোহ ছিল না। প্রকৃতপক্ষে সেটাও ছিল মুক্তিযুদ্ধ। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর তথাকথিত সামরিক বুদ্ধিজীবীদের পরিকল্পনা ছিল আরো কয়েক দশক কোটি কোটি জাগ্রত বাঙালিকে দাবিয়ে রাখা। স্বাধীনতার পূর্বে তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা ছিল-এর জ্বলন্ত প্রমাণ। স্বাধীনতার জন্য আমাদের সশস্ত্র সংগ্রামের দিকে অগ্রগামী হতে এটাও ছিল একটা সুস্পষ্ট অঙ্গুলী সংকেত। এই মামলার পরিণতি এক করে দিয়েছিল আমাদের বাঙালি সৈনিক, নাবিক ও বৈমানিকদের। বাংলাদেশের জনগণের দাবির সাথে একাত্মতা হয়ে গিয়েছিল তারা। তাদের ওপর পাকিস্তানের চাপিয়ে দেওয়া সব বিধি-নিষেধ ঝেড়ে ফেলা দিয়েছিল এবং এক কণ্ঠে একাত্ম হয়েছিল। তারা মাতৃভূমির স্বাধীনতার দাবিতে ইসলামাবাদ কেন্দ্রিক যুদ্ধবাজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল এবং অস্ত্র তুলে নেওয়ার মধ্যেই যে আমাদের দেশের তথা বাংলাদেশের কল্যাণ নিহীত তাতে আর কোনো সন্দেহই ছিল না তাদের মনে। এটাও আমাদের সশস্ত্র সংগ্রামের আরেক দিক দর্শন। সেই সময় থেকেই এ ব্যাপারে মেজর জিয়াউর রহমান মোটামুটিভাবে খোলাখুলি আলোচনা শুরু করতে থাকেন তার সহকারীদের সাথে। ১৯৬৯ সালের এপ্রিল মাসে মেজর জিয়াকে নিয়োগ করা হয়েছিল জয়দেবপুর ক্যান্টোরমেন্টের ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের দ্বিতীয় ব্যাটেলিয়নে। তিনি সেখানে সেকেন্ড-ইন কমান্ডের দ্বায়িত্বপ্রাপ্ত হন। প্রেসিডেন্ট শহীদ জিয়াউর রহমান সেই সমকালীন সময়ের অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে তার লেখায় এক প্রবন্ধে উল্লেখ করেন ‘কমান্ডিং অফিসার লে. কর্র্নেল বদরুল কাইয়ুম ছিল এক পাকিস্তানি। একদিন ময়মনসিংহের এক ভোজসভায় ধমকের সুরে সে ঘোষণা করেছিল এ অঞ্চলের জনগণ যদি সদাচরণ না করে তাহলে সামরিক আইনের সত্যিকার ও নির্মম পরিণতি এখানে ঘটানো হবে। আর তাতে প্রচুর রক্তপাত ঘটবে। এই ভোজসভায় কয়েকজন বেসামরিক ভদ্রলোকও উপস্থিত ছিলেন। ময়মনসিংহের তদানিন্তন ডেপুটি কমিশনার জনাব মোকাম্মেল। লেফটেন্যান্ট কর্নেল কাউয়ুমের এই দম্ভোক্তি মেজর জিয়াকে বিস্মিত করেছিল’ মেজর জিয়া আরো উল্লেখ করেন ‘এর আগে কাউয়ুম এক গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত ছিল ইসলামাবাদে। পাকিস্তানি নীতি নির্ধারকদের সাথে সংযোগ ছিল তার। তার মুখে পুরনো প্রভুদের মনের কথাই তার ভাষায় প্রকাশ পেয়েছিল। তাই আমি ভাবছিলাম কি করা যায়। পরবর্তী সময়ে এ ব্যাপারে আমি তাকে অনেকগুলো প্রশ্ন করি এবং এর কথা থেকে আমার কাছে একটা বিষয় স্পষ্ট হয়ে উঠে যে সে যা বলেছে তা জেনে শুনেই বলেছে। উপযুক্ত সময়ে তাদের মনোভাব কার্যকরী করার জন্য সামরিক ব্যবস্থার এক পরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছে। আর কাউয়ুম সে সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। আমি এতে আতংকগ্রস্থ হয়ে পড়ি। এই সময়ে আমি একদিন চতুর্দশ ডিভিশনের সদর দপ্তরে যাই। জিএসও-১ (গোয়েন্দা) লে. কর্নেল তাজ আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের কয়েকজন সম্পর্কে আমার কাছে অনেক কিছু জানতে চায়। আমি তার এসব তথ্য সংগ্রহের উদ্দেশ্য কি জিজ্ঞাসা করি সে আমাকে জানায় যে, তারা বাঙালি নেতাদের জীবনী সংক্রান্ত তথ্যাদি সংগ্রহ করছে। আমি বরারব তাকে জিজ্ঞাসা করি। এসব খুঁটিনাটির প্রয়োজন কী? এই প্রশ্নের জবাবে সে আমাকে জানায় ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক গতিধারায় এগুলো কাজে লাগাবে। গতি যে বেশি সুবিধার নয় তার সাথে আলোচনা করে আমি তা বুঝতে পারি। সেই বছরেই সেপ্টেম্বর মাসে চার মাসের জন্য আমি পশ্চিম জার্মানি যাই। ঐ সময়ে পূর্ব-পাকিস্তানের সর্বত্র এক রাজনৈতিক বিক্ষোভের ঝড় বয়ে যায়”।

১৯৭০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মেজর জিয়াকে নিয়োগ করা হয় চট্টগ্রামে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অষ্টম ব্যাটেলিয়নের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড হিসেবে। এর কয়েক দিনের মধ্যেই মেজর জিয়াকে আবার ঢাকা যেতে হয় অফিসিয়াল কাজে। নির্বাচনের সময়টায় তিনি ছিলেন ক্যান্টনমেন্টে তখন সেখানে অবস্থানকালে পাকিস্তান সামরিক জনতাদের মনোভাব উপলব্ধি করেন। তিনি এটা বুঝতে পারেন যে, নির্বাচনের প্রথম থেকে নির্বাচনের দিন পর্যন্ত পাকিস্তানি অফিসাররা মনে করতো নির্বাচনের চূড়ান্ত বিজয় তাদেরই হবে। কিন্তু নির্বাচনের দ্বিতীয় দিনেই তাদের মুখে হতাশার সুস্পষ্ট ছাপ দেখা দেয়। ঢাকায় অবস্থানকারী পাকিস্তানি সিনিয়র অফিসারদের মুখে তিনি দেখেন আতংকের ছবি। তাদের এই আতংকের কারণ ও জিয়ার কাছে অজানা ছিল না। জনগণ শিগগিরই গণতন্ত্র ফিরে পাবে- এই আশায় বাঙালি অফিসাররা তখন আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠেছিল। চট্টগ্রামে ফিরে মেজর জিয়া ব্যস্ত ছিলেন অষ্টম ব্যাটেলিয়নকে গড়ে তোলার কাজে। এটা ছিল রেজিমেন্টের তরুণতম ব্যাটেলিয়ান। এটার ঘাঁটি ছিল ষোলশহর বাজারে। ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে এই ব্যাটেলিয়নকে পাকিস্তানের খারিয়ানে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। এর জন্য মেজর জিয়াকে সেখানে পাঠাতে হয়েছিল দুইশত জওয়ানের এক দ্রæতগামী দল। তাদের হাতে তিনশত পুরানো ০০৩-রাইফেল, চারটা এলএমজি ও দুটি তিন ইঞ্চি মর্টার গোলাবারুদের পরিমাণও ছিল নগণ্য। তাদের হাতে এন্টিট্যাংক বা ভারী মেশিনগান ছিল না। ফেব্রæয়ারির শেষদিক সাবেক পূর্বপাকিস্তানে যখন রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিস্ফোরণমুখর হয়ে উঠেছিল তখন মেজর জিয়া একদিন খবর পেলেন তৃতীয় কমান্ড ব্যাটালিয়ানের সৈনিকরা চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন এলাকায় ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে বিহারিদের বাড়িতে বাস করতে শুরু করেছে। খবর নিয়ে তিনি আরো জনতে পারেন কমান্ডোরা বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র আর গোলাবারুদ নিয়ে বিহারি বাড়িগুলোতে জমা করেছে এবং রাতের অন্ধকারে বিপুল সংখ্যায় তরুণ বিহারিদের সামরিক ট্রেনিং দিচ্ছে। এসব কিছু থেকে মেজর জিয়া বুঝে নিয়েছিলেন দেশে ভয়ানক কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে তার সুস্পষ্ট একটা আভাস তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। তার পর এলো ১লা মার্চ এই সময়ে মেজর জিয়ার ব্যাটেলিয়নে এনসিওরা তাকে জানিয়েছিল প্রতিদিন সন্ধায় বিংশততম বালুচ রেজিমেন্টের জওয়ানরা বেসামরিক পোশাক পরে বেসামরিক ট্রাকে করে কোথায় যেন যায়। মেজর জিয়া বাঙালি জোয়ানদের বলেন খবর নিয়ে প্রতি রাতেই যেন তারা তাকে সংবাদগুলো জানায় এবং তারা যেন কতগুলো নির্দিষ্ট বাঙালিপাড়ায় যায়। সংবাদদাতারা দেখতে পায় সাদা পোশাকে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর সৈন্যরা বিহারিদের সাথে মিশে গিয়ে নির্বিচারে হত্যা করে বাঙালিদের। তখন প্রতিদিনই ছুরিকাহত বাঙালিকে হাসপাতালে ভর্তি হতে শোনা যেত। সেই সময়ে কমান্ডিং অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেল জানজুয়া জিয়াউর রহমানের গতিবিধির ওপর লক্ষ্য রাখার জন্য লোক লাগায়। মাঝে মাঝেই তার লোকেরা যেয়ে জিয়াউর রহমানের সম্পর্কে খোঁজ খবর নিতে শরু করেন। বাঙালি অফিসাররা তখন আশংকা করছিল তাদের হয়ত নিরস্ত্র করা হবে। জিয়া তখন তার মনোভাব দমিয়ে কাজ করে যাইতে লাগলেন এবং নিরবে পাকিস্তানি জওয়ানদে উদ্যোগ ব্যর্থ করে দিতে পারে সম্ভাব্য সব ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। বাঙালি হত্যা ও বাঙালি দোকানপাটে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ক্রমেই বৃদ্ধি পেতে থাকে। এমন অবস্থায় জিয়া ভাবতে লাগলেন পাকিস্তানীরা বাঙালিদের নিরস্ত্র করার চেষ্টা করলে তিনি কি ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। মেজর (পরে কর্নেল) শওকত জিয়ার কাছে বলেন তাদের সাথে ক্যাপ্টেন সমসের মবিন এবং মেজর খালেকুজ্জামান স্বাধীনতার জন্য যদি অস্ত্র তুলে নেয় তাহলে তারাও দেশের মুক্তি জন্য প্রাণ দিতে কুণ্ঠাবোধ করবেন না। তখন ক্যাপ্টেন অলি আহমদ মাঝে মাঝে জিয়াকে খবর আদান প্রদান করতেন। জেসিও এবং এসিওরাও দলে দলে বিভক্ত হয়ে জিয়ার কাছে বিভিন্ন স্থানে আসতে থাকে। তারাও তাকে খবর জানায় যে, কিছু একটা না করলে বাঙালি জাতি চিরদিনের জন্য দাসে পরিণত হবে। জিয়া নীরবে তাদের কথা শুনতেন। কিন্তু তিনি ঠিক করেছিলেন উপযুক্ত সময় এলেই তিনি মুখ খুলবেন। সম্ভবত ৪ মার্চে তিনি ক্যাপ্টেন অলি আহমদকে ডেকে নেন। মেজর জিয়ার ছিল সেটা প্রথম বৈঠক। তিনি তাকে সোজাসুজি বললেন, সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করার সময় দ্রæত এগিয়ে আসছে। তাদের সব সময় সতর্ক থাকতে হবে। ক্যাপ্টেন অলি আহমদও তার সাথে একমত হন। তারা পরিকল্পনা তৈরি করেন এবং প্রতিদিনই আলোচনা বৈঠকে মিলিত হতে শুরু করেন। ১৭ মার্চ ১৯৭১ চট্টগাম স্টেডিয়ামে লেফটেন্যান্ট কর্নেল এম আর চৌধুরী, জিয়া, ক্যাপ্টেন অলি আহমদ ও মেজর আমিন চৌধুরী এক গোপন বৈঠকে মিলিত হন এবং এক চূড়ান্ত যুক্ত পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। লে. কর্নেল চৌধুরীকে অনুরোধ করেন নেতৃত্ব দিতে। দু’দিন পর ইপিআর-এর ক্যাপ্টেন (এখন মেজর) রফিক জিয়ার বাসায় গেলেন এবং ইপিআর বাহিনীকে সঙ্গে নেয়ার প্রস্তাব দেন। তারা ইপিআর বাহিনীকে তাদের পরিকল্পনাভুক্ত করেন। এরই মধ্যে পাকিস্তানিরা সামরিক তৎপরতা শুরু করার চূড়ান্ত প্রস্তুতি গ্রহণ করে। ২১ মার্চ জেনারেল আব্দুল হামিদ খান যান চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে। চট্টগ্রামে সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণের চূড়ান্ত পরিকল্পনা প্রণয়নই ছিল তার এই সফরের উদ্দেশ্য। সেদিন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট সেন্টারের ভোজসভায় জেনারেল হামিদ ২০তম বালুচ রেজিমেন্টের কমাডিং অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফাতমিকে বললেন, ফাতমি সংক্ষেপে বলেন ক্ষিপ্রগতিতে আর যত কম সম্ভব লোক ক্ষয় হয় সেভাবে কাজ করতে হবে। জিয়া এই কথাগুলো শুনেছিলেন। ২৪ মার্চ ব্রিগেডিয়ার মজুমদার ঢাকা চলে যান। সন্ধায় পাকিস্তানি বাহিনী শক্তি প্রয়োগে চট্টগ্রাম বন্দরে যাওয়ার পথ করে নেয়। জাহাজ সোয়াত থেকে অস্ত্র নামানোর জন্যই বন্দরের দিকে ছিল তাদের এই অভিযান। পথে জনতার সাথে ঘটলো তাদের কয়েক দফা সংঘর্ষ। এতে আহত হলো বিপুল সংখ্যক বাঙালি। সশস্ত্র সংগ্রাম যে কোন মুহূর্তে শুরু হতে পারে, এটা তারা ধরেই নিয়েছিলেন। মানসিক দিক দিয়ে তারা প্রস্তুতও ছিল। পরদিন তারা পথের ব্যারিকেড অপসারণের কাজে ব্যস্ত ছিলেন। তারপর এলো সেই কালো রাত ২৫ ও ২৬ মার্চের মধ্যবর্তী কালো রাত। রাত ১টায় পাকিস্তানি সেনা কমাডিং অফিসার জিয়াকে নির্দেশ দিলো নৌ-বাহিনীর ট্রাকে করে চট্টগ্রাম বন্দরে যেয়ে জেনারেল আনসারীর কাছে রিপোর্ট করতে। তার সাথে নৌ-বাহিনীর (পাকিস্তানি) প্রহরী থাকবে তাও জানানো হয়েছিল। তিনি ইচ্ছা করলে তার সাথে তিনজন লোক নিয়ে যেতে পারেন। তবে তার সাথে পাকিস্তানি ব্যাটেলিয়নের একজন পাকিস্তানি অফিসারও থাকবে। অবশ্য কমাডিং অফিসারের মতে সে যাবে তাকে গার্ড দিয়েই। এ আদেশ পালন করা জিয়ার পক্ষে ছিল অসম্ভব। তিনি বন্দরে যাচ্ছে কি না তা দেখার জন্য ও একজন লোকছিল। আর বন্দরে প্রহরীর মতো প্রতীক্ষায় ছিল জেনারেল আনসারী। হয়ত বা জিয়াকে চিরকালের মতোই স্বাগতম জানাতে। তারা বন্দরের পথে বেরোলেন। আগ্রাবাদে তাদের থামতে হলো পথে ছিল ব্যারিকেড। এই সময়ে সেখানে এলো মেজর খালেকুজ্জামান চৌধুরী, ক্যাপ্টেন অলি আহমদের কাছ থেকে এক বার্তা এসেছে। জিয়া তখন হাঁটছিলেন। খালেক জিয়াকে একটু দূরে নিয়ে গিয়ে কানে কানে বললেন পাকিস্তানিরা ক্যান্টনমেন্ট ও শহরে সামরিক তৎপরতা শুরু করেছে এবং বহু বাঙালিকে ওরা হত্যা করেছে। এটা ছিল একটা সিদ্ধান্ত গ্রহণের চূড়ান্ত সময়। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই মেজর জিয়া বলেন, আমরা বিদ্রোহ করলাম। তুমি ষোলশহর বাজারে যাও। পাকিস্তানি অফিসারদের গ্রেফতার করতে অলি আহমদকে বলো এবং ব্যাটেলিয়ান তৈরি রাখতে আমি আসছি। জিয়া নৌ-বাহিনীর ট্রাকের কাছে ফিরে গেলেন। পাকিস্তানি অফিসার, নৌ-বাহিনীর চীফ পেটি অফিসার ও ড্রাইভারকে জানান যে, তাদের আর বন্দরে যাওয়ার দরকার নেই। এতে তাদের মনে কোনো প্রতিক্রিয়া হলো না দেখে পাঞ্জাবি ড্রাইভারকে ট্রাক ঘুরাতে বললেন। ভাগ্য ভালো জিয়ার আদেশ তারা মানলো। জিয়া আবার ফিরে চললেন। ষোলশহর বাজারে পৌঁছেই জিয়া গাড়ি থেকে লাফিয়ে নেমে একটা রাইফেল তুলে নিলেন। পাকিস্তানি অফিসারটির দিকে তাক করে বললেন, হাত তোলো আমি তোমাকে গ্রেফতার করলাম। নৌ-বাহিনীর লোকরা এতে বিভ্রান্ত হয়ে পড়লো। মুহূর্তেই তিনি নৌ-বাহিনীর অফিসারের দিকে রাইফেল তাক করলেন। তারা ছিল আটজন। সবাই জিয়ার নির্দেশ মানলো এবং অস্ত্র ফেলে দিল। জিয়া কমাডিং অফিসারের জিপ নিয়ে তার বাসার দিকে রওয়ানা দিলেন। বাসায় পৌঁছে হাত রাখলেন কলিং বেলে কমান্ডিং অফিসার পাজামা পরেই বেরিয়ে এলো। খুলে দিল দরজা। ক্ষিপ্রগতিতে জিয়া ঘরে ঢুকে পড়লেন এবং গলাশুদ্ধ তার কলার টেনে ধরলেন। দ্রæত গতিতে আবার দরজা খুলে কর্নেলকে তিনি বাইরে টেনে আনলেন। বললেন, বন্দরে পাঠিয়ে আমাকে মারতে চেয়েছিলে? এই আমি তোমাকে গ্রেফতার করলাম এখন লক্ষী সোনার মতো আমার সঙ্গে এসো। সে জিয়ার কথা মানলো। জিয়া তাকে ব্যাটেলিয়নে নিয়ে এলেন। অফিসারদের মেসে যাওয়ার পথে তিনি কর্নেল শওকতকে (তখন মেজর) ডাকলেন। তাকে জানালেন তারা বিদ্রোহ করেছে। শওকত জিয়ার হাতে হাত মিলালো। ব্যাটেলিয়ানে ফিরে গেলেন, সমস্ত পাকিস্তানি অফিসারকে একটি কক্ষে বন্ধ করে একটা ঘরে রাখা হলো। জিয়া অফিসে গেলেন এবং চেষ্টা করলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল এম আর চৌধুরীর সাথে আর মেজর রফিকের সাথে যোগাযোগ করতে। কিন্তু পারলেন না। সব চেষ্ট ব্যর্থ হলো। তারপর রিং করলেন বেসামরিক বিভাগের টেলিফোন অপারেটরকে। তাকে অনুরোধ জানালেন- ডেপুটি কমিশানার, পুলিশ সুপারিনটেনডেন্ড, কমিশনার, ডিআইজি ও আওয়ামী লীগ নেতাদের জানাতে যে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অষ্টম ব্যাটেলিয়ান বিদ্রোহ করেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করবে তারা। এদের সবার সাথেই টেলিফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছি। কিন্তু কাউকে পাইনি, তাই টেলিফোন অপারেটরের মাধ্যমেই জিয়া তাদের খবর দিতে চেয়েছিলেন। অপারেটর সানন্দে জিয়ার অনুরোধ রক্ষা করতে রাজি হলো। সময় ছিল অতি মূল্যবান। জিয়া ব্যাটেলিয়নের অফিসার জেসিও আর জোয়ানদের ডাকলেন। তাদের উদ্দেশে ভাষণ দিলেন। তার সবাই জানতো তাই তিনি সংক্ষেপে সব বললেন এবং তাদের নির্দেশ দিলেন। তারা জানতো সশস্ত্র সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে হবে। তারা সর্বসম্মতিক্রমে হৃষ্টচিত্তে এ আদেশ মেনে নিলো। জিয়া তাদের একটা সমরিক পরিকল্পনা দিলেন। তখন রাত ২টা বেজে ১৫ মিনিট। ২৬ মার্চ ১৯৭১ সাল। রক্তাক্ষরে বাংলাদেশের বাঙালির হৃদয়ে লেখা একটি দিন। বাংলাদেশের জনগণ চিরদিন স্মরণ রাখবে এই দিনটিকে। স্মরণ রাখবে ভালোবাসবে এই দিনটিকে। তারা কোনো দিন ভুলবে না, কোনো দিন না।
১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ কিংকর্তব্যবিমূঢ় ও দিকনির্দেশনাহীন জাতিকে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ গ্রহণের আহŸান জানিয়ে মেজর জিয়া কালুরঘাট স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ঘোষণা করে বলেন ÒI speack Mejor Ziaur Rahman do hair by declear independent of Bangladesh” প্রেসিডেন্ট শহীদ জিয়াউর রহমান এই ঘোষণা দিয়েই ক্ষান্ত হননি মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করে নিজে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং ১৪ এপ্রিল ’৭১ পর্যন্ত স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার ঘঠন হওয়ার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি তার নেতৃত্বেই যুদ্ধ পরিচালনা করেন। কিন্তু তিনি সেদিন রাষ্ট্র প্রধান বা অস্থায়ী সরকার প্রধান বা প্রধান সেনাপতি বা বিপ্লবের নায়ক হিসেবে কোনো পদ চাননি। অর্থাৎ স্বাধীনতা বিপ্লব স্তরে যখন জনগণের নেতা অনুপস্থিত, জাতি যখন কিংকর্তব্যবিমূঢ়, ঠিক সেই সময় মেজর জিয়ার এই ঘোষণা একজন জাতীয়তাবাদী নেতারই পরিচায়ক, জিয়ার দেশপ্রেমের বহিঃপ্রকাশ। স্বাধীনতা উত্তর ’৭২ সালে প্রেসিডেন্ট শহীদ জিয়া শফিউল্লাহ থেকে ৫ জনের বয়জ্যেষ্ঠ হওয়া সত্তে¡ও সেনাপ্রধান না করে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ সরকার সেনাবাহিনীর ডেপুটি চীফ অব স্টাফ নিযুক্ত করেন। ১৯৭৫ সালে ৭ নভেম্বর সিপাহি বিপ্লব পর্যন্ত। জনগণের সার্বিক মুক্তির বিপ্লবের দ্বিতীয় স্তরে। তৃতীয় স্তরে অর্থাৎ প্রেসিডেন্ট জিয়া রাষ্ট্রপতি দায়িত্ব গ্রহণের পূর্বে দেশ অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির স্তরে দেশ পুনরায় দুটি জাতীয় সংকটে আবর্তিত হয়। এ ঘটনা অর্থাৎ ২রা নভেম্বর ও ৩রা নভেম্বর ’৭৫ সালের বিপ্লব ধারায় জাতীয় দুটি সংকটে পড়ে তাতে জাতিকে ভাবিয়ে তোলে। অর্থাৎ এ সময় দেশে ষড়যন্ত্রকারীদের সমন্বয়য়ে স্বাধীনতা সর্বভৌমত্ব বিপন্নকারীদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়ে। খালেদ মোশাররফ অবৈধভাবে ক্ষমতা গ্রহণের পর ষড়যন্ত্রকারীদের হাতে জেনারেল জিয়াউর রহমান বন্দি হন। ৪ঠা নভেম্বর খালেদ মোশাররফের মার নেতৃত্বে কলাবাগান থেকে আধিপত্তবাদী শক্তিকে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার আহŸান জানিয়ে মিছিল করলে জনগণের চেতনা জাগ্রত হয়। তাতে করে সেনাবাহিনীর মধ্যে একে অপরকে বিশ্বাস করতে না পারায় সেনাবাহিনীর মধ্যে আতংক ছড়িয়ে পড়ে। এ অবস্থা চলতে থাকলে দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী ঐক্যবদ্ধ হয়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে রাজপথে নেমে পড়ে এবং কিংকর্ত্যবিমূঢ় জনগণকে নিয়ে পরিস্থিতির সামাল দেয়। এক পর্যায়ে তারা তাদের কাছে প্রিয় ব্যক্তিত্ব জেনারেল জিয়াকে বন্দি অবস্থা থেকে মুক্ত করে তাদের কাছে নিয়ে আসে এবং জেনারেল জিয়া ৭ নভেম্বর সিপাহি জনতার অনুরোধে ঘোষণা করেন। “আমি মেজর জিয়া বলছি” আপনার এখন থেকে দেশের শান্তি শৃঙ্খলায় আত্ম নিয়োগ করে দেশের উন্নয়নে ঝাঁপিয়ে পড়–ন। আল্লাহ আমাদের সহায় হন। বলতে দ্বিধা নাই ৩রা নভেম্বর ’৭৫ থেকে ৭ই নভেম্বর ’৭৫ পর্যন্ত দেশে কোনো সরকারই ছিল না। খালেদ মোশাররফের সামরিক অভ্যুত্থান ব্যর্থ হওয়ার পর দেশময় সামরিক শাসন জারি করা হয়। তখন জেনারেল জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি আবু মোহাম্মদ সায়েমের অধীনে অস্থায়ী চীফ অব স্টাফ হিসাবে দায়িত্ব ভার গ্রহণ করেন। ১৯৭৫ সালের ২৯ নভেম্বর জিয়াউর রহমান প্রধান আইন সামরিক আইন প্রশাসক নিযুক্ত হন। ১৯৭৭ সালের ২ এপ্রিল বিচারপতি আবু মোহাম্মদ সায়েম রাষ্ট্রপতির পদ হতে পদত্যাগ করিলে তার স্থলে প্রেসিডেন্ট শহীদ জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতির এ মাহন দায়িত্ব ভার গ্রহণ করেন। দায়িত্ব গ্রহণের পর তিনি বিগত দিনে ঘটে যাওয়া অবস্থা দূর করতে কঠোর পরিশ্রম শুরু করেন। প্রশাসনের সকল প্রকার শিথিলতা দূর করা ও জনগণকে সাথে নিয়ে দেশের উন্নয়নের দিকে মনোনিবেশ করেন। তার প্রতি জনগণের আস্থা রায়েছে কিনা সেই জন্য তিনি ক্ষমতা গ্রহণের ৪০ দিন পর ২১ এপ্রিল ’৭৭ সালে হ্যাঁ-না গণভোটের ব্যবস্থা করেন। শতকরা ৯৯% ভাগ জনগণের সমর্থিত ভোটে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৮ সালের ৩রা জুন সার্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে প্রত্যক্ষ নির্বাচনে তিনি দেশের প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তিনি জনগণের ক্ষমতা জনগণের হাতে ফিরিয়ে দিতে রাজনীতিতে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে রাজনীতির লাইসেন্স প্রদান করেন। তিনি নিজেও প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর জাগোদলের মোর্চা বিলুপ্ত করে জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি গঠন করেন। তিনি ১৯৭৯ সালের ১০ ফেব্রæয়ারি দেশে জাতীয় সংসদের সাধারণ নির্বাচন ঘোষণা করেন। এই নির্বাচনে বিএনপি ৩০০ আসনের ২২০টি আসন লাভ করে। সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে। ১৯৮১ সালের ৩১ মে রাতে এক গভীর ষড়যন্ত্রে চট্টগ্রামের সার্কিট হাউজে একদল গুপ্তঘাতকের গুলিতে তিনি শাহাদাৎবরণ করেন, ইন্নাল্লিলাহে ওয়াইন্নাইলাহে রাজেউন।

Recent Posts